প্রবল বৃষ্টিতে টানা দ্বিতীয় দিন ডুবল চট্টগ্রাম নগরী
সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় টানা দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
শনিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস সহকারী পূর্বাভাষ কর্মকর্তা শ্রীকান্ত কুমার বসাক বলেন, 'এই অঞ্চলে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আগামী ৪৮ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কাও রয়েছে।'
এদিকে শুক্রবার থেকে নগরীর পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, মতিঝর্ণা, বাটালী হিল, ফিরোজ শাহ, আকবর শাহ এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তাদের কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, 'আমরা তাদের স্থানীয় স্কুলে থাকতে বলেছি কিন্তু তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।'
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর চকবাজার, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, বাদুরতলা, বাকালিয়া ডিসি রোড, কেবি আমান আলী রোড, আগ্রাবাদ, হালিশহর, চান্দগাঁও, কাতালগঞ্জ, দেওয়ান বাজার ও শুলকবহরসহ অধিকাংশ নিচু এলাকা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে।
আজ সকাল ১১টায় বাদুরতলা এলাকার রাস্তার পাশের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ দেখা যায়। দোকানিরা জানান, বৃষ্টির পানি দোকানে ঢুকে যাওয়ায় জিনিষপত্র নষ্ট হচ্ছে।
বাদুরতলা এলাকার দোকানি শফিকুল আলম জানান, বৃহস্পতিবার রাতে প্রবল বৃষ্টির পর তার দোকানে পানি ঢুকে যায়। শুক্রবার বিকেলে সেই পানি অপসারণ করেন তিনি। এর পর সেদিন রাতে আবার বৃষ্টিতে তার দোকানে পানি ঢোকে।
তিনি বলেন, 'আরও বৃষ্টি হলে আবার দোকানে পানি ঢুকবে, তাই এখন আর পানি অপসারণ করছি না। এই কারণে আজ অধিকাংশ দোকান বন্ধ আছে।'
গত দুই দিনে প্রবল বৃষ্টিতে চকবাজার এলাকার চক সুপার মার্কেটের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়ে। দোকানিরা জানান নিচতলায় নোংরা পানি ঢুকে দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তেলিপট্টি থেকে চকবাজার কাঁচাবাজার পর্যন্ত রাস্তা হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তার পাশের নর্দমা থেকে উপচে পড়া নোংরা পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন পথচারীরা।
পশ্চিম বাকালিয়া ডিসি রোড এলাকার বাসিন্দা তাপসী ঘোষ চকবাজার কাঁচাবাজারের সামনের রাস্তা দিয়ে নোংরা পানি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তিনি জানান, তার শাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, 'রাস্তায় খুব কম যানবাহন চলাচল করছে। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে আমি মাত্র দুটি খালি রিকশা পেলাম, কিন্তু চালকরা খুব বেশি ভাড়া দাবি করছিলেন। তাই, আমাকে নোংরা পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০১৭ সাল থেকে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, কিন্তু প্রকল্পটি শুরু হওয়ার পাঁচ বছর পরও তার কোনো সুফল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
এই ব্যাপারে মন্তব্য জানার জন্য সিডিএ প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামসের মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। সিডিএ মেগা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলীকে বার বার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে ৩ মাস আগে, সংবাদ সম্মেলনে শাহ আলী সাংবাদিকদের বলেন, তখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬ দশমিক ২৬ শতাংশ ছিল।
অনেকেই আবার খাল ও নর্দমা দিয়ে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ, চসিকের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নর্দমাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করেন না।
যোগাযোগ করা হলে চসিক পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন বলেন, সিডিএ নগরীর ৩৬টি বড় খাল নিয়ে কাজ করছে এবং যতদিন পর্যন্ত তারা এগুলো চসিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর না করছে, ততদিন এসব খালে চসিক কিছু করতে পারে না। ততদিন পর্যন্ত তাদেরকেই খালগুলো খনন করে পানি চলাচল সুগম রাখতে হবে।
জানতে চাইলে মোবারক বলেন, চসিক-এর আওতাধীন নর্দমা ও খাল নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। এর পর লোকজন আবার প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যাগ ফেললে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
অপরিকল্পিত নগরায়নে জলাবদ্ধতা
২০২২ সালের নভেম্বরে, বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ইয়াং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে চট্টগ্রামের সাড়ে ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে আছে। আর পরোক্ষ ঝুঁকিতে আছে ৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা।
গবেষকরা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেই নগররীর এসব এলাকা জলাবদ্ধতার ঝুঁকির মধ্যে আছে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়, বিগত ৫৩ বছরে শহরের ৭০ শতাংশ খাল বিলীন হয়ে গেছে।
অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলায় আগ্রাবাদ, হালিশহর, বাকালিয়া, মোহরা, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইসহ নগরীর নিম্নাঞ্চল শুষ্ক মৌসুমেও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে।
১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কোম্পানি জন আর স্নেল যখন শহরের ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেন, তখন নগরীতে ৭০টি খাল পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ওয়াসা পরিচালিত সমীক্ষা অনুসারে, ৫৩ বছরে খালের সংখ্যা ৭০ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২২টিতে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জন্য মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান শীর্ষক সমীক্ষায় আরও জানা গেছে, চসিকের মোট ২২টি ওয়ার্ড সরাসরি জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে রয়েছে, এর মধ্যে ৬টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, ৩টি চরম ঝুঁকিতে এবং ১৩ টি ওয়ার্ড মাঝারি ঝুঁকিতে রয়েছে।
জলাবদ্ধতার খুব দ্রুত সমাধান করা না হলে ভবিষ্যতে মাত্র ২০০ মিমি বৃষ্টিপাতেও শহরের বেশিরভাগ নিচু এলাকা ১ দশমিক ৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে বলে জানান গবেষকেরা।
এই গবেষণার প্রধান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিসুক।
যোগাযোগ করা হলে মিসুক বলেন, 'যদি আমরা সিডিএ মেগা প্রকল্প বা জলাবদ্ধতা সংক্রান্ত অন্য যে কোনো প্রকল্পের সুবিধা পেতে চাই, তবে আমাদের পরিকল্পিত নগরায়ণে যেতে হবে। শহরের হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং বিদ্যমান খালগুলোকে অবৈধ দখল থেকে মুক্ত করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি করা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষের উচিত খাল-নালায় আবর্জনা কিংবা পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রি না ফেলা।'
Comments