বর্ষায় ঘুরে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর
এই বর্ষায় টইটম্বুর হাওরের জলে ভেসে বেড়িয়ে নৌকার চালে বৃষ্টির মৃদু ছন্দ শুনতে ঘুরে আসতে পারেন টাঙ্গুয়ার হাওর। এটি সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি।
কয়েক বছর আগেও এই হাওরে ভ্রমণ, থাকা সবকিছুই ছিল বেশ কষ্টকর। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্য ও চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে হাওর ভ্রমণের জন্য এখন মিলছে নানা সুযোগ-সুবিধা, যা ভ্রমণকে করেছে সহজ ও আরামদায়ক।
বর্ষাকাল এই হাওর ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। মেঘালয়ের ঢলে নেমে আসা পানিতে তখন হাওর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। এই জলরাশির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে হিজল ও করচগাছের বন। তখন হাওরের গ্রামগুলোকে মনে হয় যেন পানির ওপর ভেসে থাকা ক্ষুদ্র কিছু দ্বীপ। দূরে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, ঝর্ণা থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানি, মৃদুমন্দ ঢেউ, অগণিত পাখির কলতান পর্যটকদের মন ভুলিয়ে দেয়।
টাঙ্গুয়া যেতে প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। ফকিরাপুল, সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন, মামুন পরিবহনের বাসগুলো সুনামগঞ্জ যায়। নন এসি বাসের ভাড়া পড়বে ৬৫০-৭৫০ টাকা। বাসে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে ৬ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়া
সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত বড় ব্রিজের কাছে লেগুনা/সিএনজি/বাইক করে তাহিরপুরে যাওয়া যায়। সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে আকার ও সামর্থ্য অনুযায়ী ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করতে হবে।
বর্তমানে হাওর ভ্রমণের জন্য রয়েছে বেশ কিছু আধুনিক হাউজ বোট। হাউজ বোট ভাড়া করতে হলে আগে থেকেই বুকিং করতে হয়। হাউজ বোটে ভ্রমণ করতে চাইলে আপনার কাজ হবে শুধু সুনামগঞ্জ বা তাহিরপুর পৌঁছানো। এরপর ভ্রমণের সব দায়িত্ব হাউজ বোটের।
হাউজ বোট সুনামগঞ্জ শহরের সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে ছাড়বে নাকি তাহিরপুর থেকে ছাড়বে তা আগে থেকেই জেনে নিতে হবে। সাহেব বাড়ি ঘাট থেকেই হাউজবোট ছাড়লে তখন কষ্ট করে তাহিরপুর যাবার প্রয়োজন পড়ে না।
নৌকা ভাড়া
নৌকার ভাড়া কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন নৌকার আকার, ধারণক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা, মৌসুম ইত্যাদি। এছাড়াও ছুটির দিনে ভাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকে।
এক রাত থাকার জন্য ছোট নৌকাগুলোর ভাড়া পড়ে ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা, মাঝারি আকারের নৌকাগুলোর ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার এবং বড় নৌকাগুলোর ৮ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার মতো।
বর্তমানে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে আসার জন্য প্রায় অর্ধশতাধিক আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন হাউজবোট রয়েছে। এই হাউজবোটগুলোতে খাওয়া-দাওয়া, রাতে থাকাসহ ২ দিন ১ রাত ভ্রমণের সমস্ত ব্যবস্থা থাকে। খরচ হবে জনপ্রতি ৬-৮ হাজার টাকা। তবে দল যদি অনেক বড় হয়, যেমন ১৬-২০ জনের মতো হলে তখন জনপ্রতি ভাড়া অনেকটাই কমে আসবে। তখন জনপ্রতি ৪ হাজার -৫ হাজার টাকার মতো খরচ হবে।
প্রয়োজনীয় সামগ্রী
নৌকা ভাড়া করার সময় লাইফ জ্যাকেট, টয়লেট ব্যবস্থা, রান্নার চুলা, লাইট-ফ্যান, বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য শামিয়ানা ইত্যাদি ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখে নিতে হবে। তাহিরপুর বাজারে আইপিএস ও লাইফ জ্যাকেট ভাড়া পাওয়া যায়। নৌকায় যদি বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও লাইফ জ্যাকেট না থাকে তবে সেগুলো ভাড়া করে নিতে হবে।
এ ছাড়াও টাঙ্গুয়ার হাওরে বর্ষাকালে বেশ শীতল বাতাস থাকে এবং রাতের বেলা কিছুটা ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। তাই একটি চাদর কিংবা রাতে গায়ে দেওয়ার কাঁথা নেওয়া ভালো। আর হাওরের আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখার সময় বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে নেওয়া উচিত।
খাবারের ব্যবস্থা
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এবং টেকেরঘাটে বেশকিছু খাবার হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে হাওরের প্রায় ২০-৩০ প্রজাতির মাছ, শুঁটকি আর হাঁসের মাংসের নানা পদ দিয়ে চাইলে সকাল কিংবা দুপুরের আহার পর্ব সারতে পারবেন। আর টেকেরঘাটে যদি রাত্রিযাপন করা হয় তবে রাতের আহারও এখানেই সেরে নেওয়া সম্ভব।
আর যদি নৌকাতেই রাত্রিযাপন করা হয় তবে রান্নার ব্যবস্থা নৌকাতেই করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে নৌকায় উঠার আগেই তাহিরপুর বাজার থেকে প্রয়োজনীয় বাজার করে নিতে হবে। তবে তাজা মাছ কেনার জন্য হাওরের মাঝের ছোট ছোট দোকানগুলো আদর্শ জায়গা। মাঝিকে বললে এই দোকানগুলো চিনিয়ে দেবে।
নৌকায় নিজেরাই রান্না করা যায় আবার রান্নার জন্য তাহিরপুরে বাবুর্চিও ভাড়া পাওয়া যায়। অনেক নৌকার মাঝিরাই রান্না করে দিতে আগ্রহী হন। এসব বিষয়ে তাই নৌকায় উঠার আগে মাঝির সঙ্গে আলাপ করে নেওয়া উচিত।
আর যদি হাউজবোটে থাকা হয় সেক্ষেত্রে খাবার নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে না। খাবারের সব ব্যবস্থা হাউজবোটের স্টাফরাই করে থাকেন। খাবারের মেনুও সাধারণত আগে থেকেই জানানো হয়। মেনুতে কোনো পরিবর্তন করতে চাইলে আগে থেকেই কথা বলে নিতে হয়।
দর্শনীয় স্থান
হাওর ভ্রমণকালে পানিতে না নামলে ভ্রমণ অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ওয়াচটাওয়ার এলাকায় এসে পানিতে নেমে আশপাশের জলাবনে ঘুরে বেড়ানো যায়। ওয়াচটাওয়ারের ওপরতলায় উঠে হাওর অঞ্চলের সৌন্দর্য বেশ ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যায়।
এরপর নৌকায় করে টেকেরঘাট এলাকায় চলে যেতে হবে। এখানে দেখতে যেতে পারেন অপার্থিব সৌন্দর্যের নীলাদ্রি লেক। একদিকে টিলা-পাহাড়ের সমারোহ আর অন্যদিকে স্বচ্ছ নীল জলের হ্রদ- সব মিলিয়ে এটি যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের আধার।
নীলাদ্রি লেক থেকে সিএনজিতে করে চলে যেতে পারেন লাকমাছড়া। ভারত সীমান্তঘেঁষা এই এলাকায় দেখা যাবে মেঘে আচ্ছাদিত সবুজ সব পাহাড় আর পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানির ঝর্ণাধারা।
এ ছাড়া পরদিন বারিক টিলা ও যাদুকাটা নদী দেখতে যেতে পারেন। পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন শিমুল বাগানে। তবে যেখানেই যেতে চান না কেন নৌকার মাঝিকে ভ্রমণের শুরুতেই সবকিছু জানিয়ে রাখতে হবে।
ভ্রমণের জন্য আরও কিছু পরামর্শ
সুন্দরবনের পর টাঙ্গুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় 'রামসার সাইট' । তাই আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই হাওর ভ্রমণকালে পরিবেশের যেন কোন ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
বর্ষাকালে যেকোনো সময়ে ঝড় শুরু হতে পারে। নৌকায় ভ্রমণকালীন আকাশে মেঘ ডাকলে বা বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে নৌকার ছইয়ের নিচে অবস্থান করতে হবে। এ ছাড়াও বন্যা কিংবা বড় কোনো ঝড়ের আশঙ্কা থাকলে সেসব সময়ে কোনোভাবেই হাওর ভ্রমণ করা উচিত নয়।দুর্ঘটনা এড়াতে আবহাওয়ার খবর জেনে এরপরেই ভ্রমণের দিন-তারিখ ঠিক করা উচিত।
বাংলা বছরের ক্যালেন্ডার ঘুরে আষাঢ় চলে এসেছে, মেঘালয়ের পাহাড়গুলো থেকে পানি আসছে, সুনামগঞ্জের আকাশে সারাটা দিন মেঘেদের আনাগোনা- এমন অবস্থায় হাওর ঘুরে আসার সু্যোগ ছাড়বেন কেন?
Comments