৯০ বছরেও জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি ইউসুফ কনফেকশনারির
আজ থেকে ৯০ বছরেরও আগের কথা। সময়টা ১৯৩২ সাল। পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার, বংশাল, জনসন রোড ও আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যবসায়িক প্রয়োজন ও কোর্ট-কাছারির কাজে তখন বিপুল মানুষের সমাগম। সে সময়ই স্বল্প পরিসরে স্বনামে বেকারি খুলে বসেন মোহাম্মদ ইউসুফ।
নানা আবদুল ব্যাপারীর কেক-বিস্কুটের ব্যবসা ছিল। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ইউসুফ পেয়েছিলেন তার কাছেই। এরপর তরুণ বয়সে নিজেই খুলে ফেললেন বেকারি।
শুরুতে দোকানটি ছিল পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের পাশে। দুই যুগের বেশি সময় পর ১৯৫৮-৫৯ সালের দিকে স্থান পরিবর্তন করে দোকানটি আনা হয় ১৯/এ জনসন রোডে। বেকারি আইটেমের বাইরেও নানা ধরনের খাবার প্রস্তুত করতে থাকেন তারা। তাই নামটিও বদলে হয়ে যায় ইউসুফ কনফেকশনারি।
দোকান প্রবেশ করলেই দেয়ালে একজনের সাদা কালো ছবি চোখে পড়বে। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৯৯০ সালে মারা যান তিনি। এরপর তার ১১ ছেলে নিজেদের ভেতর ব্যবসা ভাগ করে নেন। বর্তমানে পুরান ঢাকায় ৩টি, ধানমন্ডিতে ৩টি, গুলশান, রমনা, বাংলামোটর মিলিয়ে আরও ৬টি শাখা রয়েছে তাদের। এভাবে মোট ১২টি শাখা পরিচালনা করে আসছেন মোহাম্মদ ইউসুফের উত্তরসূরিরা।
দোকানটির সবচেয়ে পুরোনো শাখাটি জনসন রোডে অবস্থিত। এই শাখা পরিচালনার দায়িত্বে আছেন মো. ইয়ামিন। তাকে সহযোগিতা করেন তার বড় বোন ইশরাত জাহান। তারা মোহাম্মদ ইউসুফের নাতি-নাতনি। মোহাম্মদ ইউসুফের ষষ্ঠ ছেলে মোহাম্মদ ইয়াকুবের সন্তান ইশরাত জাহান ও ইয়ামিন।
মো. ইয়ামিন জানান, উত্তরসূরিদের ভেতর দোকানের শাখাগুলো ভাগাভাগি হয়ে গেলেও এখনও সব শাখার খাবার তৈরি হয় এক কারখানাতেই। জজ কোর্টের পেছনে অবস্থিত সেই কারখানা থেকেই সব শাখায় খাবার যায়।
ইশরাত বলেন, 'এখানে (জনসন রোড শাখা) যে খাবার আপনি পাবেন, সেই একই আইটেম ধানমন্ডি শাখাতেও পাবেন। সব শাখার আইটেম একই আমাদের।'
উত্তরাধিকারসূত্রে দোকান ভাগ হয়ে গেলেও সব শাখায় যেন একই ধরন ও মানের খাবার পাওয়া যায়, তেমন চিন্তা থেকেই নির্দিষ্ট এক কারখানা থেকেই সব শাখায় খাবার পৌঁছানোর এই ব্যবস্থা- এমনটাই জানালেন তারা।
কেক-বিস্কিটের জন্য খ্যাতি রয়েছে ইউসুফ কনফেকশনারির। এই আইটেমগুলোর শুরুটা হয়েছিল মোহাম্মদ ইউসুফের হাত ধরেই। চকলেট, নিমকি, মিষ্টি স্বাদ, সল্টেডসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্কিট পাওয়া যায় এখানে। এছাড়া লম্বা এক ধরনের বিস্কিট পাওয়া যায়, যার নাম ডিনার স্টিক।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টানা পরোটাও তৈরি হয় এখানে। পরোটার জন্য ইউসুফের সুখ্যাতি আছে। তবে এটি সবসময় পাওয়া যায় না। অর্ডার অনুযায়ী বানিয়ে দেন তারা।
রুটির ভেতর আরেকটি বিখ্যাত রুটি হলো ফ্যান্সি রুটি। মাছের মতো আকৃতি দিয়ে বাহারি নকশা কেটে তৈরি করা হয় এটি। ফুল কিংবা পাতার আকৃতিরও ফ্যান্সি রুটি পাওয়া যায়। কেউ চাইলে পছন্দমতো আকৃতিতে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিতে পারেন। তবে এই রুটি সবসময় পাওয়া যায় না। মূলত, শবে বরাত উপলক্ষে বানানো হয় এটি। একেকটি রুটির ওজন হয় ২ বা ৩ কেজি থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত। পুরো পরিবারের খোরাকের জন্য এমন একটি রুটিই যথেষ্ট।
শবে বরাতে এর সঙ্গে থাকে ইউসুফের বানানো সুজির ও বুটের হালুয়া। রমজান মাসে ইফতার আইটেম হিসেবে সুতা কাবাব, জালি কাবাব, হালিম, কাটলেট, জিলাপি, নান, গ্রিলড চিকেনও পাওয়া যায়। তবে অন্য সময় এই আইটেমগুলো বানানো হয় না। কেকের ভেতর প্লেইন বেকারি কেক তো আছেই, তার সঙ্গে ফ্রুট কেক, চেরি কেক, জ্যামরোলও পাওয়া যায়। হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো দেখতে এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায়, যার নাম মুকরুম।
ইউসুফে পাওয়া যায় কয়েক ধরনের প্যাটিসও। প্রথম দেখায় একে কাপ কেক মনে হতে পারে। কিন্তু এটি আসলে প্যাটিস, যা কাপ প্যাটিস নামেই বিক্রি হয়। এর বাইরে রোল পেটিস, মাটন পেটিস রয়েছে। আর আছে চিজ ফিঙ্গার। এর ভেতরে পনির দেওয়া, বাইরে মুচড়ানো মুচড়ানো ধরনের নকশা করা।
খ্যাতি রয়েছে ইউসুফের চানাচুরেরও। সাধারণত, চানাচুরে মিশ্রিত সব আইটেম আমরা একসঙ্গেই পাই। তবে এখানে চানাচুরের উপাদানগুলো আলাদা আলাদা বয়ামে রাখা হয়। ক্রেতারা পছন্দমতো চানার ডাল, বাদাম, মুগ ডাল, চিড়া মিশিয়ে চানাচুর নিতে পারবেন দোকান থেকে। তবে চানাচুর এখন আর তাদের আদি কারখানায় তৈরি হয় না। খান চানাচুর নামে আরেকটি কারখানা তারা করেছেন, সেখান থেকেই সব শাখায় সরবরাহ করা হয় চানাচুর।
ইয়ামিন জানান, আশপাশে আদালত, ডিসি অফিস ও অন্যান্য অফিস থেকে প্রচুর অর্ডার আসে কর্পোরেট ইভেন্টের জন্য। করোনার সময় অর্ডার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে এখন আবার বেশ ভালো পরিমাণে অর্ডার আসছে।
তিনি বলেন, 'উত্তর বাড্ডায় আমাদের আরেকটি কারখানা ছিল, যা করোনার সময় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এখন সব মিলিয়ে ব্যবসা ভালোই চলছে। ভবিষ্যতে দাদার নামে রেস্টুরেন্ট খোলার ব্যাপারেও আমাদের চিন্তাভাবনা আছে।'
Comments