শতবছর পূর্বে কেমন ছিল রমজান
মানব সমাজ পরিবর্তনশীল। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বদলায়। প্রজন্মের হাত ধরে বদলায় ধর্মীয় রূপও। আজ যেভাবে আমরা বাংলার মুসলমান সমাজকে দেখছি শতবছর পূর্বের সমাজ অবশ্যই ভিন্ন রূপ ছিল। মুসলমান সমাজের যে কোনো উপাদানই— শতবছর পূর্বে আজকের মতো ছিল না। এবাদতের মধ্যে ইসলাম ধর্মে নামাজের পরেই রোজা। যদি প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সমাজে রোজার যে রূপ তা শতবছর পূর্বে একইরকম ছিল? কতটা ছিল ভিন্নতা? শতবছর পূর্বের বাঙালি মুসলমান সমাজে রমজানের রূপ কেমন ছিল তা জানতে সহায়ক কীর্তিমানের আত্মজীবনী। তাতে উঠে আসছে সামাজিক এই চিত্র।
প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই শিক্ষাবিদ বেড়ে উঠেছেন টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর এলাকায়। তিনি জানিয়েছেন তার শৈশবে দেখা রোজার স্মৃতি: "আমি তো আমাদের গাঁয়ের বয়স্ক কাউকে রোজা না রাখতে দেখি নাই। সকলেই তারাবীর নামাজ পড়ত। আমি ছোটবেলায় প্রভাতের ছেহেরী না পেলে সকালে উঠে কেঁদে কেটে খয়বরের জঙ্গ শুরু করতাম। কাজেই আমাকে ডেকে তুলে সবার সঙ্গে ছেহেরী খাওয়ান হ'ত। দিনে কিছুতেই রোজা ভাঙ্গব না, পণ করতাম। তখন মা বুঝিয়ে বলতেন যে, ছোট মানুষের দিনে দুই রোজা করা চলে। সরল মনে তাই বিশ্বাস করে তবে দুপুরে ভাত খেতাম।" (ইবরাহীম খাঁ:১৯৯৪, ৬৬) প্রিন্সিপাল সাহেবের স্মৃতি থেকে স্পষ্ট যে, শতবছর পূর্বেও আজকের মতো তারাবীর নামাজ পড়ার প্রচলন ছিল।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে। বেড়ে উঠেছেন ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায়। তিনি জানিয়েছেন তার শৈশবে দেখা রমজানের চিত্র: "তরুণদের ত কথাই নাই, বয়স্কদেরও সকলে রোজা রাখিত না। যারা রোজা রাখিত, তারাও দিনের বেলায় পানি ও তামাক খাইত। শুধু ভাত খাওয়া হইতে বিরত থাকিত। পানি ও তামাক খাওয়াতো রোজা নষ্ট হইত না এই বিশ্বাস তাদের ছিল। কারণ পানি তামাক খাইবার সময় তারা রোজাটা একটা চোংগার মধ্যে ভরিয়া রাখিত। কায়দাটা ছিল এই: এক দিকে গিরোওয়ালা মোটা বরাক বাঁশের দুই-একটা চোংগা সব গৃহস্থের বাড়িতেই আজও আছে, আগেও থাকিত। তাতে সারা বছর পুরুষরা তামাক রাখে। মেয়েরা রাখে লবণ, সজ, গরম মসলা, লাউ-কুমড়ার বিচি ইত্যাদি। আগের কালে এ রকম চোংগার অতিরিক্ত দুই-একটা বাড়ি-বাড়িই থাকিত। রোজার মাসে মাঠে যাইবার সময় এই রকম এক-একটা চোংগা রোজাদাররা সংগে রাখিত। পানি-তামাকের শখ হইলে এই চোংগার খোলা মুখে মুখ লাগাইয়া খুব জোরে দম ছাড়া হইত। মুখ তোলার সংগে সংগে খুব তাড়াতাড়ি গামছা নেকড়া বা পাটের ঢিপ্লা দিয়া চোংগার মুখ কষিয়া বন্ধ করা হইত যাতে বাতাস বাহির হইয়া না আসে। তারপর আবশ্যকমতো পানি-তামাক খাইয়া চোংগাটা আবার মুখের কাছে ধরা হইত। খুব ক্ষিপ্রহস্তে চোংগার টিপ্লাটা খুলিয়া মুখ লাগাইয়া মুখে চুষিয়া চোংগার বন্ধ রোজা মুখে আনা হইত এবং ঢোক গিলিয়া একেবারে পেটের মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া হইত। খুব ধার্মিক ভালো মানুষ দু'একজন এমন করাটা পছন্দ করিতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে এটাই চালু ছিল।" (আবুল মনসুর আহমদ:২০১৯, ২৮)
এতে দেখা যাচ্ছে, শতবছর পূর্বে ময়মনসিংহে রোজার ব্যাপারে এমন কুসংস্কার চালু ছিল তা বর্তমানে চিন্তাও করা যায় না। বাঙালি মুসলমান সমাজে রোজা যে সবসময় একরকম ছিল না, বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপ ছিল তার চমৎকার নজির আবুল মনসুর আহমদের এই স্মৃতিকথা।
কবি সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালে। বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদের নওয়াব পরিবারে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। তার দেখা রমজানের চিত্র উঠে এসেছে তার স্মৃতিকথায়: "প্ৰথম কোন শিশু রোজা রাখলে তার রোজা রাখার দিন পহেলা রমজান একটি আনন্দ উৎসব হত। রোজাদার শিশুকে সকাল থেকে নানা ধর্মকথা শোনানো হত। তাকে মেহেদী লাগিয়ে সেদা-মেথির খুশবু মাখিয়ে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হত। যে কয়জনই এ-ভাবে একসাথে রোজা রাখত, সবাইকেই একরকমভাবে তোয়াজ করা হত। তারপর আসত ইফ্তার তৈরী করার পালা। মুরুব্বীরাও গোসল নামাজ সেরে জোহরের পর থেকেই ইফতারের আয়োজনে লেগে যেতেন। কতরকম ইফতার যে তৈরী হত। আছরের নামাজ পড়ে সেই ইফতারের অংশ মসজিদে দিয়ে এসে তবে মাসুম বাচ্চাদের নিয়ে বাচ্চা রোজাদার অপেক্ষা করত ইফতারের সময়ের জন্য। মসজিদের মুয়াজ্জিন আযান দিলেই রোজা খোলা হত। গরীব বাচ্চারা থাকত আশে পাশে তারাও খেতে পেত। আর পেত পয়সা। ধনী গৃহের অনুষ্ঠানটি দরিদ্রদেরও ভাগ্যে ভালো খাবার জোটাবার একটা উপায় ছিল।
আমাদের সু-বৃহৎ পরিবারে বাচ্চার অভাব ছিল না। প্রত্যেক বছরই দু'চার জনের রোজা খোলাই হত। এমনি এক রোজা খোলাই হচ্ছিল আমার মামাত বোনের মেয়েদের। মামাত বোনের মেয়ে হলেও আমার চেয়ে তারা ছিল বয়সে বড়। তাদের রোজা রাখা দেখে আমিও নাকি জেদ ধরেছিলাম রোজ রাখব বলে, আমার বয়স নাকি তখন ছ' বৎসর পূর্ণ হয়নি। অবশ্য পরে আমি একথা সকলের কাছে শুনতে পেয়ে জেনেছি। আমার জেদ দেখে আম্মারা নাকি বলেছিলেন: থাকুক কতক্ষণ : না খেয়ে খিদে পেলে বা পিয়াস লাগলে আপনি খেতে চাইবে। কিন্তু আমি নাকি সারাদিন ধরে কিছুই খেতে রাজী হইনি। তাই আমাকেও মেহেদী উপটন লাগানো হল, গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হল। সন্ধ্যায় আযান দেবার অল্পক্ষণ আগে নাকি আমি বলেছিলাম ; আর রোজা রাখব না, পানি খাব। তখন নাকি একেবারে সন্ধ্যা। তাই আমাকে কোলে করে ভলিয়ে ভালিয়ে আযান দেয়া পর্যন্ত এটা সেটা করে সময় কাটিয়ে দেয়া হয়।
আযান হওয়া মাত্র মুখে শরবত দেবার সাথে সাথেই নাকি আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর হুলস্থূল কাণ্ড। আমাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কোথায় কি করবে—মসজিদের বড় হাফেজ সাহেব আম্মার ওস্তাদজী, তিনি এসে আম্মাকে খুব বকলেন, আর আমাকে কোলে করে বসে দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করলেন। ডাক্তার-কবিরাজ সবাই মুখের ফাঁকে ওষুধ দিতে লাগলেন। রাত তিনটায় আমার হুঁশ হতেই বলে উঠলাম যে পাখি খাব। কিন্তু পরে সাত বছর থেকে রোজা রেখে আর কখনও বেহুঁশ হইনি।" (সুফিয়া কামাল:১৯৮৮, ৫-৬)
বুঝা যাচ্ছে, রমজানের মধ্যেও বরিশালের শায়েস্তাবাদ অঞ্চলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের রোজা রাখাকে কেন্দ্র করে ঘটা করে এক অন্যরকম উৎসব অনুষ্ঠিত হতো— শতবছর পূর্বে!
তিনজনের তিনটি জায়গার স্মৃতিতে আমরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি চিত্র দেখলাম। ইবরাহীম খাঁ বলছেন টাঙ্গাইলে স্বাভাবিকভাবেই তারাবীর নামাজ হচ্ছে, সবাই রোজা রাখছে ; আবুল মনসুর আহমদ বলছেন ময়মনসিংহে পানি ও তামাক খাওয়ার জন্য অদ্ভুত এক পন্থা অবলম্বন করতো রোজাদারগণ ; সুফিয়া কামাল জানাচ্ছেন বরিশালে রমজানের মধ্যেই ছোট বাচ্চাদের প্রথম রোজা রাখা কেন্দ্র করে ঘটা করে উৎসব পালনের কথা। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং বরিশাল— শতবছর পূর্বে বাঙালি মুসলমান সমাজে রমজানের তিন ধরনের চিত্র দেখলাম। আরো কত চিত্র যে বিভিন্ন জায়গায় রমজান মাসে ফুটে উঠতো তার আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়।
প্রাথমিকভাবে এটা নিশ্চিত যে, শতবছর পূর্বে বাংলার মুসলমান সমাজে রমজানের চিত্র সবখানে একরকম ছিল না। বড় একটা কারণ ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্তমানে যেভাবে বরিশালের খবর এক ক্লিকে চলে যাচ্ছে বান্দরবান— তখন তা ছিল কল্পনারও অতীত। সবাই নিজেদের মতো করে রমজান মাস উদযাপন করছে। রমজান তখন শুধু ধর্ম ছিল না, ধর্মের ভেতরেই একটা কালচারাল রূপ ছিল। নয়তো, বাচ্চাদের প্রথম রোজা রাখা উপলক্ষে উৎসব অনুষ্ঠিত হলো কিভাবে? এভাবেই ধর্মের ভেতরে গড়ে উঠে সংস্কৃতি ; বিবর্তনের মাধ্যমে হয়ত বিকশিত হয়, নয়তো রচনা হয় কবর। আজ হয়তো খোঁজ করলে বরিশালে এমন কোনো উৎসবের চিহ্নও পাওয়া যাবে না!
আজকের মুসলমান সমাজে রমজানের যে চিত্র আমরা দেখছি তা আসমান থেকে পড়েনি। মুসলমান সমাজের যত শত বছর বয়স ঠিক তত শত বছর ধরে এই চিত্রের সফর। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে নানান সংযোজন আর বিয়োজনের ফলে রূপান্তর ঘটেছে রমজানের। আজকের রমজানের যে চিত্র আমরা দেখছি তার পেছনে যে কত রঙের হারিয়ে যাওয়া, কত রূপান্তরের পরিবর্তিত রূপ তার হদিস মিলবে কোথায়? তাও যতটুকু মিলছে ততটুকুর মূল্যায়ন জরুরী। শেকড়ের জোরেই শত বছর মাথা উঁচু করে বাঁচে বটবৃক্ষ।
গ্রন্থপঞ্জী:
১. ইবরাহীম খাঁ রচনাবলী : মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৪
২. আত্মকথা : আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০১৯
৩. একালে আমাদের কাল : সুফিয়া কামাল, জ্ঞান প্রকাশনী, ১৯৮৮
Comments