ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়বে জাপান, উদ্বেগ কতটা

কাছাকাছি অবস্থিত নামি সমুদ্রতট থেকে ফুকুশিমা দাই চি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র দেখা যাচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স
কাছাকাছি অবস্থিত নামি সমুদ্রতট থেকে ফুকুশিমা দাই চি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র দেখা যাচ্ছে। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সুনামিতে বিধ্বস্ত ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বর্জ্য পানি শিগগিরই সমুদ্রে ছাড়তে শুরু করবে জাপান। জাতিসংঘের আণবিক শক্তি সংস্থা- আইএইএ এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে।

গতকাল বুধবার সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রায় ১২ বছর পর এই পরিকল্পনায় অনুমোদন দেওয়া হলো।

পরিশোধনের পর তেজস্ক্রিয় পানি সমুদ্রে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ চলছিল। ২০১৯ সালে দেশটির পরিবেশমন্ত্রী ঘোষণা দেন, বর্জ্য উপকরণ সংরক্ষণের জন্য আর জায়গা না থাকায় তাদের হাতে 'কোনো বিকল্প নেই।'

আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রসি মঙ্গলবার ২ বছরের নিরাপত্তা পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশ করেছেন এবং এটিকে নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি পানি ছাড়ার পর জাপানের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

গত মে মাসে সংস্থাটি বলেছিল, ফুকুশিমা অপারেটর টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার (টেপকো) বর্জ্য পানিতে উপস্থিত বিকিরণের পরিমাণ সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট পরিমাপ করার ক্ষমতা দেখিয়েছে।

কী ঘটেছিল ফুকুশিমায়

২০১১ সালে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে সুনামি আঘাত হানে জাপানে। এতে ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩টি চুল্লি প্লাবিত হয়। চেরনোবিলের পর এটি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত।

এই ঘটনার পরে কেন্দ্রের আশেপাশের অঞ্চল থেকে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ওই অঞ্চল এখনো ফাঁকা রাখা হয়েছে।

এরপর থেকে পারমাণবিক চুল্লির ধ্বংসস্তুপে পাম্পের মাধ্যমে ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত করা হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে, চুল্লিতে মাটি থেকে ও বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে, যার ফলে বর্জ্য পানির পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে গেছে—যার সংরক্ষণ ও পরিশোধন প্রয়োজন।

এ মুহূর্তে টেপকো ১ হাজার বড় ট্যাংকে ১৩ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন তেজস্ক্রিয় পানি সংরক্ষণ করছে, যা দিয়ে ৫০০টিরও বেশি অলিম্পিক গেমসের সুইমিং পুল ভরে ফেলা সম্ভব।

তবে জায়গা ফুরিয়ে আসছে। আর ট্যাংকের সংখ্যা বাড়ানোর উপায় নেই বলে জানিয়েছে টেপকো

কী ঝুঁকি রয়েছে

তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পানিতে কিছু বিপজ্জনক উপকরণ আছে, তবে টেপকো জানিয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই পরিশোধন করা সম্ভব।

সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ট্রিটিয়াম, যেটি সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে এ ধরনের কোনো প্রযুক্তি নেই।

তবে জাপান সরকার ও আইএইএ জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয় পানি খুব ধীরে ধীরে, কয়েক দশক ধরে সাগরে ছাড়া হবে।

এর অর্থ, পানিতে খুব স্বল্প পরিমাণ ট্রিটিয়াম মেশানো হবে।

টেপকো ও আইএইএ যুক্তি দিয়েছে, প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশ থেকে ট্রিটিয়াম পানির সঙ্গে মিশে যায়, এমন কী, মানবদেহেও এটি প্রবেশ করে। বৃষ্টির পানি থেকে সমুদ্রের পানি ও কলের পানির মাধ্যমে এটি ঘটে। তাদের যুক্তি, স্বল্প পরিমাণে সাগরে মেশানো হলেও এতে বড় কোনো ঝুঁকি নেই।

আইএইএর প্রতিবেদনে গ্রসি জানান, পরিশোধিত পানি সাগরে ফেললে তা মানুষ ও পরিবেশের ওপর ন্যুনতম প্রভাব ফেলবে।

অন্যদেশগুলো কী বলছে

জাতিসংঘ অনুমোদন দিলেও আশ্বস্ত হয়নি প্রতিবেশী দেশগুলো এবং স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়, যারা ২০১১ সালের পারমাণবিক বিপর্যয়ের প্রভাব এখনো অনুভব করেন।

কেউ কেউ আইএইএর পর্যালোচনার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছে। চীন সম্প্রতি জানায়, আইএইএর নিরীক্ষা ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিকে আইনি বৈধতা দেয় না।

যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে সমর্থন জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, জাপান তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্বচ্ছতা দেখিয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পারমাণবিক নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনেই এই উদ্যোগ নিয়েছে।

তাইওয়ানও জানিয়েছে, যে পরিমাণ ট্রিটিয়াম পানিতে ছাড়া হবে, তা খুবই সামান্য এবং এতে তাইওয়ানের ওপর ন্যুনতম প্রভাব পড়বে। স্বশাসিত দ্বীপটি জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

তবে জাপানের নিকট প্রতিবেশী এতটা ইতিবাচক নয়।

মার্চে চীনের এক কর্মকর্তা সতর্ক করেন, বর্জ্য পানি 'সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর নজিরবিহীন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগর জাপানের পয়ঃনিষ্কাষণের জায়গা নয় যে তারা চাইলেই সেখানে তেজস্ক্রিয় পানি ছাড়তে পারবে।'

প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সংগঠন, প্যাসিফিক আইল্যান্ডস ফোরামের মহাসচিব জানুয়ারিতে এ বিষয়টি নিয়ে 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু জুনে এ পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানান। তিনি জানান, পরিশোধনের পর এমন কী এই পানি পানও করা সম্ভব।

অন্যান্য দেশও কি তেজস্ক্রিয় পানি ছাড়ে?

আইএইএসহ অনেক সংস্থা উল্লেখ করেছে যে বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো নিয়মিত এবং নিরাপদে কম মাত্রার ট্রিটিয়ামযুক্ত পানি বর্জ্য হিসেবে ছেড়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি কমিশনের এক মুখপাত্র সিএনএনকে নিশ্চিত করেছেন, 'বিভিন্ন জলপথের আশেপাশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই স্বল্পমাত্রার তেজস্ক্রিয়তাযুক্ত পানিই ছেড়ে থাকে।

জনমত কী বলছে

সমুদ্রে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, এ আশঙ্কায় জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় সামুদ্রিক মাছ ও লবণের দাম বেড়ে গেছে। অনেকেই এ ধরনের উপকরণ বেশি করে কিনে রাখছেন।

মার্চে জাপানে এক মতামত জরিপে জানা যায়, ১ হাজার ৩০৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৫১ জন এই উদ্যোগকে সমর্থন করেন। ৪১ জন এর বিরোধিতা করেন। এ বছরের শুরুতে টোকিওর জনগণ রাস্তায় নেমে এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, তেজস্ক্রিয় এই পানি ছেড়ে দিলে ফুকুশিমার আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর থেকে ফুকুশিমার জেলেরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সর্বশেষ এই উদ্যোগে তাদের ভোগান্তি আরও বাড়তে পারে বলে ভাবছেন তাদের অনেকে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Climate finance: COP29 draft proposes $250b a year

COP29 draft deal says rich nations should pay the amount to fight climate change

1h ago