‘তারে কই বড় বাজিকর’

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

উত্তর ভারতের কতিপয় প্রদেশে প্রচলিত ভাষার নাম বাজিগর। ফারসি প্রত্যয়যোগে গঠিত 'বাজিগর' শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ হলো জাদুকর। সাধারণত জাদুকর বলতে আমরা বুঝি যিনি মঞ্চে জাদুর খেলা দেখিয়ে মানুষকে ক্ষণিকের জন্য মোহাবিষ্ট করে রাখে।

বাজিগর গোষ্ঠীর মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই জাদুবিদ্যাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তবে, পেশাগতভাবে সবচেয়ে বড় বাজিগর সম্ভবত একজনই-বাজিগর বাদশাহ শাহরুখ খান। রুপালি পর্দায় অভিনয়ের পেখম মেলে তিন দশক ধরে মানুষের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছন তিনি।

আজ ২ নভেম্বর, বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খানের ৫৮তম জন্মদিন। 

সুপারস্টার তকমা শুধু শাহরুখের একার নয়, বলিউডে আরও অনেককেই 'সুপারস্টার' বলা হয়। কিন্তু, বিশ্বব্যাপী তারকা খ্যাতির প্রশ্নে বলিউডের শাহরুখ খান এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম।

২০০৭ সালে ভারতীয় সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক অনুপমা চোপড়া ট্রম ক্রুজ এবং ব্র্যাড পিট এর চেয়েও বড় 'স্টার' বলেছেন শাহরুখ খানকে। বিশ্বের দোরগোড়ায়, মানুষের হৃদয়ে গেঁথে থাকার পেছনের কারণ কি শুধু অভিনয় নাকি অন্য কোনো সমীকরণও আছে?

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

বাজিগর শব্দটি ঈষৎ পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় হয়েছে বাজিকর। প্রচলিত অর্থে বাজিকর হলো যে জিততে চায় এবং জেতার জন্য যেকোনো কাজ করার সাহস রাখে।

সাহসের সঙ্গে বিশ্বাস এবং ঝুঁকি গ্রহণের একটা যোগসাজশ আছে। আর বিশ্বাস ও ঝুঁকির আরেক নাম যে 'শাহরুখ খান' তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই।

১৯৯৪ সালে 'আপ কি আদালত' শোতে উপস্থাপক রজত শর্মা শাহরুখের কাছে একসঙ্গে ৪টির বেশি চলচ্চিত্র না করার কারণ জানতে চান। শাহরুখ স্মিত হেসে উত্তরে বলেন, 'আমার ৪ টি সিনেমা ৪০ টি সিনেমার সমান।'

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ ধরনের কথা হরহামেশাই শোনা যায় শাহরুখের মুখে। অনুপম খের শোতে এসে বলেই বসেন, 'আই অ্যাম দ্য লাস্ট অব দ্য স্টারস' (আমিই শেষ তারকা)। অনেকের কাছে শাহরুখের এমন বক্তব্য ঔদ্ধেত্যের সামিল কিন্তু শাহরুখের কাছে এটা তার বিশ্বাস। শাহরুখ বলেন, 'আমি নিজে যদি বিশ্বাস না করি তাহলে সকালে উঠে আমি কাজটি করবো কীভাবে!'

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

এই বিশ্বাস শাহরুখকে সাহস যোগায় ঝুঁকি গ্রহণের। তাই হয়তো ক্যারিয়ারের শুরু করেছেন নেতিবাবক চরিত্রে অভিনয় করার মাধ্যমে। 'ডর', 'বাজিগর' এর সিনেমা যেখানে অন্য অভিনেতারা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেসব সিনেমাই বেছে নিয়েছিলেন শাহরুখ। নেতিবাচক অথচ মূল নায়কের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি মুছে ফেলেছেন 'হিরো' শব্দের 'ইউটোপিয়া'। সাধারণ মানুষ মাত্রই যে হিরো হতে পারে এবং একজন হিরো বা নায়ক যে সাধারণ মানুষ বৈ ভিন্ন কিছু নয়, তা প্রমাণ করেছেন চলচ্চিত্র জগতে পা রেখেই। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন 'কিং অব রোমান্স'।

রোমান্সের বাদশা হয়ে তিনি ভালোবাসার মতো সূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমকে করেছেন বিস্তৃত। এই কৃতিত্ব শাহরুখের অভিনয়ের চেয়ে চলচ্চিত্র বাছাই করার বুদ্ধিমত্তার এবং পুরো হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র জগতের। তিনি সংস্কৃতির মধ্যস্থতাকারীও হয়ে ওঠেন। এর কৃতিত্ব অবশ্য তার অভিনীত চলচ্চিত্রের গল্পের পাশাপাশি তৎকালীন এলপিজি পলিসিরও।

১৯৯১ সালে ভারত সরকার এলপিজি (লিবারালাইজেশন, প্রাইভেটাইজেশন ও গ্লোবালাইজেশন) পলিসি গ্রহণ করে। ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী এগিয়ে নেওয়া ছিল এই পলিসির একটি মূখ্য উদ্দেশ্য। ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রচারে যুক্ত হলো নতুন মাত্রা।

এছাড়া, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটতে থাকল, পণ্যের বিজ্ঞাপন বাড়তে থাকল। এসবকিছুর মধ্যে ১৯৯২ সালে শাহরুখের অভিষেক হয় 'দিওয়ানা' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। অভিনয়ের মাধ্যমে শাহরুখ ভারতের সংস্কৃতি, দেশপ্রেম ফুটিয়ে তুললেন পর্দায়। ভারতীয় ডায়াস্পোরাদের মনে দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে শাহরুখও জায়গা করে নিলেন। শাহরুখ ছড়িয়ে পড়লেন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে, অভিনেতা হিসেবে যতটা, তারচেয়ে বরং সংস্কৃতির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

একইসাথে শাহরুখ একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হলেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন পণ্যের ব্র্যান্ড তাকে মুখপাত্র বানালো। বিজ্ঞাপনের জগতেও আধিপত্য বাড়তে থাকে শাহরুখের। যে তার চলচ্চিত্র দেখেনি, সেও কোনো না কোনো বিজ্ঞাপন দেখেছে এবং জেনেছে—কে এই শাহরুখ খান!

তবে শাহরুখকে ঘিরেও সমালোচনা রয়েছে। 'হিরোর চেহারা এমন হয় না', 'ওভার অ্যাক্টিং' ইত্যাদি সমালোচনায় প্রায়ই মিডিয়া পাড়ায় শোনা যায়। তবে, নিজ মুখে অকপটে সেসব কথা স্বীকার করে নেন শাহরুখ। আর এখানেই শাহরুখ অপ্রতিরোধ্য।

ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের আমলে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বিতর্কের পটভূমিতে বিজেপি নেতাদের প্রবল তোপের মুখেও নিজের মুকুট সগৌরবে ধরে রেখেছেন শাহরুখ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর রোষানলে পড়তে হয়েছে শাহরুখকে। এ বছর 'পাঠান' ছবির একটি গান, 'বেশরম রং' মুক্তির পর নায়িকা দীপিকা পাডুকোন "গেরুয়া রংয়ের ছোট পোশাক পরে একজন মুসলিম নায়কের সঙ্গে নেচেছেন এবং হিন্দুত্বের অবমাননা করেছেন" এমন আলোচনাও শুরু হয়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পাঠানের পোস্টার ছিঁড়ে, ভাঙচুর করে ও শাহরুখের ছবিতে লাথি মেরে প্রতিবাদ জানালেও বক্সঅফিসে বাজিমাত করে 'পাঠান'। প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্যে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে শাহরুখ খান 'থুথু ছিটিয়েছেন' এমন গুজবও উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেসময় শাহরুখ ভক্তরা সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করেন।  

বিশ্বাসের বিপরীতে অবিশ্বাস থাকে। ঝুঁকি নিলেই সফলতা নিশ্চিত হয় না। স্বপ্নবাজ মানুষ স্বপ্নাহতও হয়, কেউ উঠে দাঁড়ায় কেউ বা ব্যর্থতা মেনে নেয়। মানব চরিত্রের স্বাভাবিক দিক এগুলো। মানবিক গুণের অন্যতম ভালোবাসার মতো মহাসাগরীয় অনুভূতি তৈরি করতে পারা এবং অনুভব করানো।

এই সবকিছু ব্যক্তি শাহরুখের মধ্যে যেমন উপস্থিত তেমনি শাহরুখ যে চরিত্রগুলোয় অভিনয় করেছেন সেখানেও এসব উপাদান আছে। অর্থাৎ অভিনেতার ব্যক্তিত্ব এবং অভিনীত চরিত্রের মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই।

সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ব্যক্তিগত আমি এবং সামাজিক আমি, শাহরুখ সেই 'ব্যক্তিগত আমি' আর 'সামাজিক আমি'র ভেদাভেদ প্রায় শূন্যের কোঠায় আনতে সক্ষম হয়েছেন। একজন সাধারণ মানুষের কাছে অন্য মানুষ যেমন সহজগম্য, শাহরুখ নিজেকে যতটা সম্ভব তেমনভাবে গড়ে তুলেছেন।

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

অভিনয় তো সব অভিনেতাই করেন, কিন্তু অভিনয়ের বাইরে, চলচ্চিত্রের বাইরে চলচ্চিত্রের পোস্টার থেকে শুরু করে প্রমোশন, ভক্তদের সামনে নিজের উপস্থিতি সব মিলিয়ে মানুষের হৃদয়ে কম্পন যদি কেউ তুলে থাকেন, তিনি বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান।

অনুপম খের তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, এই খ্যাতির পেছনে কী কারণ? শাহরুখ বলেন, 'কঠোর পরিশ্রম।' অনুপম পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন, 'কঠোর পরিশ্রম তো আমরা সবাই করি!' জবাবে দৃপ্ত কণ্ঠে শাহরুখ বলেন, '(প্রতিষ্ঠিত) হবার জন্য পরিশ্রম আমরা সবাই করি, কিন্তু হয়ে যাবার পরে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। আমি (প্রতিষ্ঠিত) হবার পরে বেশি পরিশ্রম করেছি, এখনও করি।'

শাহরুখ খান। ছবি: সংগৃহীত

একজন সাধারণ মানুষ যা করতে পারে এবং যা পারে না, সবটাই রুপালি পর্দায় দেখে আনন্দিত হয়। এর সবটাই পূরণ করেছেন শাহরুখ, তিনি এমনই এক নির্মল বিনোদনকারী। কবি সৈয়দ শামসুল হক রচিত 'তারে কই বড় বাজিকর, যে তার রুমাল নাড়ে পরাণের গহীন ভিতর' লাইনটি যেন তার জন্যই।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago