স্বয়ংক্রিয় ‘কিলার রোবট’ কি ভবিষ্যত যোদ্ধা?

স্বয়ংক্রিয় ‘কিলার রোবট’ কি ভবিষ্যত যোদ্ধা?
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অভাবনীয় উন্নতির ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন এমন সব অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে, যেগুলো কোনো মানুষের নির্দেশনা বা সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিপক্ষ দলের সেনাদের চিহ্নিত ও হত্যা করতে পারবে। 

সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ইরানসহ অনেক দেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ধরনের অস্ত্র তৈরির পেছনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। ফলে মানবজাতি এখন যুদ্ধের এক নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।

এসব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত (অটোনোমাস) মারণাস্ত্রের কেতাবি নাম লিথ্যাল অটোনোমাস ওয়েপনস সিস্টেম (এলওডব্লিউএস), তবে সমালোচকরা এগুলোর নাম দিয়েছেন 'কিলার রোবট'।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে তুরস্ক 'কারগু-২' নামের একটি পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত ড্রোন দিয়ে লিবিয়ায় হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের নতুন যুগ শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও স্বয়ংক্রিয় ড্রোন বড় ভূমিকা পালন করছে। মস্কো এবং কিয়েভ উভয়ই বিপক্ষদলের সেনা ও সামরিক সরঞ্জামে হামলা করার জন্য অসংখ্য স্বচালিত ড্রোন ব্যবহার করছে।

এ ধরনের যন্ত্রের (অস্ত্র) ব্যাপক উত্থান বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞ, অধিকার কর্মী এবং কূটনীতিকদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি করছে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারের সম্ভাব্য সুবিধা এবং ঝুঁকিগুলি নিয়ে ভাবছে এবং কীভাবে ও কখন এসব অস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার থামানো উচিত, তা অনুধাবন করার চেষ্টা করছে।

কিন্তু দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক নানা বিভক্তির কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আদৌ এই ব্যাপারে কোনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারবে কি না বা ফলপ্রসু কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। এ ধরনের অস্ত্র যে নৈতিক, আইনি এবং প্রযুক্তিগত হুমকি তৈরি করে, তা যুদ্ধক্ষেত্রের দখল নেওয়ার আগেই কী থামানো জরুরি? এসব অস্ত্রের ওপর পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া কিংবা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা কী বাস্তবসম্মত উপায় হতে পারে?

সংক্ষেপে উত্তর হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের ব্যাপারে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তবে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশগুলো দিন দিন এসব অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করছে। দেশগুলো যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে যে ধরনের বৈশ্বিক ট্যাবু বা নেতিবাচক মানসিকতা রয়েছে, এখানেও তা সম্ভব।

এই ধরনের স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে সম্ভাব্য কী কী সুবিধা দিতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর সরকার ও সামরিক নের্তৃত্ব হয়তো উৎসাহী, তবে তাদের বাইরে এ ব্যাপারে তেমন কারও উৎসাহ নেই।

'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারবে না'

মার্চের শেষে দিকে লন্ডনভিত্তিক চ্যাথাম হাউসের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ইয়াসমিন আফিনা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দ্বিতীয় কক্ষ হাউস অব লর্ডসে বর্ণনা করেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ভুল করে আল জাজিরার এক সাংবাদিককে আল-কায়েদার সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র তখন ওই সাংবাদিককে তাদের নজরদারিতেও রেখেছিল। কিন্তু মার্কিন সরকার কখনো এটি নিজে থেকে স্বীকার করেনি। মানুষ এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছে ২০১৩ সালে অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা গোপন মার্কিন নথি থেকে। 

আফিনা তার বক্তব্যে বলেন, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের ওপর যে নজরদারি করা হয়েছিল, তা হয়তো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নয়, তবে এটিও একটি ঘাতক হতে পারত। 

'আপনি যদি তখন ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে অবশ্যই তা হতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন', বলেন আফিনা। 

ভবিষ্যতে যুদ্ধের উত্তেজনা ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এলএডাব্লিউএস যে বিভিন্ন চেইন রিঅ্যাকশন শুরু করতে পারে, তাতে উদ্বিগ্ন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ টবি ওয়ালশ। 

'আমরা যখন একটি অনিশ্চিত এবং প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে জটিল কম্পিউটার সিস্টেমগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে নিয়োজিত রাখি তখন কী ঘটে, তা আমরা জানি', ব্রিটেনের হাউজ অব লর্ডসে দেওয়া লিখিত বর্ণনায় বলেন ওয়ালশ। 

'ভবিষ্যত ঝুঁকি এবং অনাকাঙিক্ষত ফলাফল এড়াতে এ ক্ষেত্রে 'সার্কিট ব্রেকার' ব্যবহার করতে হবে। স্টক মর্কেটে অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শুধু লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে আমরা আরও ভয়াবহ দুরবস্থা এড়াতে পারি। কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের বেলায় এমন কিছু করে আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু ঠেকাতে পারব না।'

তবে গবেষকরা স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র নিয়ে গবেষণা বন্ধ করে দিক, সেটিও চান না ওয়ালশ। তিনি মনে করেন, অন্য ক্ষেত্রে এর ফলাফল ভোগ করা যেতে পারে। যেমন, পথচারী চিহ্নিত করতে স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে যে অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়, যুদ্ধরত সেনাদের চিহ্নিত করতে ও তাদের অনুসরণ করতে একই অ্যালগরিদম স্বায়ত্তশাসিত ড্রোনেও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

রাসায়নিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণে যেভাবে সফলতা পাওয়া গেছে, এখানেও একই উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে বলে মনে করেন ওয়ালশ। 

কেউ যখন রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেন, তখন তা বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের প্রধান শিরোনামে উঠে আসে এবং সর্বত্র তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। জাতিসংঘের কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন রাসায়নিক অস্ত্রের উন্নয়ন, উৎপাদন, বণ্টন ও মজুত নিষিদ্ধ করেছে। এ ছাড়া রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে ট্যাবু বা নেতিবাচক ধারণা আছে, সেটিও এই অস্ত্রের ব্যবহার সংকুচিত করেছে। 

ওয়ালশ বলেন, 'আমরা আবারও প্যান্ডোরাকে বাক্সবন্দি করতে পারি না। তবে এ ধরনের বিভিন্ন পদক্ষেপ বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার অনেকটাই সীমীত করেছে।'

লাভ ও ঝুঁকি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নির্ভর স্বায়ত্তশাসিত  অস্ত্র কিছু ব্যাপারে যুদ্ধক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যেমন- যুদ্ধক্ষেত্রে এসব অস্ত্র ব্যবহারের ফলে সেনাদের সংশ্লিষ্টতা কমানো যাবে। এতে তাদের জীবন বাঁচবে। যারা এসব অস্ত্রের সমর্থনে কথা বলছেন, তাদের যুক্তি হচ্ছে এসব জটিল ও সূক্ষ্ম অস্ত্রের সাহায্যে মনুষ্য সৃষ্ট ত্রুটি ও পক্ষপাতিত্ব এড়ানো সম্ভব হবে। লক্ষ্যমাত্রায় আরও নিখুঁতভাবে আঘাত হানা গেলে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হবে। 

তবে অনেক বিশ্লেষক ও অধিকার কর্মীরা এসব সম্ভাবনার চাইতেও এলএডাব্লিউএসের নেতিবাচক দিকটিই বেশি গুরুত্বসহকারে দেখছেন। তাদের যুক্তি হচ্ছে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি হলে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে গভীরভাবে না জানা এসব  স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র ভয়াবহ কোনো কাজ করে বসতে পারে। তার ওপর আবেগহীন কোনো যন্ত্রকে মানুষের জীবন-মৃত্যুর ফলসালার ভার দিতেও রাজি নন তারা। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে জবাবদিহিতা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের জবাবদিহিতা কে এবং কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?

২০১৯ সালে বিশ্বের ১২৬টি দেশ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝুঁকি বিবেচনায় জাতিসংঘের নিযুক্ত একদল বিশেষজ্ঞের অনুমোদিত ১১টি নীতিমালার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে। এসব নীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এই জাতীয় অস্ত্রের সম্ভাব্য বিকাশের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে প্রযোজ্য হবে। তবে যুদ্ধের সময় এই আইন কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান। যদি কোনো রোবট যুদ্ধাপরাধ সংঘঠিত করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট রোবটের কমান্ডিং অফিসারকে এজন্য দায়বদ্ধ করা হবে? নাকি তারও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যারা এসব রোবটকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে? নাকি এসব রোবট যারা তৈরি করেছে, তাদের জবাবদিহি করতে হবে?

গত মার্চ মাসে গবেষক ভিনসেন্ট বুলানিন এবং মার্টা বো স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই ত্রুটিগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। 

এমনকি 'স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র ব্যবস্থা'র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো সংজ্ঞাও নেই। যদিও বেশিরভাগ দেশ একমত যে এ ক্ষেত্রে 'গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো সিস্টেমটি মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত, বাঁছাই এবং হামলা করতে সক্ষম হবে।'

এসআইপিআরআইয়ের গভর্নেন্স অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স প্রোগ্রামের পরিচালন বুলানিন বলেন, 'এখনই এমন অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, যা এই বর্ণনার সঙ্গে মানানসই। একটা উদাহরণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ভূমি থেকে আকামশে নিক্ষেপণযোগ্য এমআইএম-১০৪ প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যা সৌদি আরব, ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেকগুলো দেশ ব্যবহার করছে।' 

বুলানিন বলেন, 'আমরা একটি সম্ভাব্য ক্ষমতা সম্পর্কে কথা বলছি, একটি ফাংশনের কথা বলছি যা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবস্থায় ব্যবহার করা যেতে পারে, যা বিভিন্ন আকারে ব্যাবহৃত হতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের মিশনে ব্যবহার করা যেতে পারে। সুতরাং আপনি যদি কোনো কিছু নিষিদ্ধ করতে চান তবে আপনাকে ঠিক সেই ধরনের অস্ত্র শনাক্ত করতে হবে, যেটিকে আপনি সমস্যাযুক্ত বলে মনে করেন।'

তিনি বলেন, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে, ২ স্তরের নীতিমালা প্রণয়ন করা গেলে তা আরও বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে। এই নীতিমালায় কিছু অস্ত্র ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং অন্যদের অনুমতি দেওয়া হবে যদি তারা নীমিতালাগুলোকে কঠোরভাবে পালন করে। 

কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে সেই নীতিমালাগুলো কেমন হবে, যা এসব অস্ত্রের সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাস বা বন্ধ করতে পারে। আবার দেশগুলোকে সেই নীমিতালার সঙ্গে একাত্মতাও পোষণ করতে হবে। 

রাজনৈতিক নাকি ধর্মীয় নীতিমালা?

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যাপারে কী নীতিমালা নেওয়া উচিত, তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে আরও মৌলিক বিভাজন রয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, এমন কোনো নীতিমালা করা উচিত নাকি এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হবে; এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ অনেক দেশ। 

একটি রাজনৈতিক ঘোষণা নানা আঙ্গিকে হতে পারে। যেমন- বিশ্বের প্রধান শক্তিধর দেশগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যাপারে তাদের সাধারণ অবস্থান প্রকাশ করতে পারে এবং নথিতে উল্লেখিত নীতিগত পয়েন্টগুলো মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। এটি পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধ এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা এড়ানোর বিষয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের জারি করা যৌথ বিবৃতির মতো হতে পারে, যেখানে দেশগুলো অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি স্বীকার করেছে যে পারমাণবিক যুদ্ধে 'কখনই কেউ জিততে পারে না এবং এই যুদ্ধ কখনো করা উচিত নয়।'

বুলানিন মনে করেন, দেশগুলো এই বিষয়ে যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আইনি বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়া স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রও অনেকটা সতর্ক। শেষের দুটো দেশ মনে করছে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ঘোষণাই প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। ভারত ও চীনের অবস্থানও অস্পষ্ট। 

চীন সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেছে কিন্তু তাদের বিকাশ বা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করে না। চীন মনে করে পারমাণবিক অস্ত্রসহ বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সামরিক সরঞ্জামগুলো প্রতিরক্ষামূলক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। চীনের অভ্যন্তরীণ অস্ত্র শিল্প ব্লোফিশ এ২ ড্রোনসহ এই জাতীয় প্রযুক্তির বিকাশের লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই ড্রোনগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়তে পারে এবং স্বাধীনভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। দেশটির গোপনীয় '৯১২ প্রজেক্ট' এর লক্ষ্য আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পানির নিচে চলাচলে সক্ষম রোবট তৈরি করা।

এদিকে, ভারত এই ধরনের অস্ত্রের প্রতিযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে একই সঙ্গে দেশটি তার নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবস্থা বিকাশের দিকেও মনোযোগ দিচ্ছে। 

ফেব্রুয়ারি মাসে কোস্টারিকার সরকার ও বেসরকারি সংস্থা ফানপাডেম যৌথভাবে একটি ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যেখানে দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের প্রায় সবগুলো দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছেন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে উদ্বেগ জানানো হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটি আইনি কাঠামো তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে। 

বিশ্বাস এবং সম্মান

বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। কিন্তু যদি আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভবও হয়, তাহলেও সেগুলো কি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে? এটা একটা উন্মুক্ত প্রশ্ন কারণ অনেক দেশ সবসময় নিয়ম-নীতি মেনে চলতে আগ্রহী নয়। 

বুলানিন বলেন, 'রাষ্ট্রগুলো কোনো ব্যাপারে রাজি হতে পারে, সেটা এক কথা। কিন্তু মেনে চলাটা আরেক কথা।'

'আমি মনে করি কিছু দেশ উদ্বিগ্ন যে যদি তারা একটি উচ্চাভিলাষী নিয়ন্ত্রক কাঠামোতে সম্মত হয় তবে তারা সম্ভবত নিজেদের পায়ে কুড়াল মারবে। যদি তাদের শত্রুরা নিয়ম ভেঙে এই ধরনের অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে নীতিমালায় সম্মত হওয়াটা তাদের জন্য কৌশলগত অসুবিধা তৈরি করতে পারে।'

২০১৯ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মানুষের সম্পৃক্ততা ছাড়া জীবন নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই যন্ত্রগুলো 'রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য' এবং 'নৈতিকভাবে বিদ্বেষপূর্ণ'।

তবে ওয়ালশ মনে করেন, সব ধরনের আইন, নীতিমালা ও ভূরাজনৈতিক জটিল সমীকরনের বাইরেও মানুষের মতো আবেগ ও বুদ্ধি-বিবেচনাহীন কোনো যন্ত্র মানুষের জীবন-মৃত্যুর মতো জটিল ও সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এই ব্যাপারটিই সমস্যার। 

'এটা মানবিক মর্যাদার প্রতি অসম্মানজনক।'

সূত্র: আল জাজিরা
গ্রন্থনা: আহমেদ হিমেল

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago