শ্রদ্ধা

বিরলপ্রজ এক সাধক সুবিমল মিশ্র

সত্যিকার্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছিলেন সুবিমল মিশ্র। যাকে অনেকেই কিংবা প্রত্যেকেই দেখছেন একগুঁয়েমি, ক্রোধ বা জেদ হিসেবে। সত্যিই কি তাই, নাকি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি? তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়োজোর এক বছর। বিংশ শতাব্দীতে নয় কেবল, একবিংশ শতাব্দেও হেরফের হয়নি শোকের আয়ুর বয়স। উপরন্তু যোগ হয়েছে একগুঁয়েমি, ক্রোধ বা জেদের আয়ু, যার দৌড় বড়জোর একবছর। সুবিমল এখানেই ব্যতিক্রম। সবার থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র। নিজের জেদ, একগুঁয়েমি, ক্রোধকে তিনি পরিগণিত করেছিলেন সাধনায়, যা জপ করে গেলেন আমৃত্যু। বাংলা সাহিত্যে তো বটেই ভারতের অনভাষাভাষির সাহিত্যেও এরকম উদাহরণ আক্ষরিক অর্থেই তুলনারহিত।

সুবিমল বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর, জন্মেছিলেন ১৯৪৩ এ, মারা গেলেন ৮ ফেব্রুয়ারি। মনে করা হয় ৮৪ বছরে মনুষ্যজীবনের চক্র পূর্ণ হয়। সেই অর্থে জীবন চক্রের প্রায় পুরোটাই পূর্ণ করেই বিদায় নিলেন তিনি। বিস্ময় লাগে এবং দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে ওঠে যখন দেখি এক জীবনের পুরোটা সময় তিনি নিজস্ব সাধনা থেকে বিচ্যুত হননি এক মুহূর্তের জন্য। নিজের জীবনের সঙ্গে ধনুর্ভঙ্গ এমন পণ সাহিত্যের জগতে সুবিমল ছাড়া আর কেউ করতে পেরেছেন কি?

প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকার যে ব্রত লেখালেখি জীবনের প্রারম্ভিকলগ্নে তিনি নিয়েছিলেন তা থেকে সরেননি কখনোই। লেখা প্রকাশের জন্য নামীদামী সংবাদপত্র বা সাহিত্য পাতায় যেমন কখনো লেখেননি তেমনই গল্প-উপন্যাসের বেশীরভাগ বই নিজেই সম্পাদনা, প্রকাশ ও বিক্রয়ের কাজ করেছেন।

শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিন ও ছোট ছোট পত্র-পত্রিকায় লিখেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব যুগের অবতারণা করেছেন, যে যুগকে অনায়াসেই বলা যায় সুবিমল যুগ। কৌতূহলোদ্দীপক ও চিত্তাকর্ষক দিক হলো তার মৃত্যুর পর বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পত্রিকাগুলো তাকে কেবল স্মরণ করেননি, সুবিমলের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি যুগের অবসান হল বলেও উল্লেখ করে সুবিমল যুগকে মান্যতা দিয়েছেন। সুবিমলের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যে সব প্রতিষ্ঠানকে তিনি এড়িয়ে চলেছেন সযত্নে ও সতর্কতায়, সেইসব প্রতিষ্ঠানই তার কাছে হাজির হয়েছে।

সুবিমলের দেখানো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায় দুই বাংলার অনেকেই আন্দোলিত হয়েছিল। যদিও সময় বিচারে এটাই প্রমাণিত হয়েছে,  প্রবলভাবে আলোড়িত হওয়া তরুণরা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে যতটা ফ্যাশন হিসেবে নিয়েছিল, ততটা সাধনা হিসেবে নয়। রাজধানী ঢাকায় নয় এর দশকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা শব্দটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল। শাহবাগ, প্রেসক্লাব, পল্টন, মতিঝিল কিংবা কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটে যে উঠতি তরুণ সাহিত্যকর্মী প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বুলি আওড়াত, কয়েকদিন পরেই দেখা যেত গুটি গুটি পায়ে সে প্রতিষ্ঠানের একজন হয়ে গেছেন। বোঝা যেত, তাদের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ। সুবিমল ছিল এই সব তরুণ থেকে ভিন্নধাতুতে গড়া এক সাহিত্যকর্মী। একারণে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সাধনায় তিনি একাই নির্মাণ করেছেন স্বতন্ত্র এক যুগ।

প্রতিষ্ঠানবিরোধী একজন সাহিত্যকর্মীর লেখার ভুবন কেমন হতে পারে, কতটা স্বতন্ত্র হওয়া প্রয়োজন, প্রচল স্রোতে চলেন যারা তাদের থেকে, তারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জারি রেখেছেন সুবিমল। উপন্যাসের নামকরণ থেকেও এ সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা মেলে। সাহিত্যিক সুবিমলের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হল : তেজস্ক্রিয় আবর্জনা, আসলে এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে ‍উঠতে পারত, নাঙা হাড় জেগে উঠেছে, রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন, কণ্ঠ পালক ওড়া, হাড়মটমটি, ওয়ান পাইস ফাদার মাদার, চেটে চুষে চিবিয়ে গিলে, প্রভৃতি।

এক্ষণে আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত সুবিমলের বিখ্যাত ছোটগল্প 'হারানমাঝির বিধবা বৌ এর মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি'। যার শুরুটা এরকম : 'হারাণ মাজির বিধবা বৌটার আর কোন উপায় ছিল না, গলায় দড়ি দিয়ে মরল। বাইশবছরী আঁটো মড়া এখন তরতর করে খালের ঘোলা জলে ভেসে যাচ্ছে। দুটো কাক অনেকক্ষণ ধরে ডেকে আসছিল এখন ফিরে যা।'

গল্পটার শেষ হচ্ছে এভাবে, 'লোকের মুখে এখন হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া ছাড়া অন্য কোন কথা নেই। সকালবেলা আমেরিকান বিমানটি দমদমে নামছে, চারদিকে গণ্যমান্য সবাই অপেক্ষা করে রয়েছেন, এক সম্ভ্রমপূর্ণ মুহূর্ত, এই বিমানে গান্ধীজীর সোনার ‍মূর্তি রয়েছে। ভীড়ের ভেতর থেকে শোনা গেল গান্ধী আমাদের আদর্শ গান্ধী আমাদের আরাধ্য। দেড় বছরের অনাথ বাচ্চাটি সমানে কেঁদে চলেছে। কে যেন হাত তুলে আকাশে কাক-শকুন উড়ছে দেখিয়ে দিল। এবার কাঠের বাক্স নামানো হচ্ছে, ডালাটা খোলা হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রধান তাঁর দস্তানা-পরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন গান্ধীজীর সোনার মূর্তি স্পর্শ করার জন্য। সৈন্যবাহিনী রাজকীয় মর্যাদায় দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রীয় পতাকা, সিল্কের তৈরি, পৎপৎ উড়ছে। ড্রাম বাজছে তালে তালে। অনেক ফালতু লোক ব্যাপার কি দেখার জন্য দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে, তাদের ঘেঁষতে দেওয়া হচ্ছে না। একসময় বাক্সটার ডালা খোলা হল, এবং সংগে সংগে সমস্ত উপস্থিত জনবর্গ সবিস্ময়ে দেখলেন বাক্সটার ওপরে হারাণ মাঝির বৌয়ের গলিত মড়াটি শোয়ানো রয়েছে। সকলে সমবেত চমকালেন, নাকে রুমাল দিলেন এবং বুঝতে পারলেন হারাণ মাঝির বৌয়ের মড়া না সরালে সোনার গান্ধিমূর্তির নাগাল পাওয়া যাবে না।

সুবিমলমিশ্র সংগ্রহের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, 'তোমার লেখা যেন কোনওভাবেই মহৎ না হয়ে যায়।' সুবিমল কি বিশ্বাস করতেন মহৎ লেখার কোন দায় থাকে না, কোন প্রশ্ন তোলে না। এ কারণে লেখককে নির্মাণ করতে হবে সেই দূরত্ব যাতে লেখা যেন মহতের দোষে আক্রান্ত হয়ে না পড়ে। এক লেখায় সুবিমল বলেছিলেন, '২৪ ঘণ্টায় ৩ ঘণ্টা লিখি, ৫ ঘণ্টা পড়ি।' একথার মধ্যে দিয়েও টের পাওয়া যায় তার লেখালেখি নিয়ে সাধনা ও বোঝাপড়াটা কোন স্তরের ছিল। লেখককে যে ভাল পাঠক হতে হয়, প্রতিনিয়ত পাঠের মধ্যে দিয়ে শানিত রাখতে হয় তার সৃজন নির্মাণ, সেই সত্যই স্পষ্ট হয়েছে এই বয়ানে। এই প্রতীতি থেকেই আস্থা রেখেছিলেন এই প্রত্যয়ে যে, 'যে লেখক লিটল ম্যাগাজিনকে অবহেলা করে সে আদৌ লেখকই নয়।'

সুবিমলের নির্মীয়মান পথ বিরলপ্রজ পথিকের জন্য। ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন উজানে চলেন। তার জন্য কবুল করেন সকল ঝুঁকি। লেখা কোথায় প্রকাশ পাচ্ছে, পুরস্কার কারা দিচ্ছেন সেসবেও কেউ কেউ হন ভীষণ রকমের সতর্ক। অবলম্বন করেন যতটা সম্ভব সাবধানে এগুনোর নীতি। যেমনটা দেখা মিললো সুবিমল মারা যাওয়ার মাত্র একদিনের ব্যবধানে। পুরস্কারের সঙ্গে বিতর্কিত এক প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত থাকায় সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন তামিলনাড়ুর একজন দলিত লেখক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ''পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত 'বিতর্কিত' আদানি শিল্পগোষ্ঠীর নাম। তাই পুরস্কার না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তামিলনাড়ুর এক দলিত মহিলা কবি।

একটি ইংরেজি সংবাদপত্র সম্প্রতি একটি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বারো জন কৃতী মহিলাকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন দলিত সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা তামিল কবি সুকিরথারানিও। পুরস্কার গ্রহণের বিষয়ে আয়োজকদের প্রাথমিক ভাবে সম্মতিও জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি জানতে পারেন এই পুরস্কারটি আদানি গোষ্ঠী 'স্পন্সর' করছে। তারপরই 'আদানিদের টাকায় কেনা পুরস্কার' গ্রহণ করবেন না বলে আয়োজকদের জানিয়ে দেন সুকিরথারানি। নিজের এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তিনি বলেন, 'আমি যে দর্শনে বিশ্বাস করি এবং যে দর্শন জীবনে মেনে চলি, এই পুরস্কার নিয়ে তারই বিরুদ্ধাচরণ করা হবে।''

সুবিমল নিজের লেখালেখিকে নিজেই বলতেন অ্যান্টি গল্প ও অ্যান্টি উপন্যাস। সেটা যে কেবলই কথার কথা নয় লেখালেখিতে তার প্রমাণ জারি রেখেছেন। তিনি সেইসব স্বতস্ত্রধর্মী লেখকদের একজন যারা নিজস্ব ধারা নির্মাণ করেন, ভাঙ্গেন এবং আবারও নির্মাণ করেন।

সুবিমল একজীবনে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে, নিজ উদ্যোগে বই প্রকাশ ও বিক্রয় চেষ্টা জারি রেখে, এবং লেখালেখি ভুবনের ক্রমাগত ধারা বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে একটা সাধনায় করেছেন, যা একান্তই সুবিমলমিশ্রর সাধনা, যার ইতি ঘটল তার জীবনাবসানের মধ্যে দিয়ে। এই সাধনায় দ্বিতীয়জন নেই আর, এ কারণে জীবনানন্দের শরণ নিয়ে বলতে হয়, এ পৃথিবী (পড়ুন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য) একবার পায় তারে (পড়ুন সুবিমলরে), পায় নাকো আর।

Comments

The Daily Star  | English
Motorcycle sales in the last 6 years

Motorcycle sales hit five-year low

Motorcycle sales in Bangladesh hit a five-year low in 2024, in continuation of a downward trend emanating from economic instability, inflation and political transitions, according to industry experts.

11h ago