মাহফুজ আনামের লেখা: ‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে, চিন্তার কিছু নেই’

আমাদের অবচেতন মন ইদি আমিনের সেই বিখ্যাত বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তার দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘বাকস্বাধীনতা অবশ্যই আছে, তবে বলার পর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।’
ভিজ্যুয়াল: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান—রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী—গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি কাভারেজ পান এবং তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাও হয় সবচেয়ে বেশি। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কাভারেজের বিষয়টা সত্য হলেও সরকারপ্রধানের সমালোচনার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিস্থিতি এমনই।

যে বিষয়টি আরও কষ্টদায়ক তা হলো, দেশে এমন কোনো আইন নেই যেখানে বলা আছে যে, গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতে পারবে না। তারপরও আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বআরোপিত নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলে আটকে রেখেছি। এর কারণ হয়তো, আমাদের অবচেতন মন ইদি আমিনের সেই বিখ্যাত বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তার দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'বাকস্বাধীনতা অবশ্যই আছে, তবে বলার পর স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারব না।'

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করার পর দ্রুততম সময়ে এবং নির্দয়ভাবে কয়েকজনকে কারাবন্দি করায় একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আইসিটি, ডিজিটাল নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তার মতো আইন থাকা; মানহানিসহ অন্যান্য আইনের অপব্যবহার; ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায় থেকে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন এবং তাদের অনুগত কিছু গণমাধ্যমের প্রচারণা—সামগ্রিকভাবে আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির উপরে, এমনিই তো সময় হয়ে গেছে, তার মধ্যে অসুস্থ, এখানে এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই।'

এর অর্থ কী এই যে, খালেদা জিয়ার বয়স ৮০ বছর হয়ে যাওয়ায় আমরা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে নিঃশেষিত হতে দেখব, কিছুই করব না? আমরা কি বিশ্বাস করি না—একজন মানুষের অন্তিম যাত্রার সময় কেবল সৃষ্টিকর্তাই নির্ধারণ করতে পারেন? প্রতিটি দেশ, সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষ কি একজনের জীবন বাঁচাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্ভাব্য সব চেষ্টা চালায় না? কেউ ৮০ বছরেরও বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না। আমাদের দায়িত্ব, যে কারও জীবন বাঁচাতে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো এবং সক্ষমতার ব্যবহার করা। এটাই তো সভ্যতা। প্রতিপক্ষকে অপছন্দ করার হাজারো কারণ থাকতে পারে, কিন্তু জনসম্মুখে এমন মন্তব্য কেবল ঘৃণাকেই আরও ছড়িয়ে দেবে।

গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে হবে। কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতা দখল করতে পারবে না।'

তার এই মন্তব্যকে আমরা পুরোপুরি সমর্থন জানাই। এটা বাংলাদেশের জন্য গর্বের বিষয় যে, নানা ধরনের সমস্যা থাকলেও আমরা গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রেখেছি এবং গণতন্ত্রের বৃহত্তর অবকাঠামোর মধ্যে থেকেই অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। কিন্তু, তার সরকার ও দল কি গণতন্ত্রকে আরও বলিষ্ঠ করার জন্য কাজ করছে?

তিনি তেমন কোনো বিরোধিতা (হরতাল, অবরোধ বা অন্য কোনো বড় আন্দোলন) ছাড়াই টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতায় আছেন। এর সঙ্গে প্রথম মেয়াদ ধরলে মোট ২০ বছর। তিনি কি এই সময়টাতে গণতন্ত্রকে আরও বলিষ্ঠ করার জন্য কিছু করেছেন? এমন বাধাহীন শাসনামল এর আগে আর কোনো দল উপভোগ করেনি, এমনকি সামরিক স্বৈরশাসকও না। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে কি সংসদ, বিচারবিভাগ, গণমাধ্যম কিংবা জবাবদিহি ও নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী সাংবিধানিক কোনো সংস্থা আগের তুলনায় আরও বলিষ্ঠ হয়েছে?

একদিকে প্রধানমন্ত্রী যখন গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছেন, তখন তারই দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত মঙ্গলবার এক জনসমাবেশে বলেছেন, 'কোথায় স্যাংশন? কোথায় ভিসা নীতি? তলে তলে আপস হয়ে গেছে। চিন্তার কিছু নেই।'

তিনি যেহেতু 'স্যাংশন' ও 'ভিসা নীতি' শব্দগুলো বলেছেন, আমরা ধরে নিতে পারি যে এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন আলোচনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেছেন, 'দিল্লি আছে। আমেরিকারও দিল্লিকে দরকার। দিল্লি আছে, আমরা আছি।'

এর অর্থ হলো, নিশ্চিতভাবেই এই গোপন চুক্তি সংশ্লিষ্ট আরেকটি পক্ষ ভারত। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তি হয়েছে, যার ফলে আওয়ামী লীগের 'চিন্তার কোনো কারণ নেই'।

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য থেকে যা বোঝা যায় তা হলো, দিল্লির সমর্থন থাকায় আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় থাকছে। এটা ছাড়া 'চিন্তার কিছু নেই' বলার আর কী অর্থ হতে পারে? এমন একটি কথা আমাদের দেশ ও মানুষের সার্বভৌমত্ব ও সম্মান নিয়ে কী বার্তা দেয়? প্রতিবেশী দেশ যদি নির্ধারণ করে দেয় যে এ দেশের ক্ষমতায় কে থাকবে, তাহলে সরকারের স্বাধীনতা সম্পর্কে কী বার্তা পাওয়া যায়? তাহলে আমাদের নির্বাচনের যৌক্তিকতা কী?

তাহলে আমরা—ভোটাররা—কোথায় আছি? ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য 'নির্বাচিত' হন। ৩০০ আসনের সংসদের ক্ষেত্রে বলা যায়, সরকার গঠনে বেশিরভাগ সদস্যই একটি ভোটও না পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতে ভোট পড়ল। এবার নির্বাচনের 'ফল' নিয়ে বহির্শক্তির সঙ্গে 'দর-কষাকষি' চলছে। এভাবেই কি বাংলাদেশে গণতন্ত্র কাজ করছে? এটাই কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সেই 'খেলা হবে'? মনে হচ্ছে আমাদের নির্বাচন 'ফেয়ার প্লে' নয়, বরং 'ম্যাচ ফিক্সিং'য়ের উদাহরণ হতে যাচ্ছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের মৌসুমে সরকারের কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়। তাত্ত্বিকভাবে এটা হচ্ছে সেই সময়, যখন সাধারণ নাগরিকরা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবতে পারেন। অন্তত তেমনটাই হওয়ার কথা। কিন্তু মর্মান্তিক হলেও সত্য, আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়।

বিরোধীদলের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অজুহাতে সরকার যেভাবে দমনপীড়ন চালাচ্ছে সেটা বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, বিরোধীদলের জন্য 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। সরকার যত রেকর্ডই সৃষ্টি করে থাকুক না কেন, এর কোনোটিই বিরোধীদের দমনে দায়ের করা মামলা সংখ্যার রেকর্ডের ধারেকাছেও নেই।

বিএনপি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার মামলা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে মামলায় 'অজ্ঞাতনামা' আসামির সংখ্যা নামীয় আসামির চেয়েও বেশি। তদন্ত সাপেক্ষে এই 'অজ্ঞাতনামা' আসামি হিসেবে যে কারও নাম আসতে পারে এবং সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তদন্তের যেকোনো পর্যায়ে যে কাউকে পুলিশ ফাঁসিয়ে দেয়, যদি না তাদের দাবি মতো ঘুষের টাকা পায়। যাই হোক, বিএনপির দাবি করা মামলা ও আসামির সংখ্যা থেকে যদি ৫০ শতাংশ বাদও দেই, তারপরও রাজনৈতিক দমনপীড়ন ছাড়া এত মামলার পেছনে আর কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত 'কারও ৪৫০, কারও ৩০০, বিএনপি নেতাদের কার বিরুদ্ধে কত মামলা' শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খানের বিরুদ্ধে ৪৫০টি মামলা চলছে। এ ছাড়া, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে ৩৫০, যুবদল নেতা জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে ৩১৭, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৩১৫, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ২৫০ ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ১৮০ মামলা চলছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশিরভাগ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো মামলা চলছে। আরও অনেকেই আছেন, যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা চলমান।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৯৮টি মামলা রয়েছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেত্রী সেলিনা রহমানের বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। তার বিরুদ্ধেও চারটি মামলা চলছে, যার একটিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে তিনি বাস পুড়িয়েছেন। এত মামলায় শুধু আদালতে হাজিরা দিতেই অভিযুক্তদের সারা বছর কেটে যেতে পারে।

উল্লেখিত এসব মামলার বেশিরভাগই অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর আগে দায়ের করা এবং ক্ষমতাসীন দলের মেয়াদের বেশিরভাগ সময়জুড়ে এগুলো নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু নির্বাচন চলে আসায় হঠাৎ করেই যেন এসব মামলা নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছে এবং পুলিশও 'আইনপ্রয়োগে' অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে।

আমাদের আর কোনো পরিসংখ্যানের দরকার নেই। দেশের সবচেয়ে বড় বিরোধীদলের বিরুদ্ধে মামলার যে উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, সেটাই প্রমাণ করে যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের সব দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত বুধবার বলেন, 'নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের লিগ্যালিটি (আইনগত দিক) দেখবে, নির্বাচনের লেজিটিমেসি (ন্যায্যতা) নিয়ে মাথা ঘামাবে না।' আমরা ঠিক এই ভয়ই করছিলাম। ২০১৪ সালে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় 'নির্বাচিত' হন। সেই তথাকথিত নির্বাচন 'আইনত সঠিক' ছিল। কিন্তু সেগুলো কি নৈতিকতার মাপকাঠিতে সঠিক ছিল? একে কি গণতন্ত্রের চর্চা বলা যায়? পাঁচ বছর অপেক্ষার পরও যখন মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৩৯ ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগই পাননি, তখন তাদের কেমন লেগেছিল?

হ্যাঁ, অবশ্যই আমাদের 'আইনত সঠিক' নির্বাচন প্রয়োজন, কিন্তু সেটা একইসঙ্গে 'বিশ্বাসযোগ্য' নির্বাচন হতে হবে। এটা শুধু জয়ী দলের কাছে নয়, ভোটারদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। নির্বাচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে, এতে 'জনগণের ইচ্ছার মুক্ত ও অবাধ প্রতিফলন' থাকতে হবে। কেবল আনুষ্ঠানিকভাবে আইন মেনে নির্বাচন আয়োজনই নয়, সেইসঙ্গে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করাও নির্বাচন কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বিষয়গুলো সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে, শুধু আইনি বিষয়ে নয়।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments