আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং আবুল মনসুর আহমদ: সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি
বাংলায় 'মানিকজোড়' বলে একটা বাগধারা আছে, যার বাস্তব উদাহরণ আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭) এবং আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮)। কারণ দুজনের জন্মসালের ব্যবধান মাত্র এক বছর এবং জন্ম একই গ্রামে— ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানিখোলা গ্রামে। একই গ্রামে জন্ম এবং প্রায় সমবয়সী হওয়ার ফলে এই দুই মহারথীর মধ্যে ছেলেবেলাতেই যে সম্পর্ক তৈরি হয় তা কেবল বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাজনীতি পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতির খতিয়ান তুলে ধরবো এতে।
সম্পর্ক
আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং আবুল মনসুর আহমদের সম্পর্কের সূচনা সেই ছেলেবেলায়, গ্রামের মক্তবে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: "... মৌলবি মমতাজুদ্দিন। তিনি থাকিতেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেবদের বাড়িতে। ভোরের বেলা তিনি শামসুদ্দিন, তাঁর বড় ভাই সদরুদ্দিন ও পাড়ার সমস্ত তালেবিলিম সহ দল বাঁধিয়া আসিতেন এবং ছাত্রদের দশটার সময় পাঠশালায় পড়িতে যাওয়ার সুবিধার জন্য যথাসময়ে মাদ্রাসা ছুটি দিয়া দলে বলে চলিয়া যাইতেন।" (আবুল মনসুর আহমদ:২০১৯, ৬৫) আর আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলছেন পুঁথির কথা। তিনি লিখেছেন: "প্রাইমারী স্কুলে আমার সহপাঠী ছিলো আবুল মনসুর আহমদ। তাকে আমার এই আনন্দের খনির সন্ধান দিলাম। দেখলাম, সেও এ-খনির সন্ধান পেয়েছে। তাদের বাড়ীতেও বহু পুঁথি রয়েছে। কাজেই পুঁথির নেশায় আমি তাদের বাড়ী ঘন ঘন যেতে লাগলাম, এবং সেও আমাদের বাড়ীতে ঘন ঘন আসতে লাগল।" (অতীত দিনের স্মৃতি)
নিম্ন প্রাথমিক পাশ করে আবুল কালাম শামসুদ্দীন ভর্তি হন ময়মনসিংহ শহরের জেলা স্কুলে আর আবুল মনসুর আহমদ দরিরামপুর মাইনর স্কুলে। স্কুল আলাদা হলেও তাদের মনোজগৎ গড়ে উঠে একসাথে। কারণ সাহিত্যের বইগুলো দুইজন একসাথেই পড়তেন। শামসুদ্দীন লিখেছেন: "আমি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত 'সাহিত্য'র গ্রাহক হলাম এবং আবুল মনসুর হলো রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত 'মানসী'র গ্রাহক। ... পরবর্তীতে কয়েক বৎসরের মধ্যেই আমাদের সাহিত্যপাঠস্পৃহা দ্রুত বেড়ে গেলো। আবুল মনসুর ও আমি বাঙলার প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যের অনেকগুলি বই-ই ভাগাভাগি করে কিনে ফেললাম।"
মাইনর স্কুল পাশ করে ১৯১৩ সালে আবুল মনসুর আহমদ আসলেন ময়মনসিংহ শহরে, উঠলেন বন্ধু শামসুদ্দীনের মেসে। বন্ধু পড়েন জেলা স্কুলে, সুতরাং তিনিও জেলা স্কুলে ভর্তির জন্যই এসেছেন। কিন্তু বাঁধলো বিপত্তি! আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: "জিলা স্কুলে ভর্তি হইবো ঠিক করিয়াছিলাম। কিন্তু গিয়া দেখিলাম জিলা স্কুলে সিট নাই।" একপ্রকার বাধ্য হয়ে ভর্তি হলেন মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে কিন্তু থেকেছেন বন্ধুর মেসে। ফলে, স্কুল আলাদা হলেও শারীরিক ও মানসিকভাবে কোনো ছেদ পড়েনি সম্পর্কে।
বন্ধুত্ব
শৈশবের সম্পর্ক নদীর মতো, গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে। সমুদ্রের নাম বন্ধুত্ব। আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং আবুল মনসুর আহমদের সম্পর্কও বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে ইতোমধ্যে। এমন বন্ধুত্ব যে, তাঁরা নিজেদের নামও ঠিক করেছেন একসঙ্গে। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: "সিরাজী সাহেবের উপদেশে এবং এই সব মহাপুরুষের অনুকরণে আমি আবুল মনসুর ও শামসুদ্দীন আবুল কালাম 'কুনিয়াত' গ্রহণ করা স্থির করিলাম।"
১৯২১ সালের বিখ্যাত খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন "ব্যাক টু ভিলেজ" নীতি ঘোষিত হলো। আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং আবুল মনসুর আহমদ উভয়েই অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থক। তখন এই বিষয়ে তাঁদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান চলছিলো। কারণ আবুল কালাম শামসুদ্দীন তখন কলকাতায় আর আবুল মনসুর আহমদ ঢাকায়। তখন আবুল কালাম শামসুদ্দীন দ্বিধায় ভুগছিলেন যে, পরীক্ষা দেবেন কি-না! এই ব্যাপারে তিনি লিখেছেন: "এছাড়া ঢাকা থেকে আবুল মনসুর আহমদের চিঠিতে জানতে পারলাম, সে পরীক্ষা দিবে এবং এজন্য পরীক্ষার ফিসের টাকাও সে জমা দিয়েছে। মনে তখন বেশ কিছুটা স্বস্তির ভাব অনুভব করলাম।"
তারা দুজনই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। এবং কাজ করেছেন একসাথে। কিন্তু আকস্মিকভাবে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের বাবা মারা গেলেন। তাঁর ভাষ্যে, "পিতার এন্তেকালে গভীর শোক পেলাম শুধু তাই নয়, ভীষণভাবে মুষড়ে পড়লাম।" তখনও কিন্তু ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন বন্ধু আবুল মনসুর আহমদ। তিনি লিখেছেন: "আমার এ-দুঃসময়ে পরম বন্ধুর কাজ করেছিল আবুল মনসুর আহমদ। সে প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে সান্ত্বনা দিত।" শামসুদ্দীনের এমন চরম দুঃসময়ে পাশে থেকে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদ।
সাংবাদিকতায় প্রথমে যোগ দেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। পিতার ইন্তেকালের পর 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় যোগদানের জন্য মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী কর্তৃক প্রস্তাব পেয়েছিলেন। কিন্তু এ সংবাদ জানাতে ভুল করলেন না বন্ধুকে। তাঁর কথায়, "আবুল মনসুর আহমদের সাথে পরামর্শ করা গেলো। সে-ই আমাকে এ-প্রস্তাবে সম্মত হতে বললো এবং আমার অনুপস্থিতিতে আমাদের সমিতির কাজ সে চালিয়ে যেতে রাজী হলো।" তিনি যথারীতি কলকাতায় গেলেন এবং 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় কাজ করলেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই কাজ হারিয়ে তিনি আবার ফেরত এসেছিলেন ময়মনসিংহে। বেকার বসেছিলেন বছরখানেক। ১৯২৩ সালে আবার 'মোসলেম জগৎ' নামে এক পত্রিকায় কাজের প্রস্তাব পেলেন চিঠি মারফত। যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিল বন্ধুর সাথে। এই দৃশ্যপট সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: "যাবার সময়ে আবুল মনসুর আহমদ বললো, তারও সংবাদপত্রে কাজ করার সুবিধা হতে পারে কিনা, সেদিকে যেনো আমি নজর রাখি।" বন্ধুর কাছে আবদার! বন্ধুর আবদার কি তিনি রেখেছিলেন? জানতে হলে পড়তে হবে আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিক জীবনের বিসমিল্লা কিভাবে হলো। এ সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ আত্মজীবনীতে লিখেছেন: "আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ১৯২৩ সালে। আবুল কালাম শামসুদ্দীন তখন 'মুসলিম জগৎ' নামক সাপ্তাহিকের সম্পাদক।
আমি একটা চাকরি জোগাড়ের মতলবেই কলিকাতা গিয়াছিলাম। সাংবাদিকতার দাবি সবার আগে। চা-নাশতা হইতে খাওয়া-থাকা সবই শামসুদ্দীনের ঘাড়ে। কাজেই তাঁর সম্পাদকতায় যথাসাধ্য সাহায্য করা কর্তব্য মনে করিলাম। এই কর্তব্যই শেষ পর্যন্ত সুযোগে পরিণত হইলো। আস্তে আস্তে ছোটো-ছোটো সম্পাদকীয় মন্তব্য হইতে বড়ো প্রবন্ধ লিখিতে শুরু করিলাম। এরই মধ্যে 'ছহি বড়ো তৈয়ব নামা' নামে পুঁথির ভাষায় একটি রাজনৈতিক প্যারডি স্যাটায়ার ও 'সভ্যতায় দ্বৈত শাসন' নামক একটি দীর্ঘ দার্শনিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখি। তাতে মুসলিম সাংবাদিকদের নজরে পড়ি। কতকটা এই কারণে, কতকটা আবুল কালামের চেষ্টায় আমি ত্রিশ টাকা বেতনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সাহেবের 'ছোলতানে' সহ-সম্পাদকের চাকরি পাই।" এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে জানা গেলো যে, সহযোগিতার মাধ্যমে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বন্ধুর আবদার রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
১৯২৬ সালে 'দি মুসলমান' এবং 'সওগাত' পত্রিকায় একসাথে কাজের সুযোগ পেয়ে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সিদ্ধান্ত নিলেন, স্ত্রীকে কলকাতায় নিয়ে আসবেন। যথারীতি নিয়ে আসলেন। সংসার পাতলেন কলকাতার মহাব্যস্ত নগরীতে। কিন্তু এখানেও তাঁদের বন্ধুত্বের নজির স্থাপন হলো আরেকবার। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের জবানেই শুনি: "আবুল মনসুর আহমদ দিনে ১০-৫টায় সাপ্তাহিক 'খাদেমে'র সম্পাদনায় নিয়োজিত থাকত এবং সন্ধ্যায় ল-ক্লাশে হাজিরা দিত। সে-ও ছিল নব-বিবাহিত। ফ্যামিলি কলকাতায় নিয়ে আসার জন্য তার আগ্রহ ছিল বটে, কিন্তু 'খাদেমে'র সম্পাদনায় সে যা পেতো, তাতে ফ্যামিলির খরচ কুলিয়ে উঠা সম্ভব কিনা সে-বিষয়ে তার সন্দেহ ছিল। অবশেষে 'সওগাতে' তার কিছুটা প্রাপ্তির ব্যবস্থা হল। 'সওগাতে'র সম্পাদকীয় 'বিবিধপ্রসঙ্গ' লেখার ভার তাকে দেয়া হল। তখন আমি বললাম : 'এবার ফ্যামেলী নিয়ে আসার কোনো বাধা নাই।' স্থির হল, আমি এবার স্ত্রীকে দেশে রেখে আসব এবং সে তার স্ত্রীকে নিয়ে এসে সে-বাসায়ই উঠবে। ফলে কয়েক দিন পরই আমি ছুটি নিয়ে স্ত্রীকে দেশে রেখে এলাম।" এক বন্ধুর সাংসারিক সুবিধার জন্য আরেক বন্ধুর এমন দরদী মনোভাব এবং ত্যাগের নজির আজও বিরল। এই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই 'মানিকজোড়'।
রাজনীতি
শুরুতেই যেমনটা আমরা বলেছিলাম, তাদের সম্পর্ক কেবল বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাজনীতি পর্যন্ত গড়িয়েছে। রাজনীতির ময়দানে তাঁদের সম্পর্ক কেমন ছিল তার দুয়েকটা দৃষ্টান্ত আমরা দেখাবো।
১.
১৯২০-২১ সালের ভারতবিখ্যাত খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আবুল কালাম শামসুদ্দীন কলকাতায় এবং আবুল মনসুর আহমদ ঢাকায়। আন্দোলনের ফুলঝুরি ছুটছিল কলকাতায়, তখনও ঢাকায় রেশ পড়েনি। এমতাবস্থায় কলকাতা থেকে চিঠি লিখে বন্ধু আবুল মনসুর আহমদকে খেলাফত-অসহযোগ আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। আবুল মনসুর আহমদের স্বীকারোক্তি: "আবুল কালাম শামসুদ্দীন তখন কলিকাতা কারমাইকেল হোস্টেল হইতে প্রতি সপ্তাহে দুই একখানা করিয়া দীর্ঘ পত্র লিখিতেন। এই সব পত্রে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে প্রচুর যুক্তি থাকিত এবং তিনি অতি শীঘ্রই আন্দোলনে যোগ দিতেছেন এই খবর থাকিত।" (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর)
২.
চল্লিশের দশকে পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে যখন সারাদেশ উত্তাল তখন আবুল মনসুর আহমদ 'মুসলিম লীগ'কে সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান এবং 'জিন্নাহ'কে সাম্প্রদায়িক নেতা বলতেন। কিন্তু তাঁর এই ভুল ভাঙালেন বন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কিভাবে? শামসুদ্দীনের বয়ানে শুনি বিস্তারিত: "মুজীবুর রহমান খাঁ এই সময়ে তাঁর নব-প্রকাশিত পুস্তক 'পাকিস্তান'-এর একখণ্ড আবুল মনসুরের হাতে দিয়ে বললেন: 'আমার এই বইখানা পড়ে দেখবেন। আমি এতে পাকিস্তানবাদকে সব দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছি। এটা পড়ে এ-সম্পর্কে আপনার মতামত জানালে খুবই খুশী হবো।'
আবুল মনসুর বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। বইয়ের মলাটের চতুর্থ পৃষ্ঠায় বই সম্পর্কে আমার মন্তব্যটুকু পড়লেন। বললেন: 'যাক গে। তোমরা সত্যই আমার বদ্ধমূল ধারণার গোড়ায় একটা বিরাট ঘা দিয়েছ। এই বইয়েই সম্ভবত তোমাদের ধ্যান-ধারণার উৎসমূলের সন্ধান পাওয়া যাবে।'
আমরা আবুল মনসুরের নিকট হতে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কয়েকদিন পরেই দেখা গেল, রেনেসাঁ সোসাইটির এক বৈঠকে আবুল মনসুর এসে হাজির। তাঁর হাতে একটি প্রবন্ধ। বললেন: 'আমি আজ তোমাদের বৈঠকে এই প্রবন্ধটা পড়ব। মুজীবুর রহমানের 'পাকিস্তান' সম্পর্কে এটা লেখা হয়েছে।'
শুনে আমরা খুব খুশী হলাম। যথাসময়ে প্রবন্ধটি তিনি বৈঠকে পাঠ করলেন। তাতে মুজীবুর রহমানের 'পাকিস্তান'র অকুণ্ঠ প্রশংসা করা হয়েছিল। এমন কি, তাতে তাঁর এ স্বীকৃতি পাওয়া গেল যে, তাঁর সমস্ত পূর্ব-ধারণা বদলে গেছে এবং তিনি পাকিস্তানবাদকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। বৈঠকের সমবেত সবাই খুব খুশী হলেন এবং তাঁকে সোসাইটির একজন সদস্য করে নেয়া হলো।" এই লম্বা উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তান আন্দোলনের মতো বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক আইডিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে কিভাবে আবুল মনসুর আহমদ বন্ধু আবুল কালাম শামসুদ্দীনের প্রচেষ্টায় ফিরে এসেছিলেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন।
৩.
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক আইনসভার সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহে যুক্তফ্রন্টের হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদ এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনার ফলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকেছিলো। ঘটনা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, মুসলিম লীগের প্রার্থী আবুল কালাম শামসুদ্দীন ময়মনসিংহে জনপ্রিয় ছিলেন, তবুও তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল! পুরো ঘটনা শুনবো আবুল মনসুর আহমদের জবানে: "আমার প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগ প্রার্থী ছিলেন আমার সোদরপ্রতিম বন্ধু ও আত্মীয় আজাদ সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ভোটার ও জনগণের এই মতিগতি দেখিয়া আমরা উভয়েই বুঝিলাম, শামসুদ্দীন সাহেবের যামিন বাযেয়াফত হইয়া যাইতেছে। উভয়ে একত্রে তাঁর যামিনের টাকা বাঁচাইবার চেষ্টা করিলাম। উভয়ে এক গাড়িতে উঠিলাম। ভোটার ও ওয়ার্কারদেরে বুঝাইলাম। কিছু ভোট শামসুদ্দীন সাহেবকে দিয়া তার যামিনের টাকা বাঁচানো দরকার। শামসুদ্দীন সাহেবের টাকা ত আমাদেরই টাকা। শামসুদ্দীন সাহেবের টাকা বাঁচাইতে কারও আপত্তি ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হইল, মুসলিম লীগকে ভোট দিতে হয় যে। ও-কাজ করিতে ত কেউ রাযি না। কাজেই শামসুদ্দীন সাহেবের যামিন বাযেয়াফত হইল । মোট একত্রিশ হাজার রেকর্ডেড ভোটের মধ্যে তিনি পাইলেন মাত্র ষোল শ।" নির্বাচনের মতো স্পর্শকাতর জায়গাতেও আবুল মনসুর আহমদ প্রাণপণে চেষ্টা করেছেন 'সোদরপ্রতিম বন্ধু'র জামানত বাচানোর জন্য! রাজনীতির ময়দানে যেখানে ছেলে বাবাকে হত্যা করতে পিছপা হয় না, স্বামী তার স্ত্রীকে সহ্য করতে পারে না সেখানে বন্ধুত্বের এমন নজির আসলেই নজিরবিহীন।
১৯৭৮ সালের ৪ মার্চ মারা গেলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ঠিক তার পরের বছরেই চলে গেলেন আবুল মনসুর আহমদ। এক বছর আগে-পিছে যেমন তাদের জন্ম, তেমনি মৃত্যুও! এটাকে কাকতালীয় বললে অন্যায় হবে তাদের সম্পর্কের প্রতি। বলা যায়, সেই মক্তব থেকে শুরু হওয়া সম্পর্কের সুতোয় একসাথে জীবন যাপনের ধারা জারি রেখেছেন মৃত্যুর মাধ্যমেও। রূপকথাকেই বাস্তবে চিত্রায়িত করেছেন এই 'মানিকজোড়'।
তথ্যসহায়ক :
১. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর : আবুল মনসুর আহমদ, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯
২. আত্মকথা : আবুল মনসুর আহমদ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০১৯
৩. অতীত দিনের স্মৃতি : আবুল কালাম শামসুদ্দীন, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৬৮
Comments