হাওরাঞ্চলের মানুষ কি ক্লাইমেট রিফিউজি হবে?
শতাব্দীর প্রলয়ংকরী বাইশের ভয়াল বন্যার স্মৃতি সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষের মনে এখনও দগদগে। এরই মধ্যে চলতি বছরে সিলেট-সুনামগঞ্জে আবারও বন্যার পদধ্বনি। টানা এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। জুন-জুলাই বর্ষা মওসুমে বৃষ্টিপাত এমনকি সহনীয় বন্যা স্বাভাবিক এবং প্রকৃতিসিদ্ধ। কিন্তু সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণার হাওরাঞ্চলে আকস্মিক পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা, ফসলহানি এখন প্রতি বছর উদ্বেগের কারণ।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতপ্রবণ এলাকা মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জির ঢালে ভাটির এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক জলধারা নদী, খাল ও হাওর পলিমাটিতে ভরাট হওয়ায় পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যা এখন প্রায় প্রতি বছরই দেখা দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সমুদ্র উপকূলের মতো এই অঞ্চলের মানুষেরও ক্লাইমেট রিফিউজি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
ক্রমাগত বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের বসবাসের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে নিয়ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী Anthony Giddens তার 'The Environmnt and Risk' শীর্ষক এক আলোচনায় বলেছেন, 'আমাদের সময়ের পরিবেশগত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যদি সত্যি হয় তাহলে উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশকে অর্থাৎ মানবগোষ্ঠীকে একের পর এক বিধ্বংসী ও ভয়ংকর পরিণতির সম্মুখীন করে তুলবে। আর এ বিধ্বংসী ফলাফল কোনো নির্দিষ্ট এলাকা নয় বরং বিশ্বব্যাপী অনুমিত হবে।' গিডেন্স তার গবেষণায় বলেন, উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিকর প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো: ১. সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া, ২. বিশাল পরিমাণ উর্বর ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা (যার মধ্যে শস্যভাণ্ডারখ্যাত হাওরাঞ্চল পড়ে), ৩. মহামারি আকারে রোগ-বালাই বৃদ্ধি, ৪. ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া ইত্যাদি। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সমতল ভূমি, জলাভূমি, হাওড়-বাওর ফসল উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র, ৫. বন্যা, খরা ও দুর্যোগ বৃদ্ধি (অকাল বন্যা ও খরা হাওরাঞ্চলে সারা বছর এক ফসল নির্ভর মানুষের জীবনের জন্য বিশাল হুমকি হিসেবে দেখা দেবে), ৬. ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। গিডেন্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের এক রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে আরও বলেছেন, 'বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষজন ব্যাপকহারে নিরাপদ এলাকায় অভিবাসন ও স্থানান্তর হবে।' যা নিরাপদ এলাকার মানুষের জন্যও দুশ্চিন্তার বিষয়। দুর্যোগের অভিঘাত সবাইকে সইতে হবে।
মেঘালয় রাজ্যের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় মৌসিনরাম ও চেরাপুঞ্জিতে। এই দুই এলাকা সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় এবং পাহাড়ি নদী চেলা দিয়ে প্রবল স্রোত সুরমা নদীতে এসে মেশায় নদীতে হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া গোয়াইন নদী, পিয়াইন, সারি নদী, বরাকসহ অনেকগুলো সীমান্তবর্তী নদীর পানি প্রবাহ সুরমায় এসে মিলিত হয়। ফলে সুরমা নদী উপচে নদী তীরবর্তী জনপদে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। ফলে গত বছর সিলেট শহরও তলিয়ে গেছে। সিলেটে এখন পরিকল্পিত শহররক্ষা বাঁধ জরুরি। জরুরি সুরমা নদীর খনন। সিলেট-সুনামগঞ্জে ইতিহাসের প্রলয়ংকারী বন্যার পর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হাওরাঞ্চলের নদী, খাল খনন, বন্যা মোকাবেলায় রাস্তাঘাট, পাওয়ার স্টেশন, আশ্রয়ণ, টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় সরকারের নানামুখী মেগা প্রজেক্ট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি ছিল। এই ভয়াল বন্যা-অভিজ্ঞতার পরও সরকার, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের এ নিয়ে বেশ নির্বিকার মনে হচ্ছে।
লেখক: কবি ও গবেষক
alo.du1971@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments