‘আমার দুই রতনরে কই থুইয়া আইলাম’

মুন্সীগঞ্জে পিকনিকের ট্রলারডুবি
দুই সন্তানকে দাফনের পর বাবা জাহাঙ্গীরের বিলাপ। নৌযান দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তার স্ত্রীও। ছবি: স্টার

'আমার রতনগো আমি কই থুইয়া আইলাম রে! আমি কি করলাম রে! আল্লাহ, তুমি আমারে কি করলা রে! আমি কারে (কবরে) থুইয়া আইলাম রে!'

দুই শিশু সন্তানকে দাফনের পর বাড়িতে ফিরে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন জাহাঙ্গীর (৪০)। এ সময় তার স্বজনরা তাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বলতে থাকেন, 'এই ঘরে আমি যামু না! এই ঘরে আমি কেমনে যামু!'

শনিবার রাতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের খিদিরপাড়া ইউনিয়নের রসকাঠি গ্রামের কাছে পদ্মার শাখা নদীতে (ডহরি খাল) বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের ট্রলার ডুবে যায়। এতে নিহত হন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী হ্যাপি আক্তার (২৮) ও দুই সন্তান সাকিবুল (৮) ও সাজিবুল (৪)। এছাড়াও দুর্ঘটনায় নিহত হন তার শ্যালিকা পপি আক্তার (২৬)। তার স্ত্রীর ভাই রুবেল শেখের ছেলে মাহিম শেখ (৪) এখনো নিখোঁজ।

পেশায় রাজ মিস্ত্রী জাহাঙ্গীরের আহাজারিতে চারপাশ ভারি হয়ে আসে। একটি ডোবার পাশে তাদের বাড়ির উঠানে স্বজনেরা একটি ত্রিপল টানিয়ে দিয়েছেন। তার নিচে স্বজনদের সঙ্গে বিলাপ করছিলেন জাহাঙ্গীর।

তিন সন্তানের বাবা জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে রাকিবুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। ছোট দুই ছেলে সাকিবুল, সাজিবুল আর স্ত্রী হ্যাপিকে নিয়ে শনিবার আনন্দ ভ্রমণে পদ্মা সেতু দেখতে গিয়েছিলেন। নৌ দুর্ঘটনায় জাহাঙ্গীর বেঁচে ফিরলেও তার স্ত্রী ও দুই সন্তান মারা যান।

জাহাঙ্গীরের ভাই উজ্জ্বল জানান, 'স্ত্রী-সন্তানদের হারিয়ে জাহাঙ্গীর এখন পাগল প্রায়। ঘটনার পর থেকে এখনও কিছু মুখে দেয়নি জাহাঙ্গীর। তার দুই সন্তানকে একটু আগে কবরে রেখে এলাম। ভাবির লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। এখন মরদেহ আনতে সদর উপজেলায় যাব।'

রোববার সকালে সিরাজদিখানের লতব্দি ইউনিয়নের খিদিরপুর সামাজিক কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায় ছয়টি কবর খোঁড়া হয়েছে। বৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে কবরগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি দুটি কবরে দুই সন্তানকে দাফন করা হয়েছে। আরেকটি কবরে শায়িত করা হয়েছে পপি আক্তারের চাচাতো ভাই শাহাদাতের পাঁচ মাসের মেয়ে হুমায়রাকে। আরেকটি কবরে শায়িত স্থানীয় ফিরোজের ছেলে ফারিহান (১০)। বাকি দুটি কবর তখনও ফাঁকা রয়েছে।

হ্যাপি আক্তারের চাচাতো ভাই মো. আরশাদ আকাশ বলেন, 'বলার ভাষা নেই। এই দুর্ঘটনায় আমার পাঁচ মাসের ভাতিজিও মারা গেছে। দুর্ঘটনায় শিকার সবাই আমার পরিবারের মানুষ। এই শোক কীভাবে কাটিয়ে উঠব জানি না।'

উদ্ধার অভিযানে নৌবাহিনী

গত রাতে দুর্ঘটনার পর প্রথমে উদ্ধারে নামেন স্থানীয়রা। পরে লৌহজং ফায়ার সার্ভিস তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। রাতেই ঢাকা থেকে পাঁচ সদস্যের ডুবুরি দল উদ্ধারকাজে যোগ দেন। তবে, বৈরী আবহাওয়ার কারণে শনিবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে উদ্ধার কাজ সাময়িক বন্ধ রাখে ফায়ার সার্ভিস। পরে আজ সকাল সাতটা থেকে আবার উদ্ধার অভিযান শুরু করেন নৌবাহিনীর সদস্যরা।

লৌহজং ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল মতিন জানান, 'উদ্ধারকাজে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে।'

নিহত ও নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

ডুবে যাওয়া পিকনিকের ট্রলারে মোট কতজন আরোহী ছিলেন, কতজন জীবিত ও মৃত উদ্ধার হয়েছেন তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। শনিবার রাতে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় জানান, '৩৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে আট জনের।' কিন্তু, তিনি নিখোঁজদের সংখ্যা তখন জানাতে পারেননি।

অন্যদিকে, লৌহজং ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল মতিন জানান, নিহত সাত জনের মধ্যে তিন জন নারী ও চার শিশু রয়েছে। তারা হলেন দুই বোন পপি আক্তার (২৬), হ্যাপি আক্তার (২৮), দুই ভাই সাকিবুল (৮), সাজিবুল (৪), মোকসেদা (৪০), হুমায়রা (৫ মাস) ও ফারিহান (১০)।

নিখোঁজের সংখ্যা নিয়েও রোববার সারা দিনে বিভ্রান্তি কাটেনি। লৌহজং ফায়ার স্টেশন থেকে জানানো হয় দুজন নিখোঁজ। অন্যদিকে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল আউয়াল বলেন, 'আমাদের জানামতে নিখোঁজ রয়েছেন আট জন।'

তবে, লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার ইমাম হোসেন জানান, নিখোঁজ আসলে তিন জন এবং মরদেহ উদ্ধার হয়েছে মোট সাত জনের। নিখোঁজেরা হলেন, রুবেল শেখের ছেলে মাহিম শেখ (৪), এবং সিরাজদিখানের কয়রাখোলার আরিফের দুই সন্তান নাভা (৫) ও তুরান (৭)।

লৌহজং থানায় মামলা

রোববার বিকেলে লৌহজং থানায় একটি মামলা হয়েছে। নিখোঁজ মাহিম শেখের বাবা রুবেল শেখ বাদী হয়ে বাল্কহেডের পাঁচ-ছয় জন কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার ইমাম হোসেন জানান, বাল্কহেডটি জব্দ করা হলেও কর্মচারীদের কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

Comments

The Daily Star  | English

Injured uprising protesters block Mirpur Road

Injured protesters from last year's mass uprising blocked Mirpur Road demanding medical treatment and rehabilitation

1h ago