অলস পড়ে আছে স্পিডবোট, আয়হীন চালক পেশা বদলাচ্ছেন

যাত্রী নেই, অলস পড়ে আছে স্পিডবোটগুলো। ছবি: স্টার

মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথে স্পিডবোটে চড়ে ১৫০ টাকায় প্রায় ২০ মিনিটে পদ্মা নদী পারাপারের দিন শেষ হয়ে এলো। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই যাত্রী নেই স্পিডবোট ঘাটে। এখন গাড়িতে চড়ে ৬-৭ মিনিটেই পদ্মা নদী পার হচ্ছেন মানুষ।

স্পিডবোটের সঙ্গে জড়িতরা এ পেশা ছেড়ে অন্য কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন। কেউ কেউ বোট বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকিরা বিক্রির জন্য ভালো দাম পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

ঘাট সংশ্লিষ্টরা জানান, শিমুলিয়া ঘাটে ১৫৫টি বোট নিবন্ধন করেছিল। বর্তমানে প্রায় ১০০টি বোট আছে। তবে দিন দিন কমছে বোটের সংখ্যা।

বর্তমানে পর্যটকদের নদী থেকে পদ্মা সেতু ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য ৩০-৪০টি ছোট স্পিডবোট চালু আছে।

শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সাল থেকে পদ্মা নদীর এ নৌপথে স্পিডবোট চলাচল করে আসছিল। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় ৩৬ বছর ধরে মানুষের নির্ভরতা বেশি ছিল এ ঘাটের ওপর। স্থানীয়রা স্পিডবোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত শুরু থেকেই। স্বাভাবিক সময়ে স্পিডবোটে প্রতিদিন ৫-৭ হাজার মানুষ পদ্মা নদী পার হতেন। ঈদ মৌসুমে প্রতিদিন পার হতেন ২৫-৩০ হাজার মানুষ। সময় কম লাগায় ও ভোগান্তি এড়াতে স্পিডবোটকেই বেছে নিতেন যাত্রীরা। চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই ঘাটটি অচল হয়ে গেছে।

স্পিডবোট মালিক আক্তার হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথে আমার ৯টি স্পিডবোট আছে। এসব বিক্রি করে দেব। ১২ বছর আগে প্রায় ৫০ লাখ টাকা দিয়ে বোটগুলো কিনেছিলাম। তবে এখন হয়তো ২০-২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিতে হবে। মাঝেমধ্যে ক্রেতা আসছেন, বোটও দেখছেন। কিন্তু যে দাম বলছে তাতে অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে। এখন যাত্রী না থাকায় ব্যবসা বন্ধ, কিন্তু বাৎসরিক মোটা অংকের চার্জ নবায়নের জন্য দিতে হবে সরকারকে। বর্তমানে আমাদের ব্যবসা নেই, বোট না চললে সরকারি চার্জ, চালক-শ্রমিককে কীভাবে টাকা দেব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।'

তিনি জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই বোট বন্ধ। যাত্রী আসছে না। মাওয়া ঘাটের স্থানীয় ৫-৬টি স্পিডবোট হয়তো চলাচল করছে, তবে বাকিরা বোট বন্ধ রেখেছেন।

স্পিডবোট মালিক আবু সালেম চৌকিদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ৪টি স্পিডবোট প্রায় ৯ বছর ধরে পদ্মায় চলাচল করছিল। তবে গত ২৫ জুন থেকে অলস সময় পার করছে। শুধু শুক্রবার পর্যটক পাওয়া সাপেক্ষে চালানো হয়। সেদিন ৩-৪টি ট্রিপ পাওয়া যায়। বোটগুলো বিক্রি করে দেওয়ার অপেক্ষায় আছি। ভালো দাম পেলে বিক্রি করে দেবো।'

স্পিডবোট মালিক রিপন হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, '৪টি স্পিডবোট নিজ মালিকানায় আছে ও আরেকটি বোটের অংশীদার হিসেবে আছি। তবে এখন এসব বোট বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজছি। ভালো দাম পেলে বিক্রি করবো।'

তিনি জানান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলায় স্পিডবোটের চাহিদা নেই। অন্য নৌপথেও ব্যবসা করার সুযোগ নেই। চালকরাও বেকার বসে আছেন।

স্পিডবোট মালিক মো. শিপন বেপারী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেশিরভাগ স্পিডবোট নদী থেকে পাড়ে উঠিয়ে রেখেছেন চালকরা। খরচ পোষাতে পারবেন না বলে বোট ডাঙায় রেখেছেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিছু চালক, শ্রমিক ঘাটে অবস্থান করে ২০০-৩০০ টাকা পেয়ে থাকেন। অনেক চালক অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ কেউ চায়ের দোকান দিয়েছেন। বেশিরভাগ স্পিডবোট বিক্রির অপেক্ষায় আছে। বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতা আসছেন, তবে তারা ২-১ লাখ টাকায় স্পিডবোট কিনতে চান। তবে এ নৌপথের স্পিডবোট অনেক টেকসই ও দামী। এ দামে কেউই বিক্রি করবেন না।'

তিনি জানান, নিবন্ধনকৃত এসব বোট প্রতি বছর নবায়নের জন্য মোটা অংকের সরকারি চার্জ দিতে হয়। কিন্তু এখন ব্যবসা নেই। এজন্য বোটের সার্ভে বাতিলের আবেদন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

জনশূন্য শিমুলিয়া ঘাট। ছবি: স্টার

কাঁঠালবাড়ি ঘাটের বোটচালক মো. শাহীন হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পদ্মা সেতু ঘুরে দেখার জন্য পর্যটক আসেন। তখন এ ঘাট থেকে ৩-৪টি বোট চলাচল করে। তবে পর্যটক বহন করতে শুধু ছোট বোটগুলো চালানো হয়। কারণ এসব বোট তেল সাশ্রয়ী। প্রায় ২ লিটার তেল খরচে ৪-৫ জন যাত্রীকে পদ্মা সেতু ঘুরিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।'

তিনি জানান, কাঁঠালবাড়ি ঘাটের বেশিরভাগ চালক ও শ্রমিক এ পেশা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছেন।

বোটচালক মো. বাদশা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি নৌপথে মাত্র কয়েকটি স্পিডবোট যাত্রী নিয়ে চলছে। তবে সকালে ২-৩ জন যাত্রী আসার পর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে তারপর সেগুলো ঘাট ত্যাগ করে। বেশিরভাগ যাত্রী সেতু দিয়ে চলাচল করেন। কেউ এখন আর ঘাটে এসে অপেক্ষা করেন না।'

শিমুলিয়া ঘাটের বোটচালক আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার এ ঘাটে পর্যটক আসেন। তখন একেকটি বোট ২-৩টি করে ট্রিপ দেয়। ঘাটে প্রায় ২৫-৩০টি স্পিডবোট চলাচল করে। পদ্মা সেতুর ১ নম্বর পিলার থেকে ২০ নম্বর পিলার পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনা হয়। নির্দিষ্ট কোনো ভাড়া নির্ধারিত হয়নি, তবে ১৫০০-২০০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়ে থাকে।'

শিমুলিয়া স্পিডবোট ঘাট ইজারদার মো. সালাউদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইতোমধ্যে ১০-১৫টি স্পিডবোট বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি বোটগুলোও বিক্রির জন্য কথাবার্তা চলছে। তবে ক্রেতা কম। বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ১৫ লাখ টাকার স্পিডবোট ১০-১২ লাখ টাকায় বিক্রি করে দিতে হবে। যদিও বোটগুলো খুবই ভালো মানের।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারিভাবে বোট নিবন্ধন করার কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন চার্জ দিতে হবে। শুধু সার্ভে চার্জ দিতে হবে বছরে ১৫ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক আরও অনেক চার্জ দিতে হবে। কিন্তু আমাদের বোটই যদি না চলে তাহলে কীভাবে টাকা দেব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। শিমুলিয়া ঘাটে প্রায় ৩০০ মানুষ জড়িত। সবাই পরিবার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।'

এ বিষয়ে শিমুলিয়া নদী বন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক এবং সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহাদাত হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শুক্রবার ও শনিবার স্পিডবোট ঘাটে শুধু পর্যটক আসেন পদ্মা সেতু ঘুরে দেখার জন্য। সেদিন ২০-৪০টি বোট চলাচল করে। পর্যটক ছাড়া যাত্রী নেই এ ঘাটে। শিমুলিয়া ঘাটে ১৫৫টি বোট নিবন্ধন করেছিল। যাত্রী কমে যাওয়ায় অনেকে বোট বিক্রি করে দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ মাস চুক্তিতে অন্য নৌপথে চলে গেছেন। বর্তমানে এ ঘাটে প্রায় ১০০টি বোট আছে। তবে দিন দিন কমছে বোটের সংখ্যা।'

তিনি জানান, দেশের অন্য নৌপথে এসব বোট চলাচলের সুযোগ আছে। রুট পারমিট নতুন করে নবায়ন করলে তারা চালাতে পারবেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'নিবন্ধনকৃত বোটগুলোকে নবায়ন করতে বছরে একটি ফি দিতে হবে। যেহেতু এ ঘাটে বোটের চাহিদা নেই, সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডিজি শিপিং এ বিষয়ে মানবিক হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। যদি নবায়ন না করা হয় তাহলে এসব বোট অন্য নৌপথে চলে গেলে বিপদ হবে। বেআইনিভাবে যাতে চলাচল না করতে পারে সেজন্য নবায়ন জরুরি।'

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

1h ago