দেশে টার্বোচার্জড গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়লেও চিন্তার কারণ জ্বালানী সমস্যা

দেশে টার্বোচার্জড গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়লেও চিন্তার কারণ জ্বালানী সমস্যা
ছবি: আবরার শরিক খান

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে টার্বোচার্জড গাড়ির জনপ্রিয়তা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের গাড়িগুলো ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে 'টার্বোচার্জার' নামের এক ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে পুরনো এবং নতুন, ২ ধরনের গাড়ির মালিকেরাই নন-টার্বো মডেলের তুলনায় টার্বো মডেলগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকছেন। তবে, বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তার বৃদ্ধি পেলেও, এখানে স্থানীয়ভাবে 'জ্বালানীর গুণমান' সংক্রান্ত একটি সমস্যা রয়ে গেছে। 

অটোমোবাইলের ক্ষেত্রে এর জ্বালানীর গুণমানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটি টার্বোচার্জড গাড়ির ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ টার্বোচার্জড গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর আলাদা করে কিছু চাপ পড়ে। চলুন দেখে নেওয়া যাক, বাংলাদেশে টার্বোচার্জড গাড়িগুলো কতটা জনপ্রিয় এবং টার্বোচার্জড গাড়ির মালিকরা কীভাবে নিম্নমানের জ্বালানীর সমস্যা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন।

টার্বোচার্জড গাড়ির জনপ্রিয়তা 

টার্বোচার্জার মূলত ইঞ্জিনের একটি অংশ হিসেবে ইনস্টল করা একটি যন্ত্র। যা এক্সস্ট গ্যাসের শক্তি দিয়ে চলে। টার্বোচার্জারের কাজ হলো ইঞ্জিনের সিলিন্ডারে আরও বেশি বাতাস সংকুচিত করা। বেশি পরিমাণ বাতাস থাকার কারণে ইঞ্জিনে আরও বেশি জ্বালানী যোগ করা যায়। টার্বোচার্জারের মাধ্যমে ইঞ্জিন কম জ্বালানী খরচ করে বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে। টার্বোচার্জড ইঞ্জিনগুলো সবচেয়ে ভালোভাবে চলার জন্য জ্বালানী এবং বায়ুর সুনির্দিষ্ট ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল। যার কারণে, একটি টার্বোচার্জড গাড়ি সঠিকভাবে চলার জন্য জ্বালানীর গুণমানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। 

বাজার নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা মর্ডর ইন্টেলিজেন্সের একটি পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে বিক্রি হওয়া পেট্রোল চালিত গাড়িগুলোর ৫০ শতাংশে টারবোচার্জার থাকতে পারে। আর, এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে আইনের পরিবর্তনের কারণে, গাড়ি নির্মাতারাও আরও টার্বোচার্জড গাড়ি তৈরি করতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এই গাড়িগুলো কম জ্বালানি খরচ করে। এ ছাড়া, এগুলো কম দূষণকারী পদার্থ নির্গত করে আরও বেশি শক্তি উৎপাদন করতে সক্ষম। 

কেন গাড়ি নির্মাতারা আরও টার্বোচার্জড গাড়ি তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছেন? এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএইচএস মোটরসের ম্যানেজার অব সেলস মোমিন উজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রধান কারণ হলো ইঞ্জিনের সাইজ কমানো। উদাহরণস্বরূপ, পূর্বে, হোন্ডা সিআর-ভি-এর একটি ২ দশমিক ৪-লিটার ইঞ্জিন ছিল। এটি ১৩৬ হর্সপাওয়ার উৎপন্ন করত। প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে, ইঞ্জিনের আকার ২ দশমিক শূন্য লিটারে কমিয়ে আনা হয়। যা তখন ১৫২ হর্সপাওয়ার উৎপন্ন করে। এখন, একটি টার্বোচার্জার যোগ করে, হোন্ডা সিআর-ভি তার ১ দশমিক ৫-লিটার ইঞ্জিন থেকে ১৯২ হর্সপাওয়ার তৈরি করতে পারছে।' 

টার্বোচার্জড গাড়ি থাকার সুবিধা কী জানতে চাইলে মোমিন বলেন, 'একটি টার্বোচার্জড গাড়ির দুটি প্রধান সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, গাড়িটি বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী। দ্বিতীয়ত, ইঞ্জিনের সিসি (কিউবিক সেন্টিমিটার) কমে যায়, যার জন্য কম ট্যাক্স এবং শুল্ক দিতে হয়।' 

তিনি আরও বলেন, 'দাম কম হওয়ার কারণে টার্বোচার্জড গাড়ি বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যে ইঞ্জিনের আকার আগে ২ হাজার সিসি এবং ২ হাজার ৪০০ সিসি ছিল; টার্বোচার্জার যোগ করার মাধ্যমে তা ১ হাজার ৫০০ সিসিতে নেমে এসেছে। তাই, সরকারকে কম শুল্ক ও কর দিতে হয়। এর ফলে, এই গাড়িগুলি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।'

এই গাড়ির জনপ্রিয়তার পেছনে কম শুল্ক কাটা একটি বড় কারণ। তবে টার্বোচার্জড গাড়িগুলোর সাম্প্রতিক গ্রহণযোগ্যতার পেছনে অন্যান্য কিছু কারণও রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গাড়িগুলোর মজাদার-টু-ড্রাইভ ফিচার, দারুণ কর্মদক্ষতা, কম দাম, কম এআইটি প্রদানের প্রয়োজন এবং অবশ্যই এদের আকর্ষণীয় নকশা। 

গত কয়েক বছর ধরে, বাংলাদেশের সড়কের কাঠামোরও বেশ উন্নতি হয়েছে। যা নতুন এবং অভিজ্ঞ উভয় ধরনের চালকের জন্যই ড্রাইভিংকে আরও আনন্দদায়ক করেছে। সেখানে, টার্বোচার্জড গাড়ি এই আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বাংলাদেশে জ্বালানির গুণমান এবং এর পরিণতি

টার্বোচার্জড গাড়ি চালানোর জন্য ভালো মানের জ্বালানি প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি দশম-প্রজন্মের হোন্ডা সিভিকের জন্য ন্যূনতম আরওএন ৯১-রেটেড জ্বালানী প্রয়োজন। এর কারণ, টার্বোচার্জার একটি ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের ভেতরে উচ্চ চাপ সৃষ্টি করে। সেজন্য, সর্বোত্তম ইগনিশন পয়েন্টে পৌঁছানোর আগে যেন জ্বালানীর অকাল বিস্ফোরণ না হয় সেটি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। শুধু উচ্চ-মানের জ্বালানীতেই এই বৈশিষ্ট্যটি পাওয়া যায়। তাই টার্বো মালিকরা উচ্চ-মানের জ্বালানী বেশি চেয়ে থাকেন। তবে, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক টার্বোচার্জড গাড়ি ব্যবহারকারী এখানকার জ্বালানির গুণমান নিয়ে অসন্তুষ্ট।

স্থানীয়ভাবে ভালো জ্বালানির প্রাপ্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাদি ফিলিং স্টেশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক সাইফুল ওসমান বলেন, 'ফিলিং স্টেশনগুলো ভালো জ্বালানির সরবরাহ পায় কি না তা বলা কঠিন। তবে মিক্সিং, টেম্পারিং বা ভেজাল না যোগ করলে ভালো জ্বালানি পাওয়া সম্ভব।' 
সাদি ফিলিং স্টেশন লিমিটেড, টার্বোচার্জড এবং নন-টার্বোচার্জড উভয় ধরনের গাড়িই নিয়মিত রিফুয়েল করে থাকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়, বিশেষ করে গাড়ি এবং গাড়ির মালিকদের নিয়ে গঠিত স্থানীয় ফেসবুক গ্রুপগুলোতে, নিম্ন-মানের জ্বালানি সম্পর্কিত সমস্যাগুলো নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আলোচনা হয়ে থাকে। 

এই খারাপ বা নিম্নমানের জ্বালানির পেছনে মূল কারণ কী? সাইফুলের মতে, 'ভেজাল এবং নিম্ন-গ্রেডের গ্যাসোলিন এবং কনডেনসেটের মিশ্রণের কারণে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির গুণমান হ্রাস পায়। অনেক ফিলিং স্টেশন তাদের জ্বালানীর রিজার্ভার ট্যাঙ্কগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে না। যার ফলে গাড়ি ব্যবহারকারীদের কাছে সরবরাহ করা জ্বালানির গুণমান হ্রাস পায়।'

আইওয়ার্কসবিডি নামের কার সার্ভিস কেন্দ্রের সিইও সাইফুল বলেন, 'আমাদের পরিষেবা কেন্দ্রে প্রতি সপ্তাহে আসা ৪০ থেকে ৪৫টি গাড়ির মধ্যে প্রায় ১০ থেকে ১৫টি গাড়ির খারাপ জ্বালানি সংক্রান্ত সমস্যা থাকে।' পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তার পরিষেবা কেন্দ্রে আসা সমস্যাযুক্ত গাড়িগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশই জ্বালানী সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসে। যদিও এই পরিসংখ্যানটি বিভিন্ন পরিষেবা কেন্দ্রে ভিন্ন হতে পারে। তবে আমরা স্থানীয়ভাবে সাধারণত যে জ্বালানি পাই, সে সম্পর্কে এটি একটি খারাপ ধারণা দেয়।

যেহেতু, ডিএইচএস মোটরস মূলত তাদের গ্রাহকদের কাছে টার্বোচার্জড গাড়ি বিক্রি করে থাকে; সে ক্ষেত্রে তারা কীভাবে জ্বালানি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে জানতে চাইলে মোমিন জানান, তারা প্রতি ৩ থেকে ৪ মাস অন্তর বিভিন্ন জ্বালানী স্টেশন থেকে জ্বালানীর নমুনা নেয়। তারপরে তারা নমুনাগুলো পরীক্ষা করে। ফলাফল পাওয়ার পরে, যেসব ফিলিং স্টেশনের জ্বালানীর গুণমান ভালো, তারা তাদের গ্রাহকদের সেখান থেকে জ্বালানি নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। 

এই সমস্যার সমাধান কী?

খারাপ জ্বালানি পাওয়ার পরেও মানুষ টার্বোচার্জড গাড়ি কেনা বন্ধ করছে না।  কিন্তু দিন শেষে, যদি ভাল জ্বালানী সরবরাহ করা না হয়, তাহলে টার্বোচার্জড গাড়িগুলো এর সর্বোত্তম কর্মদক্ষতার সঙ্গে চলতে পারে না। যার ফলে দেখা যায় অনেক সময়, একটি টার্বোচার্জড গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ জ্বালানি পাওয়ার পর ঠকঠক শব্দ করে এবং ঝাঁকুনি দেয়।

তাহলে সমাধান হিসেবে কী টার্বোচার্জড গাড়িতে ইসিইউ (ইলেকট্রিক কন্ট্রোল ইউনিট) রিপ্রোগ্রামিং করা যেতে পারে? যাতে করে তাদের উচ্চ আরওএন-রেটেড জ্বালানির প্রয়োজন না হয়? সাইফুল এর উত্তরে বলেন, 'এটা কাজ করবে কি না আমি নিশ্চিত না। তবে আমি একজন অনুমোদিত গাড়ি ব্যবসায়ী সম্পর্কে জানি, যিনি তাদের কিছু গাড়ির ইসিইউকে পুনরায় প্রোগ্রাম করেছেন। তবে, এর থেকে কোনোপ্রকার সুবিধা পাওয়া যায়নি। তাদের গাড়ির এখনো অনেক সমস্যা এবং কম জ্বালানি দক্ষতা রয়েছে।'

তবে সাইফুল টার্বোচার্জড গাড়ি ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু কৌশল এবং টিপস শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, 'আপনি যাতে আপনার গাড়িতে খারাপ জ্বালানি দিয়ে পূর্ণ না করেন, সে সম্পর্কে সতর্ক থাকার চেষ্টা করুন। ভালো মানের এয়ার ফিল্টার এবং ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করুন। ইঞ্জিন অয়েল অবশ্যই খাঁটি হতে হবে এবং এতে 'এপিআই এসপি' বা 'এপিআই এসএন প্লাস' স্পেসিফিকেশন থাকা উচিত। এ ছাড়া ৩ হাজার কিলোমিটার পর পর তেল পরিবর্তন করুন।'

তবে দুঃখের বিষয় এই, খারাপ জ্বালানির কারণে আপনার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হলে এর কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। অনেকে অকটেন বুস্টার এবং অন্যান্য সংযোজন ব্যবহার করেন। কিন্তু এগুলো দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সমাধান দেয় না। একমাত্র সমাধান হল উচ্চ-মানের জ্বালানি ব্যবহার করা, যা আমরা নিয়মিত পাচ্ছি না। 

আমরা যা করতে পারি তা হলো, টার্বোচার্জড গাড়ি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যে তারা নিয়মিত কোথা থেকে জ্বালানি নিয়ে থাকে। এ ছাড়া, ফুয়েল সিস্টেম সার্ভিসিং আরও ঘন ঘন করতে পারেন। তার ওপর, কম্বাশন প্রক্রিয়া চলাকালীন অপূর্ণ জ্বালানী থেকে তৈরি জমা কার্বনগুলো আস্তে আস্তে জমতে থাকে। তাই নিয়মিত কার্বন পরিষ্কার করেও আপনি গাড়ির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন।

অনুবাদ: আহমেদ বিন কাদের অনি

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

12h ago