এমটিএফই কেলেঙ্কারি: দায় কার

এমটিএফই

এমটিএফইর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে বিপর্যস্ত হয়েছেন হাজারো বাংলাদেশি। অথচ এর দায় নিচ্ছে না সরকারের কোনো সংস্থা।

দুবাইভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপের (এমটিএফই) ছিল লোভনীয় অফার। শরীয়াহ-সম্মত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে এতে বিনিয়োগ করে ক্রিপ্টোকারেন্সি, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন ও বিভিন্ন পণ্য কিনে লাভবান হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয় সাধারণ মানুষদের।

বাংলাদেশ ছাড়াও নাইজেরিয়া ও শ্রীলঙ্কায় অসংখ্য মানুষ বিনিয়োগ করেছেন এই প্ল্যাটফর্মে। এটি অনেকটা পঞ্জি স্কিমের মতোই ছিল। বিনিয়োগকারীরা নতুন কাউকে দিয়ে বিনিয়োগ করাতে পারলে অতিরিক্ত বোনাস পাবেন, এমন অফারও ছিল।

লোভে পড়ে বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশের উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ের কয়েক হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা চলে যায় এমটিএফইতে।

গত ১৭ আগস্ট অ্যাপ্লিকেশনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ আটকে গেছে।

এ কেলেঙ্কারির আর্থিক পরিমাণ এখনো সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। মোট আর্থিক ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যাও এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।

কারণ, কোনো সরকারি সংস্থা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি যে প্ল্যাটফর্মটির লেনদেন কার আওতায় পড়ে।

এ বিষয়ে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমটিএফই কেলেঙ্কারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের বাইরে পড়ে।'

তার মতে, 'এখানে ই-কমার্সের মতো কেনাবেচা হয় না। এখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ আয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে। আমরা এ ধরনের বিষয় নজরদারি করি না।'

যেহেতু এটি একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ছিল এবং এ ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে এমটিএফইর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। কারণ বিনিয়োগকারীরা জানতেন যে তারা অ্যাপের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন করছেন।'

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও এমটিএফইর বিরুদ্ধে অভিযোগ পায়নি।

এ তথ্য জানিয়ে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আইন অনুমতি দেয় না এমন কিছু নিয়ে অধিদপ্তর কাজ করে না। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা।'

বিএফআইইউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে অর্থপাচার, সন্দেহজনক লেনদেন ও নগদ লেনদেনের তদন্ত করে থাকে।

শফিকুজ্জামানের মতো বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদারও এমটিএফইর বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, 'বিষয়টি আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে সম্পর্কিত।'

'যদি ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এমটিএফই কেলেঙ্কারির দায় নিতে হবে,' উল্লেখ করে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার আরও বলেন, 'এছাড়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপরাধ পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার।'

তার ভাষ্য, 'তারা যদি বিটিআরসিকে জানায়, তবে বিটিআরসি কোনো প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কেউ জানায়নি। কোনো গ্রাহক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনকি, বাংলাদেশ ব্যাংক এ সম্পর্কে কিছু জানায়নি।'

এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এমটিএফইর ঘটনার বিষয়ে তাদের দায় অস্বীকার করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। আইন অনুযায়ী অর্থপাচারের বিষয়টি দেখার এখতিয়ার বিএফআইইউর।'

বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিএফআইইউ গত বছর থেকে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে অনলাইন জুয়া, বেটিং, বৈদেশিক মুদ্রা ও ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন ঠেকাতে কাজ করছে।'

'আমরা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করি। জুয়া সংক্রান্ত আইন সংস্কারের জন্য স্টাডি গ্রুপ তৈরি করেছি। আমরা বিটিআরসির মাধ্যমে জুয়া সংশ্লিষ্ট প্রায় ১ হাজার অ্যাপ্লিকেশন, ওয়েবসাইট ও ইউটিউব লিঙ্ক বন্ধ করেছি।'

এমটিএফইর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, তা তিনি বলতে পারেননি।

মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, 'এমটিএফই একটি ফাঁদের মতো। মানুষ আগের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে না, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, যদিও মানুষের লোভ এই কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী তবুও এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকারেরও দায়িত্ব আছে।

তিনি বলেন, 'যখনই কোনো অপরাধ ঘটে, সরকারের উচিত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।'

টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খানও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, 'এ ধরনের বিনিয়োগের ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য কোনো সামাজিক প্রচার-প্রচারণা ছিল না।

এখন বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাওয়া যায়নি বলে কেউ এমটিএফই কেলেঙ্কারি নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

এ কারণে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি) এ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেনি বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির এক শীর্ষ কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ছায়া তদন্ত শুরু করেছি।'

ইতোমধ্যে এমটিএফই সম্পর্কে তথ্য ও নথি সংগ্রহ শুরু হয়েছে বলে সিআইডির আরেক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে জানান।

তবে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বিএফআইইউর। যেহেতু এমটিএফই কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকিং চ্যানেল, মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে।'

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন পার্থ প্রতিম ভট্টাচার্য ও মো. মেহেদী হাসান)

Comments

The Daily Star  | English

Private airlines caught in a bind

Bangladesh’s private airline industry is struggling to stay afloat, hobbled by soaring fuel prices, punitive surcharges, and what operators describe as unfavourable policies. Of the 10 private carriers that have entered the market over the past three decades, only two -- US-Bangla Airlines and A

9h ago