বিদ্যুৎ উৎপাদন: সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশই অব্যবহৃত

প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

সারা দেশে তীব্র দাবদাহের মধ্যেই চলছে লোডশেডিং। অথচ দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই থাকছে অব্যবহৃত।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জ্বালানি সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণ-সম্পর্কিত কারণে গত ৮ মে প্রায় ৭ হাজার ১৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি।

বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির তথ্যে দেখা গেছে, জ্বালানি সংকটের কারণে ৩ হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে আরও ৩ হাজার ৪৮৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়নি।

তাপপ্রবাহের সময় সাধারণত মানুষ এসি ও ফ্যান বেশি ব্যবহার করেন। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেই চলছে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের জ্বালানি সংক্রান্ত কিছু সমস্যা আছে, যা আমরা পেট্রোবাংলা ও বিপিসির (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করছি।'

শিগগিরই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, 'কয়লার অভাবে বন্ধ থাকা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা এসে পৌঁছেছে। শিগগির প্ল্যান্টটিতে উৎপাদন আবার চালু হবে। অন্যান্য কিছু জায়গায় কিছু সমস্যা ছিল, তবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে বড় যে সংকট ভাবা হচ্ছিল, সেই বোরো মৌসুম ও রমজান মাস ভালোভাবেই পার করে এসেছি।'

পেট্রোবাংলা জাতীয় গ্রিডে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করছে, যার মধ্যে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে।

কিন্তু এই বড় সরবরাহকেও অনেক কম মনে হচ্ছে। কারণ পিডিবি ইতোমধ্যেই পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে বলেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে।

গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকে একসঙ্গে ৪ কার্গো তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি) কিনেছে পেট্রোবাংলা। দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ প্রায় ৭ মাস এলএনজি কেনা বন্ধ রাখার পর গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এলএনজি কেনা শুরু করে। তখন থেকে গত সপ্তাহের আগ পর্যন্ত মাসে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই কার্গো এলএনজি কিনেছে সংস্থাটি।

গ্যাসের সংকটে ভুগছে ঘোড়াশাল, হরিপুর, আশুগঞ্জ, ভেড়ামারা ও সিরাজগঞ্জের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। কয়লা সংকটের কারণে গত ২৩ এপ্রিল থেকে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।

একই কারণে বরগুনায় ৩০৭ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ আছে।

পিডিবি ও পিজিসিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ১৫৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে অন্তত ১০০টিতে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।

গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট হলেও সেগুলোতে উৎপাদন হচ্ছে ৫ হাজার ৮৪৬ মেগাওয়াট।

ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৫ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট হলেও সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

বেসরকারি ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২৮৬ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশ ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে, যা গড়ে প্রায় ১ হাজার ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট।

বুয়েটের কেমিক্যাল অ্যান্ড মেটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ তামিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুৎ খাতের ব্যর্থতার পেছনে সংশ্লিষ্ট খাতটি নয়, সামগ্রিক অর্থনীতি দায়ী।'

তিনি বলেন, ২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ৩টি এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে তারা উৎপাদনে যেতে পারছে না।

ডলার ঘাটতির কারণে জ্বালানি কিনতে না পারায় এই সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক ম তামিম।

কিন্তু এর ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ভোক্তাদের।

নেত্রকোণার পূর্বধলা এলাকার গৃহবধূ হামিদা আক্তারের কথাই ধরুন। গত কয়েকদিন ধরে দিনে অন্তত ৭ থেকে ৮ বার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। 'একদিন আমরা আমাদের পানির ট্যাঙ্কে পানি তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে আমাদেরকে অন্তত ৩ ঘণ্টা পানি ছাড়া থাকতে হয়েছে', বলেন হামিদা।

তিনি জানান, ওই এলাকার আশপাশের কয়েকটি ঘর তাদের এই পানির ট্যাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল।

বগুড়ায় গত ৩ দিনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট বেড়েছে। স্থানীয়রা জানান, দিনে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ থাকছে না।

বগুড়া বিসিকের রেজা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মেটালের মালিক রেজাউল করিম জানান, বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে জেনারেটর ব্যবহার করে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে তাদের ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

গতকাল রাত ৯টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট এবং এর বিপরীতে ১৩ হাজার ৭৫২ মেগাওয়াট উৎপাদন হয়েছে।

দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রাহক নির্ভর করে বিদ্যুৎ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ওপর। গত ৮ মে তাদের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান ছিল ১ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াট, যা গত ১৫ এপ্রিলের পর থেকে সর্বোচ্চ।

পিজিসিবির প্রতি ঘণ্টার উৎপাদন ও ঘাটতির তথ্য বলছে, ওই দিন রাত ১২টায় ১ হাজার ৫৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে।

যার মানে দাঁড়ায়, শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালো ছিল।

সোমবার ময়মনসিংহ জোনে সর্বোচ্চ ঘাটতি ছিল ৩৫২ মেগাওয়াট।

কুমিল্লা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, ঢাকা ও বরিশালসহ পল্লী বিদ্যুতের সব জোনেই ওই দিন প্রায় ১ থেকে ৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে।

বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম সময় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত চাহিদা অনুযায়ী দিনে অন্তত ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল সরকারের।

কিন্তু এপ্রিলের প্রথম থেকেই তা উৎপাদনে সরকার ব্যর্থ হয়।

পিডিবি গত ১৯ এপ্রিল রেকর্ড ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ওই দিন দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট, যার ঘাটতি ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট ও রংপুর এলাকায় ৪২৮ মেগাওয়াট লোডশেডিং করে পূরণ করতে হয়।

এরপর থেকে প্রতিদিনের উৎপাদন কমেছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে সেই আনুপাতিক হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

4h ago