আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন

‘ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’

অষ্টম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। নীতি ও কর্মের রূপান্তর করার জন্য আমাদের এখন শনাক্ত করতে হবে কীভাবে নদী ও প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যায়ন করা যায়।

অষ্টম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন সফল করার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সমাপনী অধিবেশনে তিনি এ কথা বলেন।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, 'সরকার বিবিএসের সহায়তায় প্রাকৃতিক সম্পদের হিসাব করার উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে নদীও একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে। এটি দেশের জিডিপিতে প্রতিফলিত হবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্যায়নের ওপর বার্ষিক প্রকাশনা থাকবে।'

তিনি উল্লেখ করেন, পানি ও এর ব্যবস্থাপনার মধ্যে যোগসূত্রকে সর্বত্র জোর দিতে হবে। যেহেতু আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি এবং দেশের আরও উন্নয়ন ঘটছে, তাই পানি শাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠবে।

সাবের হোসেন চৌধুরী পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত পানি জাদুঘরকে কীভাবে সমৃদ্ধ করা যায়, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন এবং পানি ও নদী সম্পর্কে মানুষের জানার জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করার বিষয়েও অভিমত প্রকাশ করেন।

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের আয়োজনে 'জীবন-জীবিকার জন্য পানি এবং নদী: যুবদের ভূমিকা' প্রতিপাদ্য নিয়ে সিলেট জেলায় ২৩ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ দিনব্যাপী অষ্টম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিদর্শনের মাধ্যমে সম্মেলনের সূচনা হয়।

এই সম্মেলন নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সরকার প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে পানি ও নদী সম্পর্কিত সমস্যার ক্ষেত্রে যুব সংহতকরণের ওপর আলোকপাত করে। সম্মেলনে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পানি ও নদী শাসনে অবদান রাখতে পারে এমন বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় উঠে আসে।

সম্মেলনটি ৫টি বিষয়ভিত্তিক ক্ষেত্র, জলাশয় ইতিহাস, রূপবিদ্যা এবং পরিবর্তন, নদী একটি জীবন্ত সত্তা এবং নদীর ওপর নৃতাত্ত্বিক হস্তক্ষেপের প্রভাব, পানি ও নদী অধিকারে যুব সম্পৃক্ততা, আন্তঃদেশীয় নদী ও পানি রাজনীতি, উদ্ভাবন, পানি, বাস্তুতন্ত্র ও টেকসই জীবিকাকে আবর্ত করে অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনের প্রথম দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এক ভিডিওবার্তার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

তিনি বলেন, 'মৎস্য আহরণ, কৃষিকাজ এবং শিল্প সবই পানির ওপর নির্ভর করে, যেখানে বাংলাদেশের ৮২০টিরও বেশি নদী রয়েছে, যা আমাদের ভূখণ্ডকে বিশ্বের বৃহত্তম জীবন্ত ব-দ্বীপে পরিণত করেছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি, যার ফলে নদী ভাঙন, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত ঘটনা বেড়েছে। এটি আমাদের জন্য একটি অস্তিত্বের প্রশ্ন, এজন্য পানির বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবিলা প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান খুঁজতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি- আঞ্চলিক শান্তি ও সংহতির জন্য সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে।'

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, '২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তুরাগ নদীকে জীবিত সত্তা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, যা একটি যুগান্তকারী রায়।'

তিনি আরও বলেন, 'জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের একই নামের নদীগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য একটি কাঠামো তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে নদীর সঠিক গণনা করা যায় এবং সুরক্ষিত রাখা যায়।'

অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, 'নদীর প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার ওপর ব্যাপকভাবে রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে নদীগুলো দখল ও দূষিত হচ্ছে। নদীগুলোর আয়তনও সংকুচিত হচ্ছে দিন দিন। নদীর অস্তিত্ব ও প্রাণ আছে। জোর করে এর গতিপথ পরিবর্তন করা প্রকৃতি এবং মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। নদীগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতে দিতে হবে।'

'সম্মেলনের একাধিক সেশন সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো ভাগ করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। এই বছর আমরা আমাদের স্বপ্ন, সংস্কৃতি এবং জীবন ও জীবিকার অংশ হিসেবে নদী ও পানির ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করে তরুণদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেছি', যোগ করেন তিনি।

সম্পদ মূল্যায়নে সাবের হোসেন চৌধুরীর উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় ফারাহ কবির বলেন, 'প্রাকৃতিক সম্পদ মূল্যায়ন করার জন্য সামাজিক সূচকের  বৈশ্বিক মানদণ্ডের লিঙ্গ সংবেদনশীলতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'যেহেতু আমরা অষ্টম আন্তর্জাতিক পানি সম্মেলন শেষ করছি, আমি বিশ্বাস করি- এই সম্মেলনগুলো আমাদের সঠিক পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছে, বিশেষ করে সারাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মানুষকে পানি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছে। এই বছর যেহেতু আমরা নদীর অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তরুণদের সম্পৃক্ত করার গুরুত্বের ওপর জোর দিচ্ছি, নীতিনির্ধারকদেরও ভাবতে হবে কীভাবে দেশের ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি নদী ও পরিবেশের সমস্যাগুলোর পক্ষে সমর্থন করার জন্য সংগঠিত করা যায়।'

'এই আঞ্চলিক সম্মেলন ভারত, নেপাল বাংলাদেশ এবং চীনের পানি এবং নদীগুলির অভিন্নতা অনুসন্ধানের একটি দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আমরা প্রতিটি দেশের নদী এবং এর দূষণের দিকে নজর দিতে পারি এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের নদী রাজনীতির সকল রূপ থেকে দূরে থেকে সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো শেয়ার করার জন্য সংলাপের নিমিত্তে একটি আন্তঃসীমান্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারি', বলেন তিনি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, 'নদীর অবয়ব নির্ভর করে পানি ও পলল প্রবাহের ওপর। এসবের পরিবর্তন হলে স্বাভাবিকভাবেই নদীর ভৌগলিক পরিবর্তন আসে, যার কারণে নদীভাঙন দেখা দেয়। নদীভাঙনের ফলে মানুষের বসতি ও ফসলী জমি তলিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে নদী শাসনের কথা আসে, আর এই নদী শাসন করতে গেলেই নদীর স্বাভাবিক অবস্থা ও প্রবাহগত চরিত্রের পরিবর্তন আসে। তাই এসব বিষয় বিবেচনা করে টেকসই সমাধানের পথ বের করতে হবে।'

ভারতের পরিবেশ ও জলবায়ু সাংবাদিক এবং এনভায়রনমেন্ট গভর্নড ইন্টিগ্রেটেড অর্গানাইজেশনের (এনজিআইও) বিশেষজ্ঞ পরিচালক জয়ন্ত বসু বলেন, 'আমাদের একটি উপায় চিহ্নিত করতে হবে, যাতে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই উপকার করে। এসব নদীর পানির ওপর উভয় দেশের জনগণের সমান অধিকার রয়েছে, কারণ এসব নদীর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকাও জড়িত। কুশিয়ারা নদীর পানি বরাদ্দ চুক্তি অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর জন্য আলোচনার একটি প্রেক্ষাপট শুরু করেছে এবং আমাদের এই গতি ধরে রাখতে হবে।'

পোস্টডেম ইন্সটিটিউট ফর ক্লাইমেট অ্যাকশন রিসার্চের বিজ্ঞানী মফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা যদি খাদ্য নিরাপত্তা চাই, তাহলে আমাদের পানির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন, বাস্তুসংস্থান ও অর্থনীতিসহ নদীর অধিকারের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখতে হবে।'

নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনজুরুল হান্নান খান, অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সোসাইটির ভাইস-চেয়ার ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জহির বিন আলম, রিভারাইন পিপলের সম্পাদক শেখ রোকন, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান, সাংহাই নরমাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর আফ্রিকান স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক এবং ভাইস ডিরেক্টর ডা. ঝাং জিন এবং কলকাতায় অবস্থিত লিভিং ওয়াটারস মিউজিয়ামের (এলডব্লিউএম) আর্ট অ্যান্ড আউটরিচ কো-অর্ডিনেটর সুকৃত সেন সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।

সম্মেলনের অগ্রগতির পথ হিসেবে নদীর অধিকার নিশ্চিত করতে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে বলে জোর দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও, দেশের প্রতিটি নদীর জন্য একটি যুব প্ল্যাটফর্ম চালু করার প্রস্তাবনা আসে, যা নদী রক্ষাকারীদের কার্যক্রমকে নেতৃত্ব দেবে। ছবি এবং জিপিএস ব্যবহার করে একটি নদীর মানচিত্র ও এর ডেটাবেস স্থাপনে যুবকদের নিযুক্ত করার প্রস্তাবও সম্মেলনে উঠে আসে। সর্বোপরি নদী ও পানি সংক্রান্ত বিষয়ে জনগণের সম্পৃক্ততা, সচেতনতা, অ্যাডভোকেসি এবং আন্তঃসীমান্ত সংলাপ উন্নত করার পরামর্শও উঠে আসে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

2h ago