হাওরের বুকে উন্নয়নের কুড়াল
অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে গত ১ দশকে নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বেশ কিছু সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এর কোনো কোনোটি হাওরের পাশ দিয়ে, কোনোটি আবার হাওরের ঠিক মাঝ দিয়ে। বড় বড় মানুষরা গিয়ে এসব সড়কের উদ্বোধনও করেছেন।
এলাকার অধিকাংশ মানুষ এসব সড়ক নির্মাণে উল্লসিত হলেও কিছু পরিবেশবোদ্ধা শুরু থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কায় এই প্রকল্পগুলোর সমালোচনা করে আসছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই কর্তৃপক্ষ তাদের কথায় কান দেয়নি। কিন্তু অবশেষে সরকার স্বীকার করেছে, এসব সড়ক নির্মাণ ঠিক হয়নি।
সম্প্রতি খোদ পরিকল্পনামন্ত্রীই হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ যে হিতকর হয়নি তা মেনে নিয়ে বলেছেন, 'এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে বেশি।' ২০ মে রাজধানীর প্রেসক্লাবে 'সেন্টার ফর হলিস্টিক স্টাডিজ' আয়োজিত 'পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার' শীর্ষক ১ সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এসব কথা বলেন। (প্রথম আলো, ২০ মে, ২০২৩)।
দেরিতে হলেও সত্য উপলব্ধির জন্য পরিকল্পনামন্ত্রী প্রশংসার দাবি রাখতেই পারেন। কিন্তু এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যেই পরিবেশের যে অপরিমেয় ক্ষতিটা হয়ে গেছে, তার প্রতিকার কী হবে? কিংবা যে বা যারা এই ভয়ংকর কাজের জন্য দায়ী তাদের কী হবে? মন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন, সড়কের কারণে হাওরে পানির চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষার সময়ে পানি উপচে বাড়িঘরে উঠছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। হাওরের নিজস্ব প্রজাতির মাছ, গাছ-হিজল, কড়চ, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রাণী-বৃক্ষ ধ্বংস হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এসব প্রকল্প গ্রহণের আগে এগুলো পরিবেশের ওপর কী প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে সে বিষয়ে কি কোনো স্টাডি করা হয়নি? আমি যতটুকু জানি, যে কোনো ধরনের বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণের আগে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে স্টাডি করার কথা। এর জন্য প্রকল্প প্রাক্কলনে মোটা অঙ্কের টাকাও বরাদ্দ রাখা হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ পরামর্শক।
আমি নিশ্চিত, হাওরের মাঝ দিয়ে যেসব রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে সেসবের কাজ শুরুর আগেও একই নিয়ম মানা হয়েছে। যদি তা করা হয়ে থাকে তাহলে সেসব স্টাডির ফলাফল জনগণের সামনে তুলে ধরার দাবিটা কি খুব অযৌক্তিক হবে? আর পরামর্শকরাই বা কী সুপারিশ রেখেছিলেন? যদি সরকারের নিয়োগ করা পরামর্শকরা এসব প্রকল্প গ্রহণের পক্ষে মত দিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও কি খুব একটা ভুল হবে? আর তারা যদি এসবের বিরুদ্ধেই মত দিয়ে থাকেন, তাহলে এসব প্রকল্প নেওয়া হলো কেমন করে? এর পেছনে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে তা কি একজন মন্ত্রীর ভুল স্বীকারেই পরিশোধযোগ্য? জনগণের ট্যাক্সের টাকার এমন শ্রাদ্ধ বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
শুধু হাওরের বুকের সড়কই নয়, সারাদেশেই সড়ক আর সেতু নির্মাণ নিয়ে চলছে এলাহী কাণ্ড। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা বিবেচনা না করেই জনপ্রিয়তা লাভের জন্য চলছে সেতু তৈরির মহোৎসব। কারণ সেতু জিনিসটা সহজেই চোখে পড়ে। আর সেকারণেই তা ভোটের সময় টনিকের মতো কাজ করে। গত ৫ মে দৈনিক যুগান্তরে 'সেতু আছে সড়ক নেই' শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারাদেশে এমন অনেক সেতু রয়েছে যেগুলোর সংযোগ সড়কই নেই। ফলে এসব সেতু মানুষের কোনো উপকারেই আসছে না। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে অনেক সেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে। ভেঙে যাচ্ছে সেতুর রেলিং।
কোথাও সেতুতে উঠতে মই, কোথাও কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করছেন তারা। আবার কেউ নৌকায়, কেউ কাদা-পানি ডিঙিয়ে নদী-খাল পার হচ্ছেন। এই প্রতিবেদনেই দেখা যায়, নেত্রকোণার মদনে ৬ কিলোমিটার সড়কে ১১ সেতুতেই নেই সংযোগ সড়ক। এসব সেতুর মধ্যে বয়রাহলা নদীর লড়িভাঙা এলাকার সেতুটি পারাপারে স্থানীয়দের ভরসা বাঁশের সাঁকো। হবিগঞ্জের লাখাইয়ে বামৈ ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রামে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ব্রিজ এখন মানুষের গলার কাঁটা। সংযোগ সড়ক না থাকায় নির্মাণের প্রায় ১৬ বছর অতিবাহিত হলেও ব্রিজটি ১ দিনের জন্যও মানুষের কোনো কাজে আসেনি।
রাঙ্গামাটির লংগদুতে ১০ বছর আগে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত একটি সেতুর এখনও রাস্তার উন্নয়ন হয়নি। ফলে সেতুটি সম্পূর্ণ অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। একই অবস্থা যশোরের কেশবপুরে। প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে হরিহর নদের ওপর সেতু নির্মাণ করেছে এলজিইডি। কিন্তু ২ পাশে সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতু দিয়ে চলাচল করতে পারছেন না ৮ গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার রুলদহ-মানন্দ সড়কে ১ দশক আগে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতুটি এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসছে না।
একইভাবে জেলার সাঁথিয়া উপজেলার রাস্তায় নির্মিত সেতুর ২ পাশে মাটি না থাকায় স্থানীয়রা সেতুটি ব্যবহার করতে পারছেন না। শেরপুরের নালিতাবাড়ী পৌরসভার মেহগিনি সড়কের সেতুটিতে আশ্রয় নিয়েছে ১৪টি ভূমিহীন পরিবার। ৫ বছরেরও বেশি সময় তারা সেতু দখল করে বসবাস করছে। ফলে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি কাজে আসছে না। নাটোরের বড়াইগ্রামে সংযোগ সড়ক না থাকায় ১২ বছর ধরে অকেজো পড়ে আছে চান্দাই ইউনিয়নের কাটা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি।
সারাদেশ জুড়ে এমন অসংখ্য অপরিকল্পিত প্রকল্পের উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আসলে আমাদের দেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের পরিবর্তে তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের কথা বিবেচনায় রেখেই অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আর অনেক সময়ই এর পেছনে কাজ করে ভোটের রাজনীতি। যে প্রকল্প গ্রহণ করলে খুব সহজে জনগণের চোখে রঙিন চশমা পরিয়ে দেওয়া যায়, যাতে তারা নিজেদের ভালোমন্দটুকু ভালোভাবে বুঝতে না পারে, সেসব প্রকল্পই বেশি নেওয়া হয়। এসব প্রকল্পের সুদুরপ্রসারী ফল যাই হোক না কেন, ভোটের নদীতে স্রোত তৈরিতে বেশ ফলপ্রসূ- এ কথাটা রাজনীতিবিদরা ভালোই জানেন।
কখনো আবার রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে খুশি করার জন্যও অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। রাজনীতিবিদদের এই মানসিকতার সুযোগ নেন কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। কখনো তারা নিজেরাও নিজেদের আখের গোছানোর জন্য দূরদৃষ্টিহীন নেতাদের এসব প্রকল্প নিতে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করেন। এক কথায়, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আর দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিবিদের যৌথ স্বার্থের ফসল এসব প্রকল্প। এ ছাড়াও সরকারের কাজের মধ্যে দ্বৈতকরণ তো হচ্ছেই, যেমনটি পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। তার মতেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কাজে দৃশ্যমান সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে, গভীরভাবে অনেক কিছু দেখা হয় না।
সব চাহিদা পূরণ না করেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই দেশের সাধারণ জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, স্ফীত হচ্ছে দুর্নীতিবাজদের ব্যাংকের হিসাব, দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারণ মানুষের। পরিকল্পনামন্ত্রী যে বলেছেন, হাওরের মাঝ দিয়ে সড়ক নির্মাণ করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন, আসলে কুড়াল মারা হয়েছে হাওরের বুকে। কারণ প্রকৃতিকে বৈরী করে কেউ টিকতে পারে না, প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করেই বাঁচতে হয়। সেজন্য দরকার রাজনীতি ও প্রযুক্তির যথাযথ সমন্বয়। তা না হলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেবেই। তবে দেরিতে হলেও যে সরকারের বোধোদয় হয়েছে, এ জন্য মন্ত্রী মহোদয়ের নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ প্রাপ্য। আমরা আশা করতেই পারি, ভবিষ্যতে এমন প্রকল্প গ্রহণে সরকার জনপ্রিয়তা নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর চিন্তাচেতনাকে আরও বেশি প্রাধান্য দেবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। মনে রাখতে হবে, হাওরকে থাকতে দিতে হবে হাওরের মতোই খেয়ালি, আদিম ও প্রাকৃতিক। তা না হলে হাওরের বুকে মন্ত্রীর ভাষায় 'কুড়ালের ঘা' কখনো শুকোবে না।
মোশতাক আহমেদ, সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments