মাহফুজ আনামের লেখা: বিএনপি কি তার কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশার সম্মান রাখছে

বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের প্রত্যাশা
গত ২৭ নভেম্বর বিকেলে দেখা যায়, বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের কলাপসিবল গেট দিয়ে একটি চেয়ারে কিছু সংবাদপত্র দেখা যায়। এ ছাড়াও একটি টেবিল ও চারপাশে ধুলার আস্তর পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। ছবি: সাজ্জাদ হোসেন/স্টার

একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে চরম ব্যর্থতার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমরা অনেক কিছুই লিখেছি। ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের—মূলত বিএনপি—সঙ্গে যে আচরণ করছে তা নিয়েও তীব্র সমালোচনা করেছি

বিএনপির নেতাকর্মীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, দলটির শত শত নেতাকর্মী কারাগারে, হাজারো নেতাকর্মীর নামে মামলা এবং লাখো নেতাকর্মী গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভিন্নমত পোষণকারীদের দমনে আইনি প্রক্রিয়াকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। পুলিশকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে, যাতে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের শাস্তি দেওয়া যায়, হয়রানি করা যায় এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করা যায়। পুরো বিষয়টি অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠের পরিস্থিতি কেমন? বিএনপি কি তার দলীয় কর্মী, কিংবা বর্তমান সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ও আওয়ামী লীগের প্রতি মোহভঙ্গ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে? তাদের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখাতে পেরেছে? নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কি তারা সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নিয়েছে, নাকি নিজেরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে?

আমাদের ভোটাররা ঐতিহ্যগতভাবেই শাসক-বিরোধী মনোভাব পোষণ করে।  আর সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের নিরন্তর ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এটা অনুমান করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে মানুষ পরিবর্তন চাইছে। কিন্তু বিএনপি কি পরিবর্তন আনতে কাজ করছে?

আমাদের প্রতিবেদকদের দেওয়া তথ্য ও জরিপের ফলাফল—যা খারাপ পরিণামের ভয়ে প্রকাশ করা হয়নি—এবং কিছু গোয়েন্দা প্রতিবেদন সংক্রান্ত গুজব থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, বিরোধী দলের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন সর্বাত্মক না হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রয়েছে। কিন্তু বিএনপি এই সমর্থনকে ভিত্তি করে কী করেছে?

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরই বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল যে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। একইসঙ্গে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি জানায়।

গত বছর থেকে দলটি বিভাগীয় পর্যায়ে সমন্বয় করে বড় আকারের জনসমাবেশের আয়োজন করতে সক্ষম হয় এবং পরিবহন ধর্মঘট ও সরকার আরোপিত নানা কঠোর বাধা-বিপত্তি এসব সমাবেশে জনসমাগম বন্ধ করতে পারেনি। ফলে বিএনপি ও সমমনারা মনে করছেন যে তাদের আন্দোলন সফল হচ্ছে।

কিন্তু, সরকারের প্রতিক্রিয়া ঠিক কতটা কঠোর হতে পারে, সেটা সম্ভবত তারা সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেনি। এমনকি সরকার কঠোর হলে তাদের করণীয় কী হবে, সেটাও সম্ভবত তারা হিসাব করে রাখেনি। গণজোয়ার তৈরি হওয়ার ভয়ে ক্ষমতাসীন দল নানা অগণতান্ত্রিক ও আইন-বহির্ভূত ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপিকে দমনের চেষ্টা করে।

২৮ অক্টোবরের পরবর্তী সময়ে সরকার যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তাকে যেকোনো মানদণ্ডে দমন-পীড়ন বলা চলে। সরকারের নেওয়া এমন ব্যবস্থার পর গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির যে সক্ষমতা, সেটা বড় আকারে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। মহাসচিবসহ প্রায় সব শীর্ষনেতাকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিএনপির প্রায় সব নেতাকর্মীকে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই দলটিকে প্রায় পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য, অন্তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সেটাই প্রকাশ পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা যথোপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামেনি। আর এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। গত বছর বিশাল জনসমর্থনের বীজ বপন করতে পারলেও এ বছর সেখান থেকে সাফল্যের কোনো ফসল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি।

বিএনপির আরেকটি মারাত্মক ভুল হচ্ছে কোনো বিকল্প পরিকল্পনা না রাখা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি জানানো হলে এর প্রতিক্রিয়া যে কঠোর কিছু হবে, তা অবধারিতই ছিল। কিন্তু কঠোর পরিস্থিতি এলে কীভাবে টিকে থাকা যাবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা তাদের ছিল না।

যদি বিএনপির উদ্দেশ্য এটাই হয়ে থাকে যে তারা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া প্রভাব কমাবে, তাহলে নির্বাচনের সময় ক্ষমতা ভাগের প্রস্তাব দিতে পারত। সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষের সম্মতিতে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে মাথায় রেখে সরকারের কিছু পদ বিরোধী দল বা নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিতে পারত। যেহেতু নির্বাচনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, সেক্ষেত্রে এই বাহিনীর ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ কমাতে বিশেষ কিছু প্রস্তাব দেওয়া যেত। এ ধরনের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হলে তা ভোটারদের এই বার্তা দিত যে, বিএনপি তাদের দাবিতে অনড়, কিন্তু তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার আগ্রহ রয়েছে।

এমন সব বিকল্প আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া বিএনপির আরেকটি বড় ভুল। বিএনপি যে 'বাইরের চাপ'র ভরসায় ছিল, সেখান থেকেও তারা পুরোপুরি হতাশ হয়েছে। বিএনপি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যখনই আলোচনায় বসেছে, তাদের কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেননি। বরং সবাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির কানে এই বার্তা পৌঁছায়নি।

এক্ষেত্রে তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে যে, আওয়ামী লীগ আসলে কখনোই চায়নি যে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক এবং বিএনপিও কখনোই টের পায়নি যে তাদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি আসলে তাদেরকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে হাসিলেই সহায়তা করছে। সব মিলিয়ে বোঝা যায় যে দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী রাজনৈতিক দলটি কখনোই এ বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেনি যে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটি তাদের দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে স্বার্থরক্ষামূলক হবে কি না।

২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ফল কী হয়েছিল, সেটা সম্ভবত পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করেনি বিএনপি।

অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি এমন যুক্তিও দেওয়া যায় যে, বিএনপি যদি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করত, তাহলে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তার অবস্থান হারাতেন না। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও, সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকতে পারত এবং হয়তো তাদেরকে এত বেশি নির্যাতন ও কারাবরণ করতে হতো না।

এমনকি, বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে থাকলে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়ার মামলাগুলো লড়তে বাড়তি সুবিধা পেতেন, যা এখন পাচ্ছেন না। খালেদা জিয়া সক্রিয় নেতৃত্বে না থাকার একটি বড় নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে বিএনপির ওপর। যদি বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করত, তাহলে বিষয়টি কি এমন হতো? বিএনপি কি এসব বিষয় আমলে নিয়েছিল?

এবারও যদি বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে তা হবে বিএনপির দ্বিতীয় নির্বাচন বয়কট। এই অঞ্চলে তো বটেই, সম্ভবত কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই কোনো রাজনৈতিক দল এক দশকের মধ্যে দুটি নির্বাচন বয়কট করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এবারের নির্বাচন বয়কটও কি বিএনপির অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি করতে পারে?

বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যে, নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা না পেলে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো কারণই নেই। আমাদের দৃষ্টিতে এমন চিন্তা একটি মারাত্মক ভুল। শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকার প্রয়োজনগুলো তাদের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। বিএনপি এটা বিবেচনা করছে না যে তাদের নিজস্ব নীতি ও ভিশন প্রচারে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে সংসদ এবং আগামীতে তারা সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য যত দুঃখজনক ও ক্ষতিকরই হোক না কেন, দেশের সবচেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কখনোই বিরোধী দলের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। তারা সবসময় ক্ষমতা চায় এবং কখনোই দায়িত্বশীল সমালোচকের ভূমিকায় সরকারকে জবাবদিহিতায় রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করে না।

শাসকবিরোধী মনোভাব, সরকারের নানান ব্যর্থতা, ব্যাপক দুর্নীতি ও উদ্ধত মনোভাবের কারণে মানুষ পরিবর্তন চাইছে। কিন্তু এতকিছুর পরও বিএনপি সেই সুযোগ নিয়ে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। হয়তো তারা পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন এককভাবে জিততে পারত না। কিন্তু নিঃসন্দেহে তারা একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করতে পারত। তেমনটি হলে তারা ২০২৯ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার উপযোগী মঞ্চ তৈরি করতে পারত। কিন্তু এ ধরনের কৌশলে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তাদের এমন 'সব না হয় কিছুই না' মনোভাবের কারণেই বিএনপি নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলে দেশ ও গণতন্ত্রকে চড়া মূল্য দিতে হবে।

বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নিত, তাহলে তাদের একক বা জোটগত ৩০০ মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী দেশের আনাচে-কানাচে নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালাতে পারতেন এবং আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার, অপকর্ম ও দুর্নীতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারতেন। এই প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দল খানিকটা হলেও জবাবদিহির আওতায় আসত এবং বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন জোরালো হতো। আর কিছু না হলেও বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণার কারণে ক্ষমতাসীন দল কিছুটা হলেও সংযত হতো। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও আসার আগ্রহ পেতেন, যা নিঃসন্দেহে আমাদের নির্বাচনের মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারত। আওয়ামী লীগের 'বিদ্রোহী' প্রার্থীদের অংশগ্রহণে গ্রাম পর্যায়েও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বিএনপির সমর্থকরা সেগুলো কেবল দেখছেন, তাদের করার আর কিছুই নেই।

আজকের দিনে বিএনপি শুধু হরতালের ডাক দিচ্ছে, যা কেউ মানছে না; অবরোধের ডাক দিচ্ছে, যা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না; গণবিক্ষোভের ডাক দিচ্ছে, যা কেবলই ফাঁকা বুলি। কী এক নিদারুণ করুণ দশায় রয়েছে আমাদের দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

4h ago