এক্স-রে পরীক্ষায় উন্মোচিত মোনালিসার ভেতরের রহস্য

মোনালিসা
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা। ছবি: সংগৃহীত

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জগৎবিখ্যাত চিত্রকর্ম মোনালিসা নিয়ে চমকপ্রদ নতুন তথ্য পাওয়া গেছে এক্স-রে পরীক্ষায়। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের রাসায়নিক পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, এ শিল্পকর্মে প্রথম স্তরের রং বা বেজ কোট হিসেবে 'হানি গোল্ড' রং ব্যবহৃত হয়েছে।

'সিনক্রোট্রোন এক্স-রে ডিফ্র‍্যাকশন' কৌশল ব্যবহার করে মোনালিসার ক্ষুদ্র অংশের আণবিক গঠনের সঙ্গে মিলিয়ে এই রহস্য উন্মোচন করা হয়েছে।

পরীক্ষায় যে রাসায়নিক চিহ্ন পাওয়া গেছে তা মোনালিসার জন্য একেবারে নতুন। ছবির ভেতরের স্তরে ভিঞ্চি কমলা বর্ণের লেড অক্সাইড পাউডার ও শণবীজ কিংবা বাদামের তেল ব্যবহার করেছিলেন বলেই মত দিয়েছেন গবেষকরা।

'প্লামবোনাক্রাইট' নামের এই বস্তুটি সতেরো শতকে ডাচ বা ওলন্দাজ গাড়ি প্রস্তুতকারকরা ব্যবহার করতেন। এটি এক ধরনের 'কালার প্রিজারভেটিভ' হিসেবে ব্যবহৃত হতো। লাল ও কমলা রঙে স্পোর্টস কারগুলোকে আরও আকর্ষণীয় দেখাত।

গবেষক দলের প্রধান ভিক্টর গনজালেস বলছেন, 'ভিঞ্চি পরীক্ষা চালাতে পছন্দ করতেন। তার সব ছবিই কৌশলের দিক থেকে আলাদা।'

ভিঞ্চির আঁকা ভুবনমোহিনী 'মোনালিসা' দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় সেই হাসি ধরে রেখেছে মুখে। এর আড়ালে আরও অনেক কিছু হয়ত আছে, যা এখনো সামনে আসেনি।

সিএনআরএসের রসায়নবিদ ভিক্টর এপিকে জানান, 'এটা খুব চমকপ্রদ ব্যাপার যে, মোনালিসার ভিত্তি স্তরে সুনির্দিষ্ট কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে।'

এই দুষ্প্রাপ্য উপাদান 'প্লামবোনাক্রাইট' আবিষ্কৃত হয় পপলার কাঠের ওপরের স্তরে। এই কাঠের ওপরই ছবিটি এঁকেছিলেন ভিঞ্চি।

অনেক আগে থেকেই শিল্পবোদ্ধা ও ইতিহাসবিদরা অনুমান করে এসেছেন, ভিঞ্চি হয়ত তার ছবির ঘনত্ব বাড়াতে ও সহজে রং শুকোতে লেড অক্সাইড ব্যবহার করেছেন। এই অনুমান সত্য বলে জানাচ্ছেন ভিক্টর। বর্তমানে প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে কাঁচ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে মোনালিসাকে।

ভিক্টর গনজালেস ভিঞ্চির আরও অনেক কাজের রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করেছেন। ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ডট ও অন্যান্য শিল্পীদের নিয়েও কাজ করেছেন তিনি।

তার এই গবেষণা জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটিতে গত বুধবার প্রকাশিত হয়।

গবেষকরা মনে করছেন, ভিঞ্চির মতো এক পণ্ডিত, কৌতূহলী ও উদ্ভাবন শক্তিসম্পন্ন শিল্পী এই কাজটির ক্ষেত্রেও বেশ নিরীক্ষাপ্রবণ ছিলেন।

নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের কিউরেটর ও ইতালিয়ান শিল্পবোদ্ধা কারমেন বামবাখের মতে গবেষণাটি খুব চমকপ্রদ।

ভিঞ্চির এই অমর চিত্রকর্ম ও এর কৌশলগত দিক সম্পর্কে যেকোনো নতুন তথ্য ও প্রমাণ গোটা বিশ্বের শিল্পজগত ও অন্যান্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বামবাখ।

তার মতে, 'মোনালিসায় প্লামবোনাক্রাইটের  ব্যবহার লিওনার্দোর নিরবচ্ছিন্ন নিরীক্ষাপ্রবণতা ও শিল্পানুরাগের প্রমাণ। এটি তাকে কালোত্তীর্ণ ও আধুনিক করেছে।'

প্রতিবছর ল্যুভর মিউজিয়ামে এটি দেখতে ৭৫ লাখ দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার পর্যটক 'মোনালিসা'কে দেখে।

তবে এই ছবিটি তার ভিত্তি স্তর থেকে পৃথক। গনজালেসের বিশ্লেষণ বলছে, সাদা চোখে এই ব্যাপারটা ধরা যায় না। মানুষের একটি চুলের চেয়ে বেশি নয় এই ভিত্তি স্তরের দৈর্ঘ্য।

'সিনক্রোটন' নামে বড় এক যন্ত্রে কণাগুলোকে আলোর প্রায় কাছাকাছি বেগে ছুটিয়ে এক্স-রে'র মাধ্যমে এর আণবিক গঠন পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে তাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে এর রাসায়নিক দিক।

প্লামবোনাক্রাইট লেড অক্সাইডের একটি উপজাত। তাই গবেষকেরা নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারছেন, লিওনার্দো লেড বা সীসার পাউডার ব্যবহার করেছিলেন ছবিতে।

গনজালেসের মতে, 'প্লামবোনাক্রাইট তার নির্মাণ শৈলীতে আঙুলের ছাপের মতো। এবারই আমরা রাসায়নিকভাবে ব্যাপারটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলাম।'

লিওনার্দোর পর সতেরো শতকের ডাচ চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ডট একই ধরনের অঙ্কনশৈলী ব্যবহার করেছিলেন তার ছবিতে। গনজালেস ও অন্যান্য গবেষকরা তার ছবিতেও প্লামবোনাক্রাইটের অস্তিত্ব পেয়েছেন।

'এতে আমরা বুঝতে পারলাম এই অঙ্কনশৈলী শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে টিকে ছিল। এটি খুব উন্নত অঙ্কনশৈলী ছিল,' বলেন গনজালেস।

যতদূর জানা যায়, লিওনার্দো লেড অক্সাইড পাউডারকে মেশাতেন শণবীজ বা বাদামের তেলে। এতে কমলা রং বের হতো। এরপর এই মিশ্রণটি জ্বাল দিয়ে আরও ঘন ও দ্রুত শুকানো সম্ভব এমন রং তৈরি করতেন।

গনজালেসের মতে, 'এজন্য যা প্রয়োজন ছিল তা হলো চমৎকার সোনালি বর্ণের তেল, এটি অনেকটা মধুর মতো করে বইত।'

ল্যুভর মিউজিয়াম জানাচ্ছে, মোনালিসার এই নারী আসলে লিসা ঘেরারদিনি। তিনি ছিলেন ফ্লোরেন্সের এক রেশম ব্যবসায়ীর স্ত্রী। লিওনার্দোর অন্যান্য কাজগুলোতেও রয়েছে এমন অনেক রহস্যময় ব্যাপার।

ভিক্টর গনজালেস বলছেন, 'অবশ্যই আবিষ্কারের আরও অনেক অনেক কিছু আছে। আমরা শুধু ভাসা ভাসা কিছু নাড়াচাড়া করছি। এটা অনেকটা জ্ঞানের দেয়ালে নতুন একটি ইট যোগ করার মতো।'

তথ্যসূত্র: ডেইলি মেইল

গ্রন্থনা: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

6h ago