নাজিম হিকমত: কবিতা আর বিপ্লব মিলেছে যেখানে
তার ৬১ বছরের জীবনের ১৭ বছরই কেটেছে স্বৈরশাসকের কারাগারে বন্দী হয়ে। অপরাধ? সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে কবিতায় বিপ্লব আর স্বপ্নের জানান দিয়েছিলেন তিনি, লিখেছিলেন সুন্দর এক পৃথিবীর স্বপ্ন, এক মানবিক সমাজের গল্প। এক সময় দেশচ্যুতও হয়েছেন অত্যাচারে না টিকতে পেরে। চেয়েছিলেন, তার কবরটা যেন অন্তত হয় জন্মভূমি তুরস্কের মাটিতে। সেই চাওয়াটাও পূর্ণ হয়নি বিপ্লবী এই কবির। তার শেষ ঠিকানা হয়েছে রাশিয়ার মস্কোতে।
তারপরও তিনি লিখেছিলেন,
'জীবন বড় সুন্দর ব্রাদার,
একে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিও না'।
শোষণে তার জীবন অস্থির হয়েছে বারবার। তবুও তিনি গেয়ে গেছেন জীবনের জয়গান। জ্যঁ পল সার্ত্র লিখেছিলেন, 'নাজিম হিকমত এমনই একজন কবি, যার কাব্য আর জীবনের মাঝে কোনো ভেদরেখা টানা যায় না!'
তার 'জেলখানার চিঠি' কাব্যগ্রন্থের সব কবিতা যেন স্বৈরশাসন আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনসমুদ্রের ঢেউয়ের নিঃশ্বাস। তাইতো সেই কবিই লিখেন স্বৈরাচারের শোষণের বিরুদ্ধে,
'মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়,ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।'
নাজিম হিকমতের ওপর অত্যাচার কতটা ছিল, তার একটি হিসেব করেছিলেন কথাসাহিত্যিক ইলিয়া এরেনবুর্গ। তার তথ্যমতে, নাজিম হিকমতের বিরুদ্ধে যতগুলো মামলার রায় হয়েছিল, তাতে সব মিলিয়ে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাকে।
নাজিম হিকমত জন্মেছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সালোনিকিতে, বর্তমানে যা পড়েছে গ্রিসে। তার বাবা তুর্কি হলেও মা ছিলেন জার্মান। মা জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। তাদের পরিবার ছিল বেশ প্রভাবশালী। অটোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত সমরনায়ক নাজিম পাশা ছিলেন নাজিম হিকমতের দাদা।
অন্যদিকে নানা হাসান এনভির পাশা ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের জেনারেল। মায়ের নানা তো আরও বিখ্যাত, পোলিশ অটোমান যুগে বিখ্যাত বিপ্লবী মোস্তফা সেলেলেটিন পাশা।
নাজিমের পড়াশোনা শুরু হয় গেস্টেপের এক স্কুলে। তার ছোটবেলা ছিল উল্লেখ করার মতো। দাদা নাজিম পাশা নিজেও কবিতা লিখতেন। ছিলেন ভীষণ শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ, রুচিবোধ ছিল ঈর্ষণীয়।
গেস্টেপের স্কুলে পড়ার সময়ই দারুণ মেধার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল নাজিম হিকমতের। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই টেক্কা দিয়েছিলেন চতুর্থ শ্রেণীর প্রতিযোগীদের সঙ্গে। পরে তাকে ভর্তি করানো হয় গালতসরায়ের হাইস্কুলে, যেটি আজও তুরস্কের সেরা স্কুলগুলোর একটি। সেখানেই ১৪ বছর বয়সে প্রথম কবিতায় হাতেখড়ি হয়েছিল নাজিমের। কবিতায় তার হাতেখড়ির পিছনে দারুণ অবদান ছিল মায়ের ও নানার। সে সময়ই শিখেছিলেন ফরাসি ভাষা।
নাজিম হিকমতের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৭ বছর বয়সে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। অটোমান সাম্রাজ্য জার্মানির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তার কিছুদিনের মধ্যেই নেভাল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন নাজিম। কিন্তু এক বছরের মাথায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নৌবাহিনীতে থেকে বাদ দিয়ে ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
১৯২১ সাল। স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে বন্ধু ইউসুফ জিয়া, ফারুক নাফিজ ও নুরেদ্দিনের সঙ্গে ইস্তাম্বুল ছেড়ে আনাতোলিয়ায় পালিয়ে গেলেন নাজিম। আনতোলিয়া তখন তুরস্কের সব আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। সেখানেই তাদের দেখা হলো মুস্তফা কামাল পাশার সঙ্গে। নাজিমকে দেখে তিনি নিজেই বলে উঠলেন, 'তুমি কবিতা লিখতে থাকো, দেশের মানুষ এখনও প্রচণ্ড অসচেতন। তোমার কবিতা, তোমার সাহস, জয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে। এই আন্দোলন আমাদের। মানুষের সংযুক্ত হওয়া ভীষণভাবে প্রয়োজন।'
বছর দুয়েক পরে পতন হলো অটোমান সাম্রাজ্যের। নাজিমের সাধ, তিনি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখবেন। জর্জিয়া হয়ে তিনি পৌঁছলেন মস্কো। মস্কো তাকে এমনই টানল যে, ভর্তি হয়ে গেলেন রাশিয়ার 'কমিউনিস্ট ইউনিভার্সিটি অফ দ্য টইলার্স অব দ্য ইস্ট' এ। এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হলো বহু বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীর। ঘনিষ্ঠতা হলো ভ্লাদিমির মায়াকভস্কি ও বিখ্যাত রুশ নাট্যকার ভেসেভলড এমিলিভিচ মায়ারহোল্ডের সঙ্গে। পরিচয় ঘটল লেনিনের মতাদর্শের সঙ্গে।
লেনিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তুরস্ক স্বাধীন হওয়ার পর ১৯২৪ সালে স্বদেশে ফিরে যান নাজিম। দুচোখ ভরা স্বপ্ন তখন তার। আশা, দেশকে নতুন করে গড়বেন। তুরস্কে ফিরে একটি বামপন্থী পত্রিকায় কাজ শুরু করলেন নাজিম। উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন সাধারণ মানুষকে। অধিকার সম্পর্কে সজাগ করতে লাগলেন। কিন্তু সেই অনুপ্রেরণাদাতা কামাল আতাতুর্ক সরকারেরই তাতে আঁতে ঘা লাগলো। নাজিম হিকমতকে পাঠানো হলো কারাগারে। এক সময় শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান নাজিম হিকমত। বাধ্য হয়ে তিনি আশ্রয় নিলেন মস্কোতে। মস্কোতে দোর্দণ্ড প্রতাপে কবিতা, গান লিখে চলছিলেন তিনি। একটা পর্যায়ে তুরস্কের সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ফিরে যান নাজিম।
কিন্তু গোয়েন্দা, সরকারি চরদের চোখ সারাক্ষণ তার দিকেই ছিল। এরপরও দমানো যায়নি তাকে। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই অবস্থান নিলেন তিনি। তার কলম আর কবিতা হয়ে উঠল লাখো নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠ। আঘাতের পর আঘাত এলো তার ওপর। আবার আটক হলেন। ১০ বছরে তাকে জেলে নিক্ষেপ করা হলো ৫ বার। তখন সরকারের চোখে এক আতঙ্কের নাম নাজিম।
তাকে একবার জেলে পাঠানো হয় তো, আরেকবার জেল থেকে ছাড়ানো হয়। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৮— এই ১০ বছরে প্রকাশিত হয় নাজিমের ৯টি কাব্যগ্রন্থ। প্রতিটিই কারাগারে বসে লেখা। জেলে বসেই লিখেছিলেন, 'মানুষের মুণ্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়, ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে।'
১৯৩৮ সালে নাজিমকে গ্রেপ্তার করে ছাত্র বিপ্লবের নামে ষড়যন্ত্রের অপবাদ দিয়ে প্রহসনের বিচারের সম্মুখীন করা হলো। বলা হলো, তিনি সামরিক বাহিনীকে উৎসাহিত করছেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য। সেই প্রহসনের বিচারের রায়ে নাজিম হিকমতকে ২৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো। নিষিদ্ধ করা হলো তার সব বই। এক মুহূর্তে গোটা তুরস্কে তিনি হয়ে গেলেন নিষিদ্ধ। কিন্তু মানুষের মনে তিনি তখনও প্রবলভাবে উপস্থিত। নিজেকে নিয়ে নাজিম হিকমত লিখলেন,
'নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়!'
নাজিমের কবিতা দাঁড়াল সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার তরুণ, অসহায় মানুষ রাস্তায় নামল। বিশ্বখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জ্যা পল সার্ত্রে তার পক্ষে দাঁড়ালেন। আন্তর্জাতিক কমিটি করা হলো। এর পরের বছর ১৯৫০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলো নাজিম হিকমতকে। সেই বছরই একসঙ্গে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার পেলেন নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, পাবলো পিকাসো, পল রবসন, ওয়াণ্ডা জাকুবোস্কা। এর মধ্যে তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো। সালটা ১৯৫১। মুক্তি পেলেন নাজিম হিকমত।
কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাকে ২ বার হত্যার চেষ্টা করে সাম্রাজ্যবাদীরা। এক সময় প্রাণশঙ্কায় তিনি নির্বাসিত হয়ে পাড়ি জমালেন রাশিয়ায়। তুরস্কের সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে চিরতরে নিষিদ্ধ করল তাকে।
তাতেও দমেননি নাজিম, নিজের আদর্শে অবিচল ছিলেন। কবিতা, সাম্য, জীবনবোধ, আদর্শ, সংগ্রাম সবকিছু একত্রিত হলো তার কবিতায়। বছরের পর বছর জেলের ছোট্ট কুঠুরিতে শীতে-তীব্র গরমে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল তার জীবন। এক তীব্র শীতের রাতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে তিনি লিখেছিলেন, 'দুঃসময় থেকে সুসময়ে মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে।'
মৃত্যুর আগে নাজিম হিকমতের শেষ ইচ্ছে ছিল, তার কবর হবে তুরস্কের মাটিতে। সেই আশাটাও পূর্ণ হলো না। তার শেষ ঠিকানা হলো রাশিয়ার মস্কোতে।
প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি নিয়ে তিনি করুণ হৃদয়ে লিখেছিলেন,
'My homeland, my homeland, my homeland
no longer have I a cap made of you
nor a shoe that carries your soil
you remain only in the grey of my hair
in the failing of my heart
in the lines of my brow
My homeland'
কিংবদন্তি কবি পাবলো নেরুদা নাজিম হিকমতকে নিয়ে লিখেছিলেন,
'সদ্য মুক্তি পাওয়া / বন্দীদের একজন নাজিম হিকমত /
তার কবিতার মতো / লাল রং সোনার সুতায় /
বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।'
১৯৬৩ সালের আজকের দিনেই মস্কোকে ঘুমিয়ে পড়েন আজন্ম বিপ্লবী কবি নাজিম হিকমত। আজ নাজিম হিকমতের প্রয়াণ দিবস। বিনম্র শ্রদ্ধা তার প্রতি।
তথ্যসূত্র:
Life's good, brother / Nazim Hikmet
The life and work of Nazim Hikmet / Saime Goksu & Edward Timms
In jail with Nazim Hikmet / Orhan Kemal
Comments