চিকিৎসাসেবা দিয়ে যারা নিরবে অবদান রেখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে

মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসা
বাংলাদেশ হাসপাতাল। ছবি: সংগৃহীত

হরিমন দাস। এই পল্লী চিকিৎসক ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষের কাছে দেবদূত হয়ে উঠেছিলেন। এর একটি বড় উদাহরণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাণীগ্রাম গণহত্যা।

১৯ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর করা বাণীগ্রাম গণহত্যায় শহীদ হন ২২ জন গ্রামবাসী। গণহত্যায় শরীরে তিনটি গুলিবিদ্ধ হলেও হরিমনের তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় বেঁচে যান গ্রামের বাসিন্দা সুকুমার চৌধুরী। পরে আরও তিন দশক জীবিত ছিলেন সুকুমার। হরিমন দাস মারা গেছেন আশির দশকে।

মুক্তিযুদ্ধে চিকিৎসকদের অবদান নিয়ে এই প্রতিবেদনের কাজে চলতি বছরের অক্টোবর মাসে দ্য ডেইলি স্টারের এই প্রতিবেদক চট্টগ্রামে যান। এ সময় চট্টগ্রামের একাধিক চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা হয়। তাদেরই একজন বাণীগ্রাম গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সোমেন মিত্র চৌধুরী।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'মিলিটারি চলে গেলেও আবার আসতে পারে, এই ভয়ে কেউ যায়নি। হরিমন ডাক্তার সবার আগে গিয়ে সুকুমার চৌধুরীর শরীর থেকে তিনটি বুলেট বের করে সেলাই করে দিয়েছিলেন। হরিমন না গেলে সেদিন সুকুমার চৌধুরী হয়তো বাঁচতেন না।'

শুধু সুকুমার চৌধুরীই নন, এ সময় হরিমন দাস গোপনে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধারও চিকিৎসা দিয়েছিলেন বলে জানান গ্রামবাসী।

মুক্তিযুদ্ধে হরিমন দাসের মতো এমন আরও অনেক চিকিৎসক ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অনেক চিকিৎসক অবরুদ্ধ দেশে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে যেমন ছিলেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, তেমনই ছিলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতাল ও চার্চের চিকিৎসক এবং মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী।

মুক্তিযুদ্ধকাল ছিল চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের সার্বক্ষণিক নজরদারি এড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে হতো। একইসঙ্গে চিকিৎসা সরঞ্জাম পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। ধরা পড়লে ছিল নির্যাতন ও নিশ্চিত মৃত্যু। তা সত্ত্বেও অবরুদ্ধ দেশে অনেক চিকিৎসকই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন। অনেকে গোপনে পৌঁছে দিয়েছিলেন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।

বন্ধুপ্রতিম নানা দেশ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য ও দাতব্য সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে যুদ্ধাক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরাও নানাভাবে চিকিৎসা সহায়তা পাঠিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বই সূত্রে জানা যায়, একাত্তরের মার্চ মাসের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত সাড়ে ৪০০ বাংলাদেশি চিকিৎসককে নিয়ে গঠিত হয় 'বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ইউকে'। অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা মাসে জনপ্রতি কমপক্ষে ১০ পাউন্ড করে চাঁদা দিতেন।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান করা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় সরকার, দেশটির চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনগণও শামিল ছিলেন এই চিকিৎসা যুদ্ধে। বিদেশি অনেক স্বেচ্ছাসেবক যেমন শরণার্থী ক্যাম্প, সীমান্তসংলগ্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন তেমনি গোপনে অবরুদ্ধ দেশেও পৌঁছে দিয়েছেন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।

৯ মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধে আবরুদ্ধ দেশে মোট কত চিকিৎসক চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না। তবে মুক্তিযুদ্ধ গবেষকদের মতে, এই সংখ্যাটি নেহাতই কম নয়।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা মোট কত চিকিৎসককে হত্যা করেছেন তার প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তবে সবশেষ ২০২৪ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় চিকিৎসক-বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ৯৯ জন।

চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা

রোকেয়া কবির ও মুজিব মেহেদী রচিত 'মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' বই সূত্রে জানা যায়, একাত্তরের শুরুতে চট্টগ্রামের ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে হাসপাতালের সহকারী সার্জন হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডা. রেণু কণা বড়ুয়া। এপ্রিলে তার স্বামী নিখোঁজ হন। স্বামীর পাকিস্তানিদের হাতে শহীদ হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে মে মাসের শেষদিকে বাবার বাড়ি রাউজানের আবুরখিল গ্রামে চলে যান রেণু কণা। শোককে শক্তিতে পরিণত করে যুদ্ধের বাকিটা সময়টা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, চিকিৎসা দিয়েছিলেন তিনি।

ডা. রেণু কণা বড়ুয়া। ছবি: সংগৃহীত

একইসঙ্গে কয়েকজন মেয়েকেও দিয়েছিলেন চিকিৎসা প্রশিক্ষণ। ফলে তাদের বাড়িটি এক রকম ক্লিনিকে পরিণত হয়। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা সেখানে চিকিৎসাসেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে ফিরে গিয়েছিলেন।

অক্টোবরে হাটহাজারীর মদুনাঘাট যুদ্ধে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও চিকিৎসা করেছিলেন রেণু কণা। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন যুদ্ধে গুরুতর আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বীর বিক্রম। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা সুস্থ হলেও রেণু কণার প্রাণপণ চিকিৎসার পরও মারা যান আবদুল মান্নান।

সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী পরিতোষ বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একদিন, একরাত রেণুকণা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। গুলিতে মান্নানের পাকস্থলী ছিঁড়ে যাওয়ায় তাঁকে বাঁচানো যায়নি।'

বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাদেও আবুরখিল ও পাশের অনেক গ্রামবাসীর কাছে রেণুকণাই একমাত্র ভরসা ছিলেন বলে জানান গ্রামবাসীরা। ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান রেণু কণা (৭৯)।

'মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' বই সূত্রে আরও জানা যায়, ফেরদৌসি বেগম ও হাসানুল করিম দম্পতি তাদের যশোরের বাড়িকে হাসপাতালে রূপান্তর করে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। গুরুতর আহতদের চিকিৎসা করতেন যশোর সদর হাসপতালের চিকিৎসক দম্পতি ডা. মহিউদ্দিন ও ডা. মমতাজ বেগম। বাড়িটিতে গুরুতর আহত ১৫-২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধারও চিকিৎসা হয়েছিল। ওষুধ ও অপারেশন সামগ্রী নিয়ে আসা হতো বাজারের ব্যাগে, সবজির আড়ালে।

দেশের অভ্যন্তর থেকেই ১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওষুধ  সরবরাহ করেছিলেন ডা. এম এ মান্নান। মে মাস থেকেই তারা বিভিন্ন সূত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের চেষ্টা চালান। বেসরকারি ডিসপেনসারিগুলো যেহেতু সরকারিভাবে ওষুধের সরবরাহ পেত তাই তারা নিজেদের প্রয়োজনমাফিক পল্লী চিকিৎসকদের (এলএমএফ) মাধ্যমে অগ্রিম ওষুধের ফরমায়েশ নিয়ে রাখত।

ডা. এম এ মান্নান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমএলএফরা সরকারিভাবে ওষুধের সরবরাহ পেত বলে আমরা তাদেরকে আমাদের প্রয়োজন মাফিক ওষুধের মজুদ রাখতে বলতাম। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ফটিকছড়ির খিরামে একবার ওষুধ সরবরাহের সময়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লেও আমরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।'

'মুক্তিযুদ্ধ ও নারী' বই অনুসারে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর চাপ্তা গ্রামের বাসিন্দা রহিমা খাতুন নার্সিং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজন নারী ওড়াকান্দিধাম মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের অধীনে নিজগ্রাম চাপ্তা ও রাতইলে চিকিৎসা দিতেন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে তেজগাঁওয়ের সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ পরিচালক ছিলেন ডা. মোতাহার আলী শিকদার। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য প্রচুর ওষুধ গোপনে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। এপ্রিল মাসেই তাকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়েছিল। এ সময় তার স্ত্রী সালেমা বেগম শ্রমিক নেতা আজিজের মাধ্যমে ২ নম্বর সেক্টরের প্রায় ১ ব্যাটেলিয়ন সেনার চিকিৎসা, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও পোশাকের জোগান দিয়েছিলেন, যা ছিল প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ।

ডা. শিকদারের ছেলে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক পর্যায়ে রাজশাহীতে আমার বাবাকে হত্যার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আইয়ুব খানের অনুরোধে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।'

এই মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আরও বলেন, 'তখন ঢাকায় অনেক চিকিৎসক, মেডিকেলের শিক্ষার্থী গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন। নানা মারফতে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী। কারণ তাদের পক্ষে এগুলো জোগাড় করা অনেকটা সহজ ছিল।'

জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' বইয়ে বলা হয়েছে, ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের পলি ক্লিনিক পরিচালনা করতেন ডা. আজিজুর রহমান, ডা. সুলতানা রহমান, ডা. আলীম চৌধুরী।

১৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে রেকি করতে গিয়ে ক্র্যাকপ্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হালিম জুয়েলের আঙুলে গুলি লাগে। তার আঙুলের অপারেশন হয়েছিল পলি ক্লিনিকেই। ১৫ ডিসেম্বর ক্লিনিকটি উদ্যোক্তা ও চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে আলবদর সদস্যরা।

জেনেভা কনভেনশনের চতুর্থ আর্টিকেল অনুযায়ী, যুদ্ধে চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স চালক প্রমুখ স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তারা আক্রমণের শিকার হবেন না। কিন্তু কনভেনশন লঙ্ঘন করে মুক্তিযুদ্ধে বহু চিকিৎসককেই পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা।

পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের ডা. রফিক আহমেদ তেমনই আরেক শহীদ চিকিৎসক।

শহীদ ডা. রফিক আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

বায়েজিদ খুরশীদ রিয়াজ সম্পাদিত 'মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ' অনুসারে, ২৬ মার্চ রাতে পাবনায় প্রতিরোধ ও সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। ২৬-২৯ মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের চিকিৎসা করেছিলেন ডা. রফিক। ১০ এপ্রিল পাবনা দখল করে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে আহত অনেক সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও চিকিৎসা দিয়েছিলেন তিনি। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা পাকশী রেলওয়ে কলোনির বাসার সামনে ডা. রফিক ও তার তিন ছেলেকে হত্যা করে।

শহীদ ডা. রফিক আহমেদের ছেলে আ জ ম রকিব উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যুদ্ধ শুরু হলে বাকিরা সবাই হাসপাতাল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় চলে গিয়েছিলেন। বাবা না গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমি গেলে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা কে দেবে? বাবার অপরাধ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া। এই অপরাধেই বিহারীদের সহযোগিতায় বাবা এবং আমার তিন ভাই ও বাবার কম্পাউন্ডারকে জবাই করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। অথচ বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ফেনী হাসপাতালে নিরাপদে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।'

শহীদ ডা. রফিকের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের চিকিৎসক ডা. এম কে সরকার। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি বৌদ্ধ মন্দিরে ভিক্ষুর ছদ্মবেশে আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন।

ডা. এম কে সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাঁশখালীর লাটুমুড়া পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। ওখানে আমি চিকিৎসা দিতে নিয়মিতই যেতাম। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি ও রাজাকারেরা টের পেয়ে আমার চেম্বারেও আসে। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে রোগী দেখার বাহানা করে আমি পালিয়ে একটি বৌদ্ধ মন্দিরে আশ্রয় নিই।'

বাংলাদেশ হাসপাতাল

মুক্তিযুদ্ধকালে চিকিৎসাসেবায় বড় ভূমিকা রেখেছিল বাংলাদেশ হাসপাতাল।

'মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা যুদ্ধ' বইয়ে বলা হয়, এপ্রিল মাসে আর্মি মেডিকেল কোরের চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট ডা. আখতার আহমেদের উদ্যোগে ত্রিপুরার শ্রীমন্তপুরে একটি ভাঙা ঘরে হাসপাতালের সূচনা হয়। পরে শ্রীমন্তপুর থেকে সোনামুড়ায় স্থানান্তরিত হলে হাসপাতালে যোগ দেন ডা. নাজিম উদ্দিন। ক্রমান্বয়ে মেলাঘরের দারোগা বাগিচায় অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে উঠে। মে মাসে যুক্তরাজ্য থেকে এসে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা. মবিন।

২৬ আগস্ট মেলাঘরের বিশ্রামগঞ্জে স্থানান্তরিত হয় বাংলাদেশ হাসপাতাল। বাংলাদেশ হাসপাতালে কতজন অসুস্থ ও আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা নিয়েছেন সে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ হাসপাতালে ৬ জন চিকিৎসক, ৪ জন মেডিকেলের শেষ বর্ষের ছাত্র, ১৮ জন স্বেচ্ছাসেবী ও নার্স কর্মরত ছিলেন।

একই বইয়ের তথ্যানুযায়ী, যুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনী যশোর ও কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আর্মি মেডিকেল কোরের ১০২ জন বাঙালি সদস্যকে হত্যা করলে বাকি সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

নভেম্বর মাসে মুখোমুখি যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে গিয়ে অক্টোবর মাসে মেডিকেল কোরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমন অবস্থায় অপ্রতুল চিকিৎসকের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ঊর্ধ্ব শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ডাক্তারের মর্যাদা দিয়ে সাব সেক্টরগুলোতে চিকিৎসা পরিচালিত হয়।

বিদেশি চিকিৎসা সহায়তা

বিশ্বের বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম দেশ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানাভাবে চিকিৎসা সহায়তা পাঠিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইয়ের তথ্যানুসারে, শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে জুন মাসের ৩ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে কলেরা মহামারি মোকাবিলার জন্য জরুরি সাহায্যের আবেদন করেন।

মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪ জুন কলকাতায় আড়াই টন মেডিকেল সরবরাহ, ৩০ টন মেডিকেল সরঞ্জাম এবং ওষুধ পাঠায় ইউনিসেফ। ৫ জুন জেনেভা থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পাঠায় ২৫ লাখ ডোজ টিকা ও ২ লাখ লিটার কলেরার স্যালাইন। অক্সফাম পাঠায় ১০ লাখ টিকা, ১ লাখ কলেরার টিকা ও আইভি স্যালাইন। কানাডা, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র কলকাতায় পাঠিয়েছিল ৩৩০ টন ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম।

ড. চৌধুরী শহীদ কাদের রচিত 'মুক্তিযুদ্ধে ভারতের চিকিৎসা সহায়তা' বই সূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য পশ্চিমবঙ্গে ৬০ বেডের ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল পাঠিয়েছিল পশ্চিম জার্মানি সরকার। আগস্ট মাসে শরণার্থীদের চিকিৎসার জন্য ভারতীয় রেডক্রসকে ১০৫ বেডের হাসপাতাল দান করেছিল পশ্চিম জার্মানি রেডক্রস সোসাইটি।

কলকাতার সল্টলেকে কারিতাস ইন্ডিয়া চালু করেছিল ২৭০ শয্যার হাসপাতাল। কল্যাণীতে সেভ দ্য চিলড্রেনের অর্থায়নে চালু ছিল ৭০ শয্যার হাসপাতাল।

ভারতীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে ৬ লাখ শরণার্থীর চিকিৎসা দিয়েছিল অক্সফাম। এ ছাড়াও কেয়ার, ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিস, ক্রিশ্চিয়ান ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, লুথেরান ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

বিদেশি স্বেচ্ছাসেবকরা মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশেও দিয়েছিলেন চিকিৎসাসেবা। এর মধ্যে ব্রিটিশ নাগরিক রজার মুডির নেতৃত্বে গঠিত অপারেশন ওমেগা ছিল উল্লেখযোগ্য। আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন তিন দফায় ওমেগার স্বেচ্ছাসেবকদের আটক করে ১০ বছর কারাদণ্ড দিলেও হাল ছাড়েননি এই স্বেচ্ছাসেবকরা। অক্টোবর ও নভেম্বরে ৯ বার বাংলাদেশে প্রবেশ করে ওষুধ, খাবার বিতরণ করেছিলেন এই স্বেচ্ছাসেবকরা।

মুক্তিযুদ্ধে খ্রিস্টান চার্চ ও মিশনারি হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। 'মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস' বই সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরের বানিয়ারচর ক্যাথলিক চার্চ ও চার্চের ফাদার মারিনো রিগানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে কক্সবাজারের মালুমঘাটের মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বেশিরভাগ শরণার্থীরই চিকিৎসা দিয়েছিলেন ভারতের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা। চৌধুরী শহীদ কাদেরের 'মুক্তিযুদ্ধে ভারতের চিকিৎসা সহায়তা' গ্রন্থ সূত্রে, মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গের ২৫ হাজার নন-রেজিস্টার্ড চিকিৎসক শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৭২ লাখ ৩৬ হাজার শরণার্থী। কলেরার টিকাই দেওয়া হয়েছিল ২৭ লাখ শরণার্থীকে। আসামের করিমগঞ্জ রেডক্রস সোসাইটি চিকিৎসা দিয়েছিল ৩৭ হাজার শরণার্থীকে। ত্রিপুরায় ১ হাজার প্রশিক্ষিত ও ২ হাজার অপ্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English

Polythene ban: A litmus test for will and eco-innovation

Although Bangladesh became the first country in the world to announce a complete ban on the use of polythene bags in 2002, strict enforcement of the much-lauded initiative has only started taking shape recently.

16h ago