পর্যালোচনা

ফুড কনফারেন্স : দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের ক্যানভাস 

ফুড কনফারেন্সে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জাতীয় চরিত্রের বাস্তব দিক রূপায়িত করে তোলা হয়েছে।

রাজনীতিক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের জন্য বিখ্যাত। স্যাটায়ার বা ব্যাঙ্গাত্মক রচনার মূল উদ্দেশ্য হলো সমালোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্র-সমাজ গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা। বিশ্বসাহিত্যে 'পলিটিক্যাল স্যাটায়ার' আলাদা মনোযোগ পায়। এই জনরার লেখকদের মধ্যে গালিভার্স ট্রাভেলস এর জোনাথন সুইফট অন্যতম।

নয়টি ব্যঙ্গাত্মক গল্পের সমষ্টি ফুড কনফারেন্স। বইটিতে বিদ্রুপ এবং শ্লেষের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসুখের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন লেখক তীর্যক ভাষায়। ফুড কনফারেন্স ও আয়না বাংলা স্যাটায়ার সাহিত্যে অনন্য সংযোজন। প্রসঙ্গে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের মতামতকে আমরা স্মরণ করতে পারি। 

"আবুল মনসুরের আয়নায় মুখ দেখে যাঁরা খুশি হয়েছেন, ফুড কনফারেন্সও নিশ্চয় তারা পেট ভরে খেয়ে প্রচুর আনন্দ পাবেন। ফুড কনফারেন্সে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জাতীয় চরিত্রের বাস্তব দিক রূপায়িত করে তোলা হয়েছে। রঙ্গ ও ব্যঙ্গের ভেতর দিয়ে লেখক বাঙালি-চরিত্রের এই সাধারণ বাস্তব দিক দেখিয়ে পাঠকদের প্রচুর হাসিয়েছেন বটে, কিন্তু অবিমিশ্র হাসিই যে আসল ব্যাপার নয়, হাসির পেছনে লেখকের অন্তরের বেদনার দরিয়া যে উচ্ছ্বসিত ধারায় বয়ে চলেছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পাঠকদের তা নজর এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়।" 

গ্রন্থের প্রথম গল্প "ফুড কনফারেন্স"। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবব্যহিত পরে ভারতবর্ষে খাদ্যভাব দেখা দেয়। সেই খাদ্যভাব এক সময় দুর্ভিক্ষে রূপ নেয়। খেতে না পেয়ে যখন দেশের মানুষ গণহারে মারা যাচ্ছেন, ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষু মানুষ খাদ্যের অভাবে  ভদ্রলোকের দ্বারে দ্বারে এসে হতাশ হয়ে মারা পড়ছেন, তখন রাষ্ট্রের কথিত ভদ্রলোকদের টনক নড়ে। তারা গরীব, হতভাগাদের খাদ্যভাব থেকে কীভাবে মুক্ত করা যায় সে বিষয়ে কনফারেন্স করে নিজেদের উদরপূর্তির বিষয়টাকে নিশ্চিত করে। তাদের এই স্বার্থন্বেষী কনফারেন্স শেষে দেখা গেলো এসব জানোয়ার ছাড়া আর কোনো মানুষ বেঁচে রইলো না। গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই, " আইনসভা ও ফুডকমিটির মেম্বর ভদ্রলোকরা ছাড়া দেশে আর কেউই বেঁচে নেই। শহর পাড়াগাঁয়ে আর লোক নেই।" 

ক্ষুধার্তের সেবায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করার নাম দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো  এসব তথাকথিত সভ্যজন আমাদেরকে  বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান বাজার সিন্ডিকেট ও ব্যবসায়ী দুর্বৃত্তদের স্মরণ করিয়ে দেয় যারা দিনের পর দিন খাদ্য-দ্রব্য মজুদ রেখে, বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি, করে মানুষের পকেট লুট করে। লেখক তাই তো "ফুড কনফারেন্স" গল্পের শেষে দুর্বৃত্তদের মুখ দিয়ে সমস্বরে 'জানোয়ারে বাংলা জিনাদাবাদ' আওড়িয়ে নেন। ফুড কনফারেন্স'র চরিত্রগুলোর নামকরণ এটাকে একটা উন্নতমানের "Beast Fable" হিসেবে স্বীকৃতির দাবি  জোরালো করে।  

এর দ্বিতীয় গল্প "সায়েন্টিফিক বিজনেস"। চাকুরি পাগল, কেরানিগিরিমনষ্ক বাঙালীকে  ব্যবসাপাতির প্রতি মনো্যোগী হওয়ার জন্য উদ্ধুদ্ব করার প্রচেষ্টা চালান আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। কিন্তু এখানেও দেখা দেখা যায় বাঙালি জাতি অধিক লাভের লোভে নিজেদের হটকারিতা এবং বাটপারি চরিত্র লুকাতে পারে না।  আমরা জাতি হিসেবে অত্যন্ত ধুরন্ধর এবং হটকারি সে কথা লেখক তুলে ধরেছেন এই গল্পে। আমরা যা প্রচার করি, তা বিশ্বাস করি না, যা অন্যকে করার জন্য/ মানার জন্য উপদেশ দিই, তা নিজেরা পালন করি না। আমাদের সাহিত্য, শিল্প, শিক্ষা, ব্যবসা, ধর্ম প্রত্যেকটি সেক্টরে এই সুবিধাবাদীতা বা এক্সপেডিয়েন্সি ঝেঁকে বসেছে আমাদের চরিত্রে। খ্রিস্টান শাস্ত্রমতে সাতটি নারকীয় পাপ মানুষের মনের শান্তি নষ্ট করে এবং পরকালে অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হয় তাদেরকে। এই সাতটি নারকীয় পাপের অন্যতম হলো লোভ। যা গল্পে উল্লেখিত বাঙালী জাতিকে মর্ত্য, স্বর্গ ও নরক সব জায়গায় হেয় প্রতিপন্ন করে তোলে।  

"এ আই সি সি" গল্পের প্রধান চরিত্র শহীদ। একজন উচ্চ শিক্ষিত চাকুরি না পাওয়া শহীদ বিনা পরিশ্রমে, বিনা উদ্যমে সহজ উপায়ে জীবনে সফলতা লাভ করার রাজনীতিতে নিজের নাম লিখিয়ে নেয়। সুবিধা করতে না পেরে, শর্টকাট সফলতা লাভের লক্ষ্যে সে দলবদল করে। নিজে সংগঠন করে। "এ আই সি সি" গল্পের শহীদের সাথে  "রিজেন্ট শাহেদের" চারিত্রিক সাযুজ্য আমরা পাই। যে শাহেদ ভুয়া সার্টিফিকেট এবং দলীয় পরিচয় দিয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা থেকে, টকশোতে পরামর্শকের চরিত্রে উপস্থিত হওয়া, গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্টান্ড ব্যবহার ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিল শর্টকার্ট উপায়ে সফলতা লাভের লক্ষ্যে। গল্পের শহীদ আর এই শাহেদ যেন মুদ্রার এপিঠ- ওপিঠ। শহীদ চরিত্রের নানা প্রকার ধান্ধাবাজি ও ধাপ্পাবাজি আচরণ বাঙালি জাতির পরিশ্রমবিমুখতাকে নির্দেশ করে। আমরা সফলতা চাই, কিন্তু সেটার  জন্য যে  উদ্যম, পরিশ্রম এবং নিষ্ঠার প্রয়োজন সেটুকু  করার দায়িত্ব নিই না।

"ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে"—এই প্রবাদ দিয়ে বোঝানো হয়, অন্যের বিপদে খুশি হওয়ার কারণ নেই, খুব দ্রুতই একই রকম পরিণতি নিজের জীবনেও ঘটতে পারে। "লঙ্গরখানা" গল্পের শমসের এবং আকবরের কান্ডকারখানা উপরেল্লিখিত চিরায়ত  এই বাংলা প্রবাদের সত্যতা তুলে ধরে। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সেবার নামে অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ রক্ষার লক্ষ্যে লঙ্গরখানা খুলে অভিনব কায়দায় সরকারি কোষাগার লুট করার মতো দুরভিসন্ধিমূলক উদ্যোগ নেয় গল্পে কথিত দুই বন্ধু। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা এবং সুবিধাবাদী শ্রেণির 'আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ' হওয়ার মতো ব্যাধিকে লেখক এই গল্পে তুলে ধরেছেন। 

সমাজ সমীক্ষায় অগ্রগামী সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদও ফুড কনফারেন্সে এর মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় অসুখের কথা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেঁচে নিয়েছেন স্যাটায়ারকে।

"রিলিফওয়ার্ক ও লঙ্গরখানার" প্রেক্ষিত মূলত একই । সরকারির কোষাগার থেকে অনুদান নিয়ে লঙ্গরখানা খুলে লোকজনকের ক্ষুধা নিবারণ করা এবং পীড়িতদের হাতে রিলিফওয়ার্ক পাঠানোর নামে আমরা যে 'শুভংকররের ফাঁকি'র আয়োজন করি এবং অভিনব কায়দায়  নিজেদের আখের গোছাই,  সেই  বাটপাড়ির কথা লেখক তুলে ধরেছেন এই দুটি গল্পে।

আমাদের রিলিফ মূলত 'ধনীর হস্ত' কে ধনবান করে, 'হতভাগাদের' করে আরো পীড়িত। "রিলিফ" গল্পটি আমাদেরকে  করোনাকালে প্রকাশিত একজন সম্মানে পড়ুয়া  যুবকের 'দুই বেলা খাওয়ার বিনিময়ে টিউশানি খোজা' র কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ' গ্রো মোর ফুড, 'মিছিল' এবং 'জমিদারি উচ্ছেদ' ও সমজাতীয় গল্প। বিভিন্ন পেশার ধূর্ত ও ধাপ্পাবাজ চরিত্রদের মাধ্যমে আবুল মনসুর আহমদ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন বাঙালি জাতি লোভ, পরশ্রীকারতা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার মতো মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত। 

"জনসেবা য়্যুনিভার্সিটি" পরনির্ভরশীল 'মস্কা' চরিত্রের অন্যতম প্রতীক। মস্কা হলো ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসনের ভল্পোনি নাটকের একটা চরিত্র। যার কাজ হলো অপরের ঘাড়ে চড়ে নিজের আখের গোছানো। আবুল মনসুর আহমদের এই ইয়াকুব মস্কাকেও হার মানায়। পরের ঘাড়ে চড়ে সাকো পার হয়ে ওযু সেরে নিজের নামে মিলাদ পড়ানোর মতো সুবিধাবাদী ইয়াকুবের সংখ্যা আমাদের বর্তমান সমাজে অগণিত। এসব ইয়াকুবরা সহজ সরল নাগরিকদের বেকুব বানিয়ে  জনসেবা বা জনকল্যাণের নামে হাতিয়ে নেয় জনগণের পকেট।

রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের কোনো বিবেক নেই। বিবেকবান মানুষের হাতে পরিচালিত হলেই তবে সেই প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিবেক থাকে। এমনটি বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো।

একটি সমাজকে বুঝতে হলে সেই সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী চরিত্রকে বুঝতে হয়। ইংরেজি সাহিত্যের পুরোধা কবি জিওফ্রে চসার তাঁর দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস- এ এমন একটি নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। তিনি সমাজের ত্রিশটি চরিত্রের মুখে বলিয়েছেন এমন কিছু গল্প যার মাধ্যমে সমাজে বিদ্যমান রুগ্নতা, সুবিধাবাদীতা, পরশ্রীকাতর পরিনির্ভরশীলতা এবং বাটপারির মতো ঘৃণ্য ত্রুটিগুলো ফুটে উঠেছে।

সমাজ সমীক্ষায় অগ্রগামী সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদও ফুড কনফারেন্সে এর মাধ্যমে সমাজের যাবতীয় অসুখের কথা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেঁচে নিয়েছেন স্যাটায়ারকে। স্যাটায়ার ব্যঙ্গাত্মক রচনায় তার নৈপুণ্যের প্রতি নির্দেশ করে অন্নদা শংকর রায় বলেছেন, "আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর আহমেদ প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন। "ফুড কনফারেন্স" লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।' আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, "আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের স্যাটায়ার রচনার ক্ষেত্রে যে পূর্ব বাংলার পরশুরাম।"   

রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের কোনো বিবেক নেই। বিবেকবান মানুষের হাতে পরিচালিত হলেই তবে সেই প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিবেক থাকে। এমনটি বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো। ফুড কনফারেন্স'র প্রতিটি গল্প আমাদের রাষ্ট্র যন্ত্রের বিকল সব কলকব্জার দিকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। সারিয়ে দেয় আমাদের চোখে পড়া বিবেকহীনতার ছানি। গুণে ধরা এবং লোভের বশবর্তী দিশেহারা বর্তমান সমাজে আবুল মনসুর আহমদের "ফুড কনফারেন্স" পড়া অত্যন্ত জরুরি। সচেতন পাঠকের জাগরণেই এই সমাজকে রক্ষা করতে।

Comments