ঢাকায় বাস সংকটে বাড়ছে ছোটগাড়ি, বাড়ছে যানজটও

বাস ও মিনিবাসের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে ঢাকা শহরে। গণপরিবহনের এই সংকটে প্রতিদিনই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।

ঢাকার ১১০টি রুটের জন্য বাস-মিনিবাসের অনুমোদিত সীমা সাত হাজার ৪৩। প্রয়োজন ও রুটের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সরকারি একটি কমিটি এই সীমা প্রস্তাব করেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব রুটে বর্তমানে মাত্র সাড়ে চার হাজার যানবাহন চলাচল করছে, যা প্রয়োজনীয় সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।

ফলে অনেক যাত্রী প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও রিকশার মতো ছোট যানবাহনের দিকে ঝুঁকছেন, যা রাজধানীর তীব্র যানজটকে তীব্রতর করে তুলছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সোহেল মাহমুদ তার ফার্মগেটের অফিস থেকে পুরান ঢাকার বাসায় যাতায়াতে গণপরিবহন ব্যবহার করতে গিয়ে এখন যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা নিয়ে বলেন, 'এক বছর আগেও রাত ৯টার দিকে ফার্মগেটে প্রতি ১০ মিনিট পরপর (৩ নম্বর রুটের) বাস ছিল। এখন আমাকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। কখনো কখনো আধঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়।'

চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং অপরিচ্ছন্ন-আঁটসাঁট আসনের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, গণপরিবহনের পরিষেবার মানও অত্যন্ত খারাপ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ এবং কর্মকর্তারা বর্তমান পরিস্থিতি পেছনে প্রধানত বাসের জন্য নতুন রুট অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিরতি এবং পরিবহন নেতাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবকে দায়ী করেছেন।

তারা আরও বলেন, মেট্রোরেল চালুর পাশাপাশি পরিবহন খাতের চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের এ খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে।

তাদের মতে, যানজট পরিস্থিতির অবনতির পেছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে এলোমেলো বাস রুটগুলোকে যথাযথ করতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা এবং বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি সিস্টেম চালু করতে না পারা।

গত এক দশকে সব বাসকে একক বা কিছু নির্দিষ্ট কোম্পানির আওতায় আনার ব্যবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক আলোচিত হলেও তা চালু করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।

জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি ২০২২ অনুসারে, ঢাকা শহরে এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি লোক বসবাস করে। তবে বর্তমান এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে মনে করা হচ্ছে।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, শহর ও সংলগ্ন এলাকায় ৩৮৬টি অনুমোদিত রুট থাকলেও এর মধ্যে কেবল ১১০টি এখন চালু রয়েছে। কারণ কর্তৃপক্ষ প্রায় এক দশক আগেই এই রুটগুলোর অনেকগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি এক করে দিয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বাধীন সরকারি সংস্থা ঢাকা মেট্রো প্যাসেঞ্জার অ্যান্ড গুডস ট্রান্সপোর্ট কমিটির কাছ থেকে পাঁচ হাজার ৫৯৪টি বাস রুট পারমিট পেয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর এক কর্মকর্তা জানান, ধারণক্ষমতা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ১১০টি রুটে সাত হাজার ৪৩টি বাস-মিনিবাসকে রুট পারমিট দেওয়ার সুপারিশ করেছে সরকারি কমিটি।

কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি নতুন বাসকে রুট পারমিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রুটগুলোকে যৌক্তিক করে একটি পাইলট প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

২০ বছরের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিক্রম করে ফেলায় এক হাজার ১৫০টি বাস-মিনিবাসের রুট পারমিট ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। বিআরটিএর এই কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় চার হাজার ৪৪৪টি বাস চলাচলের অনুমতি রয়েছে।

'পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ থাকা শহরে বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে বড় কারণ', বলেন তিনি।

রুট পারমিট দেওয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'আমরা এখন কমিটি পুনর্গঠনের জন্য কাজ করছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের পরে আমাদের কাজ পুনরায় শুরু হবে।'

চলমান পরিস্থিতিতে বা ঘাটতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত ২৪ অক্টোবর সরকার সারাদেশে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন প্রত্যাহারের জন্য ছয় মাস সময় দেয়।

সিন্ডিকেট

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন নেতা বলেন, পরিবহন মালিকদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে মোটা অঙ্কের টাকা না দিয়ে কেউ রুট পারমিট না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা বাস পরিচালনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

তিনি বলেন, একটি চক্র সুফল পেতে এ খাতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখেছে।

উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল সার্ভিস চালু করাও এই রুটে বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন এই পরিবহন নেতা।

বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, নগরীর অধিকাংশ বাস মালিক দৈনিক চুক্তিতে চালকদের গাড়ি ভাড়া দেন।

'ট্রিপ-ভিত্তিক পরিষেবা' নামে পরিচিত এই সিস্টেমে চালকরা প্রতিদিনের ট্রিপের ভিত্তিতে মালিককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে থাকে। যত বেশি ট্রিপ দিতে পারবে, তত বেশি মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে চালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন, যা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে।

এই ব্যবস্থার ফলেই রাজধানীর বাস পরিষেবার উন্নতি হয়নি বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাস সার্ভিসের পরিবর্তে মেট্রোরেলের মতো ভারী বিনিয়োগ প্রকল্প অগ্রাধিকার পেয়েছে।

'মেট্রোরেলের একটি লাইন চালু হয়েছে এবং আরও দুটি নির্মাণাধীন। যদি বাসের রুটগুলো যথাযথভাবে সক্রিয় করা যায়, তাহলে মেট্রোরেলের তিনটি লাইনে যে পরিমাণ যাত্রী যাতায়াত করবে, তারচেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি যাতায়াত করতে বাসেই।'

তিনি আরও বলেন, মেট্রো লাইন নির্মাণে যেখানে দেড় লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে, সেখানে বাস সার্ভিস উন্নত করে লন্ডন শহরের মতো করতে চাইলে প্রয়োজন হবে মাত্র আট হাজার কোটি টাকা।

'কিন্তু বাস সার্ভিস অগ্রাধিকার পায়নি, যা আগের সরকারের 'নীতিগত অপরাধ',' গত ২৬ অক্টোবর ডেইলি স্টারকে বলেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন।

বাড়ছে ছোটগাড়ি, বাড়ছে যানজটও

বাস-মিনিবাসের রেজিস্ট্রেশন কমলেও বাড়ছে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা।

বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ঢাকা মহানগরীতে মোট ৮৯৩টি বাস-মিনিবাস নিবন্ধিত হয়েছে। ২০২৩ সালে এক হাজার ৮৮৭টি এবং ২০২২ সালে নিবন্ধিত হয়েছে দুই হাজার ২৩৩টি বাস-মিনিবাস।

অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয়েছে ৫৮ হাজার ৬৩৪টি ও প্রাইভেটকারের সংখ্যা সাত হাজার ৩৮৪। গত বছর এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯০ হাজার ৪০৩ ও নয় হাজার ৬৮৭।

এ ছাড়াও নগরীতে রিকশা বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেড়েছে।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বাসের ঘাটতিকেই ছোট যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মনে করছেন, যার ফলে বেড়েছে যানজটও।

তিনি বলেন, যানজট নিরসনে বাস সার্ভিসের উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা বাস পরিষেবায় শৃঙ্খলা আনতে বাসের রুট যৌক্তিকীকরণ এবং একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি সিস্টেম প্রবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

এসব পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হয় এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের আমলে তা আরও গতি পায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তার মৃত্যুর পর এই উদ্যোগ গতি হারায়।

২০১৯ সালের জুনে দেশের সব মেট্রোপলিটন শহরে বাস সার্ভিসকে ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির আওতায় আনার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার ঘাটারচর-কাঁচপুর রুটে একটি বাস ফ্র্যাঞ্চাইজি পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। পরে প্রকল্পে আরও দুটি রুট যুক্ত করা হয়।

অধ্যাপক মোয়াজ্জেম বলেন, প্রায় তিন বছর পর এই ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করতে না পারায় স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বাস সার্ভিস আগের সরকারের অগ্রাধিকার ছিল না।

Comments

The Daily Star  | English

Crowd control: Police seek to stop use of lethal weapon

The police may stop using lethal weapons and lead pellets for crowd control as their widespread use during the July mass uprising led to massive casualties and global criticism.

10h ago