ক্রাম্ব চাপের খোঁজে ৬০ বছরের পুরোনো নিউ ক্যাফে কর্নারে

ক্রাম্ব চাপ, দুধ চা ও কাটলেট। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

নর্থব্রুক হল। ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত দালানটি পরিচিত ছিল 'লালকুঠি' নামে। এই লালকুঠি যাওয়ার পথটিই নর্থব্রুক হল রোড। পটুয়াটুলীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বামদিকে বাংলাবাজারের রাস্তাটিতে ঢুকে আরেকটু সামনে বামে গেলেই এই রোড।

রাস্তার ২৮ নম্বর ভবনটি নিউ ক্যাফে কর্নার। স্থানীয় সবাই একনামেই চেনেন এ ক্যাফে কর্নারকে। নামের সার্থকতা প্রমাণ করেই যেন ক্যাফেটির অবস্থান মূল রাস্তা থেকে ভেতরে এক কোণে।

খুব বেশি বড় জায়গা নিয়ে নয় এটি। একবারে বসতে পারবেন ২৪ জন। ৬টি টেবিল, সঙ্গে পুরোনো আমলের চেয়ার। আগেকার দিনের কেবিন রেস্তোরাঁগুলোর আমেজ পাওয়া যাবে এখানে।

দোকানটি যাত্রা শুরু করে ১৯৬২ সালে। প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ ঘোষ শুরুটা করেছিলেন পরোটা আর ডাল দিয়ে। তারপর অন্যান্য আইটেমও আসে। দোকানটির সবচেয়ে বিখ্যাত আইটেম ক্রাম্ব চাপ, কাটলেট ও দুধ চা।

সেই ষাটের দশকে আশেপাশে দোকান বলতে গেলে ছিল না। তাই সকাল ও সন্ধ্যার নাস্তার জন্য সবার কাছে খুবই প্রিয় হয়ে উঠে ক্যাফে কর্নার। মজার ব্যাপার হলো, ক্যাফে নাম হলেও এখানে কিন্তু কফি ছিল না কখনোই।

দোকানটির বর্তমান মালিক সোলায়মান মল্লিক। এ ছাড়া তত্ত্বাবধানে আছেন অনিল মিত্র। অনিল এখানে আছেন ১৯৭৬ সাল থেকে। দোকানের মালিক তখন হরিপদ ঘোষই ছিলেন। ১৯৯২ এ হরিপদ দোকান বিক্রি করেন সোলায়মান মল্লিকের বাবা হেদায়েত উল্লাহ মল্লিকের কাছে। এরপর হরিপদ কলকাতায় চলে যান বলে জানা যায়।

তবে পুরোনো কর্মচারীদের ভেতর অনিল মিত্র রয়ে যান। এ ছাড়া দোকানের প্রথম বাবুর্চি জোসেফ ও পরবর্তীতে তার ছেলে অজিতও হেঁশেল সামলেছেন। দোকানটিতে বিভিন্ন আইটেম মিললেও এর বিশেষ খ্যাতির কারণ ক্রাম্ব চাপ ও কাটলেট। এই ক্রাম্ব চাপ মূলত বিদেশি রেসিপি অনুসরণ করে বানিয়েছিলেন বাবুর্চি জোসেফ।

খাসির কিমা বিস্কুটের গুঁড়ো দিয়ে মেখে নিয়ে ডুবোতেলে ভাজা হয় ক্রাম্ব চাপ। মুচমুচে এই চাপ এখানকার সবচেয়ে দামি আইটেমও বটে। কাটলেটটির আকার দেয়ালে বসা প্রজাপতির মতো।

দোকানের সাইনবোর্ড। ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ কেতা মেনেই ক্রাম্ব চাপের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় ২ পিস পাউরুটি। এর বাইরে চিংড়ি ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, আলুর চপ, ডিম চপ, খাসি ভুনা, মোরগ পোলাও ইত্যাদি আইটেম পাওয়া যায়।

দোকানে এখন বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন মো. মহসিন।

তিনি বলেন, 'আমি এখানকার প্রথম মুসলিম বাবুর্চি। আমার আগে ছিলেন জন গোমেজ। তার আগে পিটার গোমেজ। জোসেফ সাহেব যেভাবে কাটলেট বা ক্রাম্ব চাপ বা অন্যান্য আইটেম বানাতেন, সেটা তার ছেলে শিখছিলেন। পরে সিরিয়ালে আমরা সবাই শিখেছি।'

রেস্তোরাঁর মেসিয়ার জহিরউদ্দিন এখানে আছেন ২ যুগের বেশি সময় ধরে। প্রচণ্ড ব্যস্ততায় বিভিন্ন টেবিলে খাবার পরিবেশনের তদারকি করছিলেন তিনি। কথা বলতে তেমন আগ্রহী নন। শুধু জানালেন, 'আইটেম সবগুলোই ভালো যায়। ক্রাম্ব চাপ, কাটলেট, আলুর চপ, চিকেন ফ্রাই, চা বেশি যায় (বিক্রি বেশি হয়)।'

বর্তমান মালিক সোলায়মান মল্লিক বলেন, 'এখানে মাংস কেনা হয় শ্যামবাজার থেকে। প্রতিদিন নতুন করে ভাজা হয় আইটেমগুলো। যেন অতিরিক্ত না থাকে, সেভাবেই বানানো হয়।'

প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে হোটেল। তবে বিকেলের পর থেকে ভিড় বাড়ে। স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে বন্ধের দিনে দূর-দূরান্তের মানুষও আসে এখানে।

সদরঘাটের বাসিন্দা শাহেদ মাহমুদ যেমন বললেন, 'আমি এখানে প্রায়ই নাশতা করতে আসি৷ আমার সবচেয়ে পছন্দ এদের আলুর চপ। হালকা জিনিস, সঙ্গে চা হলে একদম জমে যায়। আমার এক বন্ধু আছে, এদিকে থাকে না। কিন্তু ব্যবসার কাজে এদিকে আসলেই এখানে চপ বা কাটলেট খাবেই।'

ছবি: সংগৃহীত

এক সময় শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের অনেকে আসতেন উল্লেখ করে শাহেদ বলেন, 'এই চা-টা কড়া লিকারের, শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের পছন্দের। আর সঙ্গে আড্ডা তো আছেই। বাংলাবাজারেই তো প্রায় সব প্রকাশনী। কাজেই এদিকে সাহিত্যের লোকজনের আনাগোনা ছিল খুব। তারা আড্ডার জন্য আসতেন এখানেই।'

সোলায়মান মল্লিক জানান, তারা দোকান নেওয়ার পরের বছরই কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩) সিনেমার মহরতে তাদের দোকান থেকে গিয়েছিল ক্রাম্ব চাপ আর কাটলেট।

এই ক্রাম্ব চাপ আশেপাশের কিছু দোকান বানানোর চেষ্টা করেও পারেনি বলে জানান শাহেদ মাহমুদ।

তার ভাষ্যে, 'এদিকে যেহেতু কুঠি ছিল, ইংরেজদের সংখ্যাই বেশি ছিল। তাদের থেকেই ক্রাম্ব চাপ, কাটলেট, চিকেন ফ্রাই এগুলো এসেছে। প্রথম যিনি বাবুর্চি ছিলেন (জোসেফ), তিনি মূল রেসিপি মেনে বানান। বাকিরা পরম্পরায় শিখে নিয়েছে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

July uprising: The wounds that are yet to heal, one year on

This week marks one year since 15-year-old Md Shahin Alam’s life was forever changed -- not by illness or accident, but by a bullet that tore through his left leg during a rally on August 5, 2024.

15h ago