মুক্তিযুদ্ধ

ক্র্যাক প্লাটুন: ঢাকায় মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিলেন যারা

মুক্তিযুদ্ধের পরে ঢাকার একটি স্টুডিওতে ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলারা। ছবি: সংগৃহীত

৯ জুন ১৯৭১, বুধবার। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। গুলশান ১ নম্বরের গোলচত্বর থেকে ডাটসুন ১০০০ মডেলের একটি গাড়ি ছিনতাই করে গাড়িতে চেপে বসলেন ৬ জন গেরিলা। গন্তব্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন শহীদুল্লাহ খান বাদল। চালকের পাশে বসেছেন কামরুল হক স্বপন ও মাসুদ সাদেক চুল্লু। পেছনের আসনে হাবিবুল আলম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও জিয়াউদ্দিন আলী আহমদ। তাদের প্রত্যেকের হাতে তিনটি করে গ্রেনেড।

গেরিলারা আগে থেকেই জানতেন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন সহ বিশ্বব্যাংক এবং অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠেছেন। ত্রিপুরার মেলাঘরেই গেরিলাদের বলা হয়েছিল, `হানাদাররা সাহায্যদাতা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে, ঢাকা শহর পুরোপুরি শান্ত। এখানে যুদ্ধের লেশমাত্রও নেই। তোমাদের কাজ হবে রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে দূরবর্তী স্থানে তথা সদরঘাট অথবা কমলাপুর স্টেশনের দিকে প্রতিদিন চার-পাঁচটা করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো।'

সন্ধ্যা ৭টার দিকে গেরিলারা ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছে গাড়ি থামালেন। ঠিক এ সময়ই প্রতিনিধিদলের দুটি বাসও হোটেলে প্রবেশ করে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের প্রবেশমুখটি ছিল রিভলভিং, যার ফলে দুজনের বেশি একসঙ্গে ঢোকা সম্ভব ছিল না। গাড়ি থেকে চটজলদি নেমেই মুহূর্তের মধ্যে হোটেলের পাশের দুটি বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়েন গেরিলা মায়া ও আলম। তারপর বাসগুলো সরতেই গেরিলারা দেখলেন, হোটেলের প্রবেশমুখে লোকের ভিড়। তৎক্ষণাৎ গ্রেনেডের পিন খুলে মায়া ও আলম দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন।

দু্ই-তিন সেকেন্ড পর ফের দুটি গ্রেনেড ছুড়েই গাড়ির দিকে ছোটেন তারা। গাড়ি চালুই ছিল। গাড়িতে বসেই গেরিলারা দেখলেন, চারটি গ্রেনেড বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়েছে। একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে প্রাণ বাঁচাতে পড়িমরি চেষ্টা- দুয়ে মিলে ভারী হয়ে উঠল পুরো হোটেলটির পরিবেশ।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দুই-একদিনের মধ্যে গেরিলারা। ছবিতে ক্র্যাক প্লাটুনের দুই সহযোদ্ধার সঙ্গে গেরিলা আবু ফজল মোহাম্মদ মানু (মাঝে)

হোটেলের পাশ থেকে গাড়ি ছুটিয়ে সোজা মগবাজারে চলে এলেন গেরিলারা। মগবাজারেই এক বাড়িতে তখন চলছিল শান্তি কমিটির বৈঠক। গেরিলারা বাইরে থেকে তিনটি গ্রেনেড ছুড়েই চলে যান দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে। চলন্ত অবস্থায় দুটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে গাড়ি ফেলে পালান গেরিলারা।

সেদিন রাতেই বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হলো, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভয়াবহ গেরিলা হামলায় ৮-৯ জন মারা গেছেন এবং ৩০-৩৫ জন গুরুতর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

রেডিওতে আক্রমণের খবর শুনে মেজর খালেদ মোশাররফ লাফিয়ে উঠে ক্যাপ্টেন আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারকে বললেন, 'দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল। ওদের আমি বললাম হোটেল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে আক্রমণ কর। শুধু বিস্ফোরণের শব্দ যেন ওদের কানে যায়। অথচ ওরা করল কী দেখ! হোটেলের ভেতর ঢুকেই কি না গ্রেনেড ব্লাস্ট করল।'

মেজর খালেদ মোশাররফের এই উক্তি ছড়িয়ে গেল। ঢাকা প্লাটুন তথা ৩ নম্বর প্লাটুনের নাম মুখে মুখেই ছড়িয়ে গেল 'ক্র্যাক প্লাটুন' হিসেবে।

মে মাসের শেষ ও জুনের প্রথম সপ্তাহ

মে মাসে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশনায় ও ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ত্রিপুরার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল একদল তরুণ ও কিশোরকে। আরবান গেরিলাযুদ্ধের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া এই প্রশিক্ষণার্থীরা প্রত্যেকেই ঢাকা শহরকে হাতের তালুর মতো চিনতেন। তাদের মূল লক্ষ্য 'হিট অ্যান্ড রান'।

৩ জুন ত্রিপুরার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ১৭ জন তরুণ ও কিশোরের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ এই দলটি। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিল ১২টি গ্রেনেড, ১৬০ রুপি এবং প্রত্যেকের একটি করে বেয়নেট। ৫ জুন গেরিলা দলটি ঢাকায় পৌঁছায়।

মুক্তিযুদ্ধের কোনো এক সময় ক্র্যাক প্লাটুন তথা ঢাকা প্লাটুনের সদস্যরা শলাপরামর্শে মগ্ন। ছবি: সংগৃহীত

৯ জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দুর্ধর্ষ অপারেশন চালান ক্র্যাক প্লাটুনের ৬ জন গেরিলা। এরপর একে একে ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসিক গেরিলারা একে একে পরিচালনা করেন অসংখ্য অপারেশন। একের পর এক গেরিলা আক্রমণ ও আচমকা অপারেশনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

পাকিস্তানি সেনাদের মনে ভয় ঢুকে যায়। কারণ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মতো দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ও কড়া নিরাপত্তা ভেদ করে গেরিলা আক্রমণ ছিল রীতিমতো দুঃসাধ্য কাজ। অথচ সেখানেই তিন দফা গেরিলা আক্রমণ। অন্যদিকে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের ছাদ থেকে মেশিনগান দিয়ে সদা পর্যবেক্ষণ করায় ফার্মগেট চেকপোস্ট ছিল ঢাকার সবচেয়ে নিরাপদ চেকপোস্টগুলোর মধ্যে একটি। সেখানেও হয়েছে গেরিলা আক্রমণ।

সবশেষ ধানমন্ডি ২০ নম্বর সড়কের চীনা দূতাবাস ও ১৮ নম্বর সড়কের বিচারপতি আবদুল জব্বার খানের বাসার সামনে অবস্থানরত সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যার ঘটনা রীতিমতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাতের ঘুম নষ্ট করে ছাড়ে।

এক পর্যায়ে এই গেরিলাদের ধরতে চিরুনি অভিযানে নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। বাড়ি বাড়ি চালানো হয় তল্লাশি। চতুর্দিকে চালানো হয় সাঁড়াশি অভিযান। একইসঙ্গে চলে গোয়েন্দা তৎপরতা। পাকিস্তানপন্থীদের দেওয়া হয় নানা পুরস্কারের টোপ। এরপরই ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা বদিউল আলমের বিষয়ে হানাদারদের কাছে তথ্য ফাঁস করেন বদির বন্ধু এনএসএফ কর্মী ফরিদ।

২৯ ও ৩০ আগস্ট, ১৯৭১

২৯ আগস্ট, ১১টা। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিনের বাসায় বসে ফরিদ, জাফর এবং পারভেজ হাসানের সঙ্গে তাস খেলছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা বদিউল আলম বদি। খেলার মাঝেমাঝে ফরিদের উঁকিঝুঁকি দেখতে পেয়ে বদির খানিকটা খুঁতখুঁত লাগছিল। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল বাড়িটি ঘেরাও করে। বদি বিষয়টি বুঝতে পেরে জানালা দিয়ে টপকে পালাতে গিয়েও ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সেনারা সেই আসর থেকে কেবল বদিকেই তুলে নিয়ে যায়।

ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা লিনু বিল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের তথ্য পাচারের বিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জালাল উদ্দিনের ছেলে এনএসএফ কর্মী ফরিদ দায়ী।'

আটকের পর বদিকে নিয়ে যাওয়া হয় নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন করা হলেও সহযোদ্ধাদের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি তিনি।

ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলা আরিফ আজিজসহ কয়েকজন গেরিলা। ছবি কৃতজ্ঞতা: আবিদ আজিজ।

অন্যদিকে ফরিদের দেওয়া গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এদিন রাতে ইস্কাটনের বাসা থেকে পাকিস্তানি সেনারা তুলে নেয় আবদুস সামাদকে। একইসঙ্গে তুলে নেওয়া হয় তার স্ত্রী, শিশুকন্যাকেও। টর্চার সেলে নির্যাতনের সময় প্রস্তাব দেওয়া হয়, যদি তিনি সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেন তাহলে তাকে স্ত্রী ও শিশুকন্যাসহ ছেড়ে দেওয়া হবে, নয়তো সবাইকেই হত্যা করা হবে। এক পর্যায়ে সবকিছু স্বীকার করতে বাধ্য হন আবদুস সামাদ।

সামাদের দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এদিন রাত ২টায় আজাদ, জুয়েল এবং কাজী কামালকে ধরতে মগবাজারের বাড়িতে অভিযান চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। অভিযানের শুরুতে কাজী কামাল হানাদারদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যেতে পারলেও আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকান্দার ও মনোয়ারকে আটক করে হানাদার বাহিনী।

একই রাতে এলিফ্যান্ট রোডের 'কণিকা' বাড়ি থেকে আটক করা হয় শাফী ইমাম রুমী, সাইফ ইমাম জামি, শরীফ ইমামসহ বাড়ির সব পুরুষ সদস্যকে। এলিফ্যান্ট রোডের ১ নম্বর ট্যানামেন্ট হাউস বাড়ি থেকে আটক হন গেরিলা মাসুদ সাদেক চুল্লু, পুরনো পল্টনের একটি বাসা থেকে আজিজুস সামাদ, মালিবাগের বাসা থেকে শামসুল হক, ফার্মগেট থেকে ধরা পড়েন আবুল বাসার।

৩০ আগস্ট ভোরের কয়েক ঘণ্টা আগে ইস্কাটনের বাসা থেকে আটক করা হয় সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে। এ সময় বাড়ি থেকে প্রচুর গোলাবারুদের সন্ধান পায় হানাদাররা। এদিন ভোরে রাজারবাগের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে আটক করা হয় সুরকার আলতাফ মাহমুদ, গেরিলা আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ মোট ৬ জনকে।

২৯ আগস্ট রাতে গেরিলাদের ধরতে ঢাকায় মোট ৪৪টি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আটক করা হয়েছিল ৩০ জনের মতো গেরিলা ও গেরিলাদের স্বজনকে। আটকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন মিলিটারি টর্চার সেলে। এখানে দুটি ভবনের টর্চার সেলে আটক গেরিলাদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়।

কিন্তু শত নির্যাতন সয়েও সহযোদ্ধাদের বিষয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ করেননি গেরিলারা। পরে বেশ কয়েকজন গেরিলা টর্চার সেল থেকে ফিরে আসতে পারলেও ফিরে আসেননি ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি, রুমী, আজাদ, জুয়েল, হাফিজ, আলতাফ মাহমুদ, বকর, বাশার, বাসার, বাকী ও সেকান্দার হায়াত খান। তাদেরকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ক্র্যাক প্লাটুনের দ্বিতীয় পর্ব

২৯ ও ৩০ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও ক্র্যাক প্লাটুনের কার্যক্রম কখনোই বন্ধ হয়নি। বরং পাকিস্তানি সেনাদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে গেছেন দুঃসাহসিক গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর প্রথমদিকে অপারেশন তেমন চোখে না পড়লেও কিছুদিনের ব্যবধানেই মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও কয়েকজন গেরিলা ঢাকায় আসেন। এরপর প্রথম পর্যায়ের গেরিলাসহ আরও গেরিলা নিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের অপারেশন আবারও পরিচালিত হয়।

এই পর্বে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী, গোপীবাগ, দক্ষিণ ও উত্তরখান, মাদারটেক, গেন্ডারিয়া, বাসাবো, বাড্ডায় অসংখ্য অপারেশন করেন।

একাত্তরের ডিসেম্বরে ক্র্যাকপ্লাটুনের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে গেরিলারা সাভার রেডিও স্টেশন থেকে মানিকগঞ্জের বড়াল ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৪০০ ছেলেকে কাজে লাগিয়ে ৩১৯ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন।

বেশকিছু অপারেশনের পর গেরিলাদের ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেন পাকিস্তানি সেনাদের সমস্ত রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ঢাকা শহরে থাকা হানাদারদের সব ঘাঁটি ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হয়।

তখন গেরিলারা কাকরাইল মোড়ের পেট্রোল পাম্প ধ্বংস করেন। অক্টোবরের প্রথম দিকে গেরিলারা সাভার রেডিও স্টেশনের সামনে হানাদারদের ৩টি লরি আক্রমণ করে ৩৭ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন।

২৮ অক্টোবর ডিআইটি ভবনে অপারেশন চালিয়ে ভবনের চূড়ার কিছু অংশ ধ্বংস করেন মাহবুব আলীসহ কয়েকজন গেরিলা। সমসাময়িক সময়ে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে অপারেশন চালিয়ে শিমুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য অর্থ জোগাড় করেন গেরিলারা।

নভেম্বরের দিকে ঢাকা শহরে হানাদারদের নির্যাতন বৃদ্ধি পেলে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা হানাদারদের ওপর সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় ছিনতাই করা একটি গাড়িতে বিস্ফোরক লাগান গেরিলারা। পরে বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে পার্ক করা পাকিস্তানিদের দুটি লরির মাঝে বিস্ফোরকসহ গাড়িটি রেখে অগ্নিসংযোগ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার অপারেশন বাইতুল মোকাররমে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এদিন দুপুর ৩টার খবরে বিবিসি তা প্রচার করে।

নভেম্বরে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধের জন্য বিস্ফোরক বসান। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। এই অপারেশনের কয়েকদিন পর মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের পাশে রেললাইন উড়াতে গেলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে গেরিলাদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনাদের একটি সেকশন পুরোপুরি বিনষ্ট হয়। এর কয়েকদিনের ব্যবধানেই গেরিলারা শাহবাগের রেডিও অফিসে রেইড চালান। এ সময় বেশ কয়েকজন পাহারারত পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১১ ডিসেম্বর ঢাকায় আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ইউসিস (ইউএসআইএস) ভবনে দুর্দান্ত সফল অপারেশন চালান ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা। একই সময় গুল টেক্সটাইল মিলের শত্রু বাঙ্কারে হামলা করেন গেরিলারা। এই হামলায় ২৭ জন পাকিস্তানি সেনার মরদেহ খুঁজে পান গেরিলারা।

১৩ ডিসেম্বর রূপগঞ্জে মেজর হায়দারের সঙ্গে এস ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল শফিউল্লাহর দেখা হয়। কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর হায়দারকে জিজ্ঞেস করেন, 'হায়দার, তোমার ছেলেরা এখানে এভাবে ঘোরাফেরা করছে কেন?' জবাবে মেজর হায়দার বলেন, 'স্যার এরা ৯ মাস ধরে এখানেই আছে। এদের সব চেনা।'

এ কথার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, গণমানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করেছেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা। পাকিস্তানি সেনারা কদাচিতই তাদের দেখতে পেয়েছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই অপারেশন চালিয়ে ফের হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন তারা।

ক্র্যাক প্লাটুনের আশ্রয়স্থল সেসব বাড়ি

ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের প্রধান আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি বাড়ি। এসব বাড়িতেই গেরিলারা যেমন আশ্রয় নিতেন, ঠিক তেমনি তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ মজুদ রাখতেন। কোনো কোনো বাড়ি ছিল গেরিলাদের যোগাযোগকেন্দ্র। ক্র্যাক প্লাটুনের ইতিহাসের একটি বড় অংশজুড়ে থাকবে এসব বাড়ি। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সেসব স্থাপনার বেশিরভাগই মুছে গেছে। সেসব গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোর কয়েকটির তালিকা এখানে দেওয়া হলো-

মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর মতিঝিল এলাকার ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলাযোদ্ধাদের একটি তালিকা। ছবি কৃতজ্ঞতা: আবিদ আজিজ

২/১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড/ গেরিলা আজিজুস সামাদের বাড়ি , ৩০ হাটখোলা রোড/ গেরিলা শাহাদাত চৌধুরীদের বাড়ি, ১৯/ হাটখোলা রোড, ৭ নম্বর ভগবতী ব্যানার্জী রোড, ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোড রাজারবাগ/ শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাড়ি, ১/৩ দিলু রোড/ গেরিলা হাবিবুল আলমের বাড়ি, ১ নম্বর ট্যানামেন্ট হাউজ এলিফ্যান্ট রোড/গেরিলা মাসুদ সাদেক চুল্লুর বাড়ি, কণিকা ৩৫৫/এলিফ্যান্ট রোড/জাহানারা ইমামদের বাড়ি, ২৮ মগবাজার/শহীদ আজাদদের ভাড়া বাড়ি, ৪১৫ মগবাজার ঢাকা নিয়ন সাইন/ গেরিলা সামাদের বাড়ি, ২০ নিউ ইস্কাটন/শহীদ হাফিজের ভাড়া বাড়ি, ১ নম্বর ভগবতী ব্যানার্জী রোড/প্রকৌশলী নজরুল ইসলামের বাড়ি, ধানমন্ডি ২৮ নম্বরের দিলারা হাশেমের বাড়ি। এ ছাড়া কবি সুফিয়া কামালের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সাঁঝের মায়া বাড়িটিও ছিল গেরিলাদের অন্যতম যোগাযোগকেন্দ্র।

২৯ ও ৩০ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ কয়েকজন গেরিলা ধরা পড়ার পর ঢাকায় গেরিলাদের ২১টি দুর্গের পতন হয়।

কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে আবার সংগঠিত হলে ঢাকার একাধিক বাড়িতে গড়ে উঠে গেরিলাদের আশ্রয়স্থল। এসব বাড়ি থেকে একাধিক গেরিলা অপারেশন পরিচালিত হয়। নওরুন কলোনির জলিদের বাড়ি থেকে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক অপারেশন, লালবাগের বাড়ি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার সমস্ত স্কুল অপারেশন। মালিবাগের ফেরদৌস নাজমীদের বাড়ি থেকে মালিবাগ রেললাইন অপারেশন, নয়াপল্টনের বাড়ি থেকে বায়তুল মোকাররম এবং ডিআইটি টাওয়ার অপারেশন। এ ছাড়া ৩৫০ টাকায় চানকুঠির নামের একটি বাড়িভাড়া নিয়ে সে বাড়ি থেকে পুরাতন বিমানবন্দর, মোনায়েম খান ও কল্যাণপুর রেডিও স্টেশন অপারেশন চালিয়েছিলেন গেরিলারা। কলাবাগানের বজলুদের বাড়ি এবং তৎকালীন মুসলিম হোটেলের পেছনের একটি মেস থেকে পরিচালিত হয়েছিল একাধিক অপারেশন। এ ছাড়া ধানমন্ডি ২৭ এর আরিফদের বাড়ি ছিল ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম অস্ত্রাগার। ১১ বি ধানমন্ডির নুরুল রহমানের বাড়ি, ফকিরাপুলের ১৬২ নম্বরের দিলুদের বাড়িটিও ছিল গেরিলাদের আশ্রয়স্থল।

পত্রিকার নাম 'গেরিলা'

গেরিলা আক্রমণের পাশাপাশি ক্র্যাক প্লাটুনের কয়েকজন সদস্যকে ঢাকা শহরের গেরিলা তৎপরতা প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেন ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশিরা লড়াইয়ের বিষয়ে জানতে পারেন। বেশ কয়েকজন গেরিলা এ সময় সেগুনবাগিচা হাইস্কুল থেকে একটি সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিনিয়ে এনে গেরিলা নামের একটি ইংরেজি পত্রিকা বের করেন। প্রতি মাসে পত্রিকাটির দুটি করে মোট সাতটি সংখ্যা বের হয়েছিল। এসব সংখ্যায় যুদ্ধের খবরাখবর লেখা থাকত। গেরিলারা পত্রিকাটি গোপনে ঢাকার বিভিন্ন বিদেশি সংস্থায় পাঠিয়ে দিতেন।

১১ ডিসেম্বর ইউসিস আমেরিকান সেন্টারে হামলার পরদিন ১২ ডিসেম্বর ইউসিস ভবনের তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত

ক্র্যাকপ্লাটুনের উল্লেখযোগ্য অপারেশন

অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (তিন দফা)

অপারেশন গ্যানিজ পেট্রোল পাম্প

অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প

অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন

অপারেশন জর্দার টিন

অপারেশন ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার

অপারেশন ফার্মগেট,

অপারেশন আসাদ গেট (মাইন বিস্ফোরণ)

অপারেশন দোয়েল চত্বর (মাইন বিস্ফোরণ)

অপারেশন গ্রীণ রোড (মাইন বিস্ফোরণ)

অপারেশন সাইন্সল্যাব (মাইন বিস্ফোরণ)

অপারেশন কমলাপুর রেলস্টেশন

অপারেশন অ্যাটাক অন দ্য মুভ

অপারেশন ডেস্টিনেশন আননোন

অপারেশন ওয়াপদা পাওয়ার হাউস

অপারেশন ফ্লাইং ফ্ল্যাগস

অপারেশন মুসলিম ব্যাংক

অপারেশন ডিআইটি ভবন

অপারেশন বাইতুল মোকাররম

অপারেশন ঢাকা রেডিও

অপারেশন মালিবাগ রেলক্রসিং

অপারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অপারেশন ইউসিস ভবনসহ (আমেরিকান সেন্টার) নাম না জানা অসংখ্য অপারেশন

 

ক্র্যাকপ্লাটুনের দুঃসাহসিক সদস্যরা

শহীদ বদিউল আলম বদি, বীর বিক্রম

শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ, বীর বিক্রম

 শহীদ শাফী ইমাম রুমী, বীর বিক্রম

শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর বিক্রম

শহীদ আবু বকর, বীর বিক্রম

শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান

 শহীদ আলতাফ মাহমুদ

শহীদ সেকান্দর হায়াত খান

শহীদ আবদুল্লাহ-হেল-বাকী

মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম

কাজী কামাল উদ্দিন, বীর বিক্রম

কামরুল হক স্বপন, বীর বিক্রম

হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক

আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন বীর প্রতীক

আব্দুস সামাদ, বীর প্রতীক

 মোহাম্মদ তৈয়ব আলী, বীর প্রতীক

গোলাম দস্তগির গাজী, বীর প্রতীক

শাহাদাৎ চৌধুরী

সাদেক হোসেন খোকা

মাসুদ সাদেক চুল্লু

ইশতিয়াক আজিজ উলফাত

আবু সাইয়িদ খান

ফতেহ আলী চৌধুরী

আহমেদ মুনির ভাষণ

শহীদুলাহ খান বাদল

প্রকৌশলী সিরাজ ভুঁইয়া

খালেদ আহমেদ

এএফএমএ হ্যারিস

মাহবুব আহমেদ শহীদ

ড. তারেক মাহফুজ

হিউবার্ট রোজারিও

আবুল ফজল সিদ্দিক মনু

মোস্তফা কামাল বকুল

আবুল বারাক আলভী

লিনু বিল্লাহ

আকরাম হোসেন মল্লিক ভুলু

ইশতিয়াক আজিজ

মুজিবর রহমান

আনোয়ার রহমান আনু

মেসবাহ জাগিরদার

প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

রাইসুল ইসলাম আসাদ

আজম খান

এমএ ম্যাক খান

নাজিবুল হক

মাহফুজুর রহমান আমান

 ড. মেজবাহ উদ্দিন হাসমি

ওয়ালী মোহাম্মদ

মকবুল-ই- ইলাহী চৌধুরী

জহির উদ্দিন জালাল

সামসুজ্জামান ফরহাদ

মোহাম্মদ হানিফ

ইফতেখার আলম টুটুল

ইফতিখার ইসলাম ইফতি

ফজলে রব

আব্দুল্লাহ আল হেলাল

শামসুল আলম খান

নাজিম উদ্দিন

আব্দুল কুদ্দুস

মাসুদুর রহমান তারেক

কাজী রেজাউল কবির

মোমিনুল হাসান

নুরুল হক বাবুল

মোনোয়ার হোসেন মানিক

জহিরুল ইসলাম

আগা হোসেন শরিফ

আমিনুল ইসলাম নসু

ক্যাপ্টেন কাসেম আনসারি

নাজিবুল হক সরদার

সামসুজ্জামান তৈমুর

হাফিজুর রহমান হারুন

হেলাল উদ্দিন

হুমায়ুন কবির

মাশুক আহমেদ

কামাল আহমেদ

মোহাম্মদ ইকবাল ইকু

মোজাফফর আলী রুপু,

আবু জাফর ওসমান

মোবাশ্বের হোসেন

 ইফতেখারুল ইসলাম আসাদ (মিরজু)

 কেয়ার কাশী আনসারী (কাশেম)

 আবু মুসা আবদুল হালিম

 আরিফ আজিজ আরিফ

 মাশরুকুল হক মাশরুক

 মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল

 নাজিম বক্স, মোর্শেদ

 নুরুল আলম ভূঁইয়া সানু

 শাহনেওয়াজ আলী বিদ্যুৎ

 শাহরুখ আলী খান

 সমীর উদ্দিন সমু

সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা

 আবু তাহের

জিয়াউল হক বাবু প্রমুখ।

ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগ সদস্যের পূর্ণ নাম সংগ্রহ করা গেলেও বেশকিছু গেরিলার মূল নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে তাদের ডাকনাম পাওয়া গেছে। যাদের মূল নাম সংগ্রহ করা যায়নি তারা হলেন-

ইফতেখার, রুপু, রেজা, নিলু ১ এবং নিলু ২, আতিক, জিন্নাহ, অপু, মুকুট, মাযহার, মোক্তার (তাঁতী), কমলাপুর স্টেশনের কুলি সর্দার রশিদ, টারজান, মতিন ১, মতিন ২, মতিন ৩, জব্বার, মোহন, ওয়াসেফ, পুলু, শহীদ, আতিক, শরীফ।

তথ্যসূত্র:

ব্রেভ অব হার্ট/ হাবিবুল আলম বীর প্রতীক

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র নবম খণ্ড

৭১ এ ঢাকার কয়েকটি দুর্গঃ মনটি রহমান/ সাপ্তাহিক বিচিত্রা

(ক্র্যাক প্লাটুনের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বারাক আলভী, লিনু বিল্লাহ, ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, নাসির উদ্দিন ইউসুফ ও জহির উদ্দিন জালাল নামগুলো তালিকাভুক্ত করতে এই প্রতিবেদককে সাহায্য করেছেন।)

 

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago