‘আমার জীবনজুড়ে হুমায়ূন আহমেদ’

মাহফুজ আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকার হিসেবেও তুমুল জনপ্রিয়। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে।

তার লেখা কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত ধারাবাহিকগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আগুনের পরশমণিসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা পরিচালনা করে প্রশংসিত হয়েছেন।

আজ ১৩ নভেম্বর হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন।

তার পরিচালিত দুটি সিনেমা এবং অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ। কথার জাদুকর হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অভিনেতা।

মাহফুজ আহমেদ বলেন, 'আমাকে হাতে ধরে তৈরি করেছেন হুমায়ুন আহমেদ। তার কাছে আমার অনেক ঋণ। সংলাপ বলা, তাকানো, অনেক কিছু শিখেছি তার কাছে। আমার কাছে সারাজীবনের ভালোবাসা, অভিভাবক, বন্ধু , বড় ভাই হয়ে মনের মধ্যে গেঁথে আছেন হুমায়ুন  আহমেদ।

আমার কাছে এখনও হুমায়ূন আহমেদ জীবন্ত, যেন সামনে বসে আছেন, মিটমিট করে হাসছেন। তার হাসিমুখটাই আমার কাছে ভাসে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর আমি ছিলাম একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সারাজীবন তাকে আমি স্যার বলেছি।

তাকে নিয়ে কয়েকটি ঘটনার কথা বলছি। আমার জীবনে প্রথমবার গাড়ি কিনেছি, সেই ঘটনা বলছি। গাড়ি হবে, গাড়ি কিনব কোনোদিনও ভাবিনি। কিন্তু অভিনয় জীবনে এসে গাড়ি কিনলাম। ব্যাংক থেকে লোন করা হলো। গ্যারান্টর হলেন হুমায়ুন আহমেদ। যা-ই হোক, একসময় কিস্তি শোধ করতে পারছিলাম না। ব্যাংক থেকে চিঠি যায় হুমায়ূন স্যারের কাছে। তিনি আমাকে ডাকলেন।

তিনি বললেন, ঝামেলায় ফেলে দিয়েছ। তোমার লোনের চিঠি আমার কাছে? আমি বলি, স্যার, আমি লোন শোধ করতে পারব না। আমার কাছে টাকা নেই, আমাকে উদ্ধার করেন। তিনি হাসলেন, বেশ কিছু  টাকা দিলেন। এরপর অভিনয় করে সেই টাকা শোধ করে দিই। আমার প্রথম গাড়ি কেনার সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে আছেন ভালোবাসা দিয়ে। এটাই হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

আমার বিয়ের সময়ের ঘটনাটা বলছি এবার। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ছিলেন আমার চাচা শ্বশুর। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম হুমায়ূন স্যারকে পাঠাব। তাকে বললাম, রাজি হলেন। তারপর সময় করে এরশাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এলেন। এসেই বললেন, মাহফুজ, তুমি তো সব ঠিক করেই এসেছ। তিনি যে রাজি হয়েছিলেন এরশাদ সাহেবের কাছে যেতে, এটাও আমার জন্য বড় ঘটনা।

একটা সময় হুমায়ূন স্যারের অফিসে নিয়মিত যেতাম। দুপুরবেলা তার সঙ্গে লাঞ্চ করতাম। তারপর গল্প করতাম। এটা বহুদিন হয়েছে। একুশে বই মেলার সময়ে বহুদিন তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে লাঞ্চ করে গল্প শেষ করে বইমেলায় নিয়ে যেতেন। তিনি অটোগ্রাফ দিতেন, আমি পাশে বসে থাকতাম। কিন্ত বলে রাখি, তার কাছে যাওয়া এত সোজা ছিল না। তিনি যাকে পছন্দ করতেন, প্রচণ্ডভাবেই করতেন। যাকে ভালোবাসতেন, প্রচণ্ডভাবেই বাসতেন। আমি ছিলাম তার কাছে সন্তানতুল্য, সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন আমাকে।

একবার বইমেলায় তিনি একটি বই আমার হাতে দিলেন। বললেন, খুলে দেখ। আমি তো অবাক! তিনি বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছেন। বইয়ের নাম এই মেঘ রৌদ্র ছায়া। উৎসর্গপত্রে যা লেখা ছিল তা এতটাই আবেগতাড়িত, আমি আজও ভুলিনি। তিনি লিখেছিলেন, এক সময় মাহফুজ আমার অফিসে নিয়মিত আসত, দুপুরে আমার সঙ্গে ভাত খেতে। আমি আজও দুপুরবেলা তার জন্য অপেক্ষা করি, কিন্ত সে আসে না। তবে মাহফুজ ভাত খেতে আসত না, গল্প করতে আসত। এরকম চমৎকার করে কজন লিখতে পারেন!

তিনি মারা যাওয়ার পর আড়াই বছর লেগেছে আমার স্বাভাবিক হতে। আমি আড়াই বছর কোথাও তাকে নিয়ে কিছু বলিনি, বলতে পারিনি। দীর্ঘদিন পর একটি পত্রিকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এতটাই তাকে ভালোবাসতাম, এখনও বাসি।

একবার অরুণ চৌধুরীর একটি নাটকের শুটিং করছিলাম ধানমন্ডিতে। শুটিং বাড়ির সামনে হুমায়ূন স্যার আসেন, আমাকে ডাকা হয়। আমি যাওয়ার পর গাড়িতে তোলেন। সোজা নুহাশপল্লীতে নিয়ে যান। অথচ শুটিং ইউনিটের সবাই অপেক্ষা করছেন আমার জন্য। তিন দিন পর ঢাকায় ফিরি। এমনই সরল ও শিশুর মতো সুন্দর মন ছিল প্রিয় লেখকের। তারপর ঢাকায় ফিরে অরুণ চৌধুরীর কাছে ফুল নিয়ে যাই এবং একটি চিঠি দিয়ে আসি। জানি না, অরুণ দা ক্ষমা করেছিলেন কি না!

আমার জীবনজুড়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। কোনটা রেখে কোনটা বলব। এবার মান-অভিমানের ঘটনা বলি। তার দুটি সিনেমা থেকে আমার চরিত্র বদল হয়ে যায়। আমাকে যে যে চরিত্র দেবেন বলেছিলেন, সেটা বদল করা হয়।

তার আগে আমি হুমায়ূন স্যারের শ্রাবণ মেঘের দিন ও দুই দুয়ারি সিনেমায় অভিনয় করেছি। চরিত্র বদলে যাওয়ার কারণে প্রচণ্ড অভিমান করি। যার ফলে যে দুটি সিনেমায় অভিনয় করার কথা ছিল তা করিনি। এতটাই অভিমান করেছিলাম বহুদিন তার কাছাকাছি যাইনি।

কাছাকাছি গেলাম তখন, যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি বিদেশে যাচ্ছেন। চলে যাওয়ার রাতে দখিন হাওয়ায় যাই। কিন্তু পাশাপাশি বসেও কোনো কথা হয় না। নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকি দুজনে কয়েক ঘণ্টা। তারপর তিনি বিদেশে চলে গেলেন চিকিৎসা নিতে।

কিছুদিন পর দেশে ফিরলেন। বিমানবন্দরে চলে গেলাম। পাশ নিয়ে ভেতরে গেলাম। হুমায়ূন স্যার বের হয়ে আসছেন। আমি তার পা ছুঁয়ে সালাম করে ক্ষমা প্রার্থনা করি। সমস্ত মান-অভিমান দূর হয়ে যায়। বাইরে অনেক সাংবাকিরা ভাইয়েরা অপেক্ষা করছেন। তিনি কথা বলবেন না। আমি অনুরোধ করার পর কথা বললেন।

হুমায়ূন স্যার একা চলতে পছন্দ করতেন না, দলবল নিয়ে, বন্ধু-প্রিয়জন নিয়ে চলতে পছন্দ করতেন। নুহাশপল্লীতে সেইসব প্রিয়জনদের নিয়ে আড্ডা দিয়ে, খাওয়াদাওয়া করতে ভালোবাসতেন। কী কী মেনু হবে, কতগুলো খাবারের পদ থাকবে, সব ঠিক করতেন তিনি। তারপর নুহাশপল্লীর লিচু বাগানে খাবারদাবার হতো। তিনি খেতেন না, আমরা খেতাম। দেখেই মহাআনন্দ পেতেন তিনি। তার ছিল এমনই বিশাল মানসিকতা।'

Comments

The Daily Star  | English
Default loans at banks over the years

BB tightens loan classification rules to meet IMF conditions

Payment failure for three months or 90 days after the due date will now lead to classification of loans regardless of type, according to new rules announced by the central bank yesterday, aligning with international best practices prescribed by the International Monetary Fund (IMF).

11h ago