ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছাত্র রাজনীতি, তবুও চমেক ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের তাণ্ডব

চমেক
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক)। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ক্যাম্পাস ও কলেজের ছাত্রাবাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও, ছাত্রাবাসে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

ছাত্রাবাস ও ক্যাম্পাসে উপদলীয় সংঘর্ষে জড়াচ্ছে ছাত্রলীগ। এতে শুধু শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে তা নয়, করে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

কোনো শিক্ষার্থী ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী হলে বা অনুসারী হিসেবে সন্দেহ করা হলে, তাকে শাস্তি দিতে ছাত্রাবাসের রুমকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগও আছে চমেক ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ গত বুধবার মধ্যরাত থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা চার শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে আটকে রাখে বলে চমেক সূত্র জানায়।

শিবির কর্মী সন্দেহে ওই চার শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আহত জাহিদ হোসেন ওয়াকিল, সাকিব হোসেন, এমএ রায়হান ও মোবাশ্বের হোসেন শুভ্র এমবিবিএস ৬২ ব্যাচের শিক্ষার্থী।

তাদের মধ্যে জাহিদ ও সাকিব আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

তবে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও বর্তমানে চমেক হাসপাতালের ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহাদী বিন হাশিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বুধবারের ঘটনার সঙ্গে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী ছাত্রলীগের উপদল জড়িত ছিল।

মাহাদী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী। তিনি আরও বলেন, 'এ ঘটনায় আ জ ম নাছিরের অনুসারী ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়।'

এ ঘটনাকে অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এতে সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।'

এদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুলের অনুগত চমেক ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করেননি। 

তিনি বলেন, 'চার শিক্ষার্থী হলে শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তাই ওইদিন রুম থেকে তাদের ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। নির্যাতন করা হয়নি।'

তারা যে শিবিরকর্মী সে বিষয়ে কোনো প্রমাণ আছে কি না, জানতে চাইলে অভিজিৎ জানান, তাদের কাছে প্রমাণ আছে। তিনি বলেন, 'তাদের রুম থেকে শিবিরের বিভিন্ন বই ও প্রকাশনা পাওয়া গেছে। এমনকি ওই চার ছাত্রের পরিবারও এলাকায় জামাত পরিবার হিসেবে পরিচিত। পরিবারের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়েছে।'

ক্যাম্পাসে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ক্যাম্পাসে স্বাধীনতাবিরোধী আদর্শের কোনো রাজনীতি সাধারণ ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।'

তবে নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা।

তাদের মধ্যে সাকিবের খালাতো ভাই মিজানুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাকিব ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার একটি দরিদ্র পরিবারের সন্তান সাকিব। সাকিবের বাবা দিনমজুর। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়।'

তিনি বলেন, 'পরিবারকে সাহায্য করতে এবং ছোট ভাইবোনের খরচ মেটাতে সাকিবকে প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে হয়।'

ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করার বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর বলেন, 'বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাকিবকে তার রুম থেকে ডেকে নির্যাতন করেছে। পুলিশ ছাত্রাবাসের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করলে তা প্রমাণিত হবে।'

এ ঘটনায় পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মিজানুর।

যোগাযোগ করা হলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। আহত শিক্ষার্থীদের ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাদের কেউ কেউ বলেছেন যে তারা ওয়াশরুমে পড়ে আহত হয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন তারা দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।'

এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি কেন, জানতে চাইলে মিজানুর বলেন, 'ছেলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে পরিবার।'

'আমরা আজ সোমবার চমেক একাডেমিক কাউন্সিলের কাছে একটি অভিযোগ দিয়েছি, যেন এ ঘটনার একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হয় এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতসহ ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে নির্যাতিত ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।'

যোগাযোগ করা হলে চমেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. শাহেনা আক্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, তিনি আহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের কাছ থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছেন। কলেজের একাডেমিক কাউন্সিল এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে শিগগির বৈঠকে বসবে।

চমেক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আ জ ম নাছিরের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেয়। সেসময় ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়। 

অবশ্য ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরও কলেজ থেকে বিতাড়িত হতে হয়। 

তবে, ২০০৮ সালের পর থেকে ১২ বছর ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ২০২০ সালে চমেক ছাত্রলীগে আরেকটি উপদল সৃষ্টি হয়। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুলের অনুসারীরা এই উপদলের কর্মী।

এরপর থেকে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে সংঘর্ষ শুরু হয়। শুধু ২০২০ সালে দুই উপদল অন্তত ৬-৭ বার সংঘর্ষে জড়ায়। সে বছর উভয় পক্ষের অন্তত ১৩ জন শিক্ষার্থী সংঘর্ষে আহত হয়। 

এ বিষয়ে জানতে আজ সোমবার রাতে আ জ ম নাছির উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও, তিনি রিসিভ করেননি। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুলের নম্বরে ফোন করা হলে, সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগে আ জ ম নাছির চমেক ছাত্রলীগের কমিটি এককভাবে দিতেন। পরে ২০২০ সালে কলেজে মুহিবুলের অনুসারীদের একটা উপদল তৈরি হয়। এ দুই গ্রুপের মধ্যে তখন থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়।'

তিনি আরও বলেন, 'চমেক শাখার ওপর আমাদের মহানগর ছাত্রলীগের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এটা কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। আমার মতে কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় সেখানে কোনো সমস্যা হবার কথা না।'
 
২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর চমেক শিক্ষার্থী মহিবুলের অনুসারী উপদলের কর্মী মাহাদী জে আকিব নাছিরের অনুসারীদের হামলায় গুরুতর আহত হন। আকিবের মাথার খুলির হাড় ভেঙে যায়, তাকে আইসিইউতে পাঠানো হয়।

গত বছরের ২৮ মার্চ একটি অপারেশনের মাধ্যমে আকিবের মাথার খুলির হাড়ের একটি অংশ সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয় বলে জানান চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, আকিবকে ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

ওই ঘটনার পর চমেকের একাডেমিক কার্যক্রম ২৭ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল।

পরে ২০২১ সালের নভেম্বরে ক্যাম্পাস ও ছাত্রাবাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একাডেমিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়।

২০২১ সালের নভেম্বর থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও, ছাত্রাবাসে সংঘর্ষ ও নির্যাতন বন্ধ করা যায়নি। এ ঘটনার আগেও ২০২১ সালে দুইবার ছাত্রলীগের দুই উপদল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি নগরীর নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকায় অবস্থিত চমেকের দুটি হোস্টেলে ছাত্রলীগের দুই উপদলের মধ্যে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের পর ছাত্রাবাস দুটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। 

কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসগুলোতে থাকতেন বলে জানা গেছে। ছাত্রাবাসগুলো এখনো বন্ধ আছে বলে জানান হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট এবং চমেক ফার্মাকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাসুদ রানা।

Comments

The Daily Star  | English

Nahid warns against media intimidation, vows stern action

The government will take stern action against those trying to incite violence or exert undue pressure on the media or newspapers, said Information Adviser Nahid Islam today

2h ago