বড় যুদ্ধের পথে ইউরোপ

বড় যুদ্ধের পথে ইউরোপ
ইউক্রেনে আরও ভারি অস্ত্র পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে ডেনমার্ক। ছবি: এএফপি ফাইল ফটো

ইউরোপে চলছে বড় যুদ্ধের 'সাজসাজ রব'। এর বিরোধিতা করছে মহাদেশটির সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি। এই যুদ্ধে 'যোগ দিতে' বার্লিনকে রাজি করাতে পশ্চিমের মিত্র দেশগুলোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা জার্মানির রামস্টেইন বিমান ঘাঁটিতে বৈঠকে বসছেন।

আজ শুক্রবার ফরাসি গণমাধ্যম ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরের সংবাদে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রায় ১১ মাস পর রামস্টেইনে আজকের বৈঠকে ইউক্রেনকে আরও অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে।

প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যবহৃত জার্মানির 'লিওপার্ড ২' ট্যাংক কীভাবে কিয়েভকেও দেওয়া যায়, তা এই বৈঠকে আলোচনার অন্যতম বিষয়।

এতে আরও বলা হয়, 'লিওপার্ড' সরবরাহ নিয়ে মিত্রদের যেকোনো সিদ্ধান্তে বার্লিনের ভেটো ক্ষমতা আছে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ ইউক্রেনকে তাদের অত্যাধুনিক ট্যাংক দিতে নারাজ। রাশিয়ার সঙ্গে কোনো আঙ্গিকেই যুদ্ধে জড়াতে চায় না তার সরকার।

মিত্রদের ভাবনা, শীত শেষে আসন্ন বসন্তে জার্মান ট্যাংক ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করতে পারে। ঘুরিয়ে দিতে পারে যুদ্ধের মোড়। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জার্মানিকে পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এসব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়—ইউক্রেন-রাশিয়ায় শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে যুদ্ধের আবহ। কিয়েভকে কেন্দ্র করে বড় আকারের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউরোপ। একদিকে ক্রেমলিন মরিয়া পূর্ব ইউক্রেনে 'হারানো' শহরগুলো পুনর্দখলের জন্য, অন্যদিকে ইউক্রেনীয় সেনারা মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রুশদের দখলে থাকা ভূমি পুনরুদ্ধারে।

বড় যুদ্ধের পথে ইউরোপ
ইউক্রেনে স্ট্রাইকার যুদ্ধযান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, প্রচণ্ড শীতে যুদ্ধক্ষেত্রে তুলনামূলক 'স্থিতাবস্থা' থাকবে। তা হয়নি। বিবদমান ২ পক্ষই একে অপরের ওপর 'অপ্রত্যাশিত' হামলা চালিয়ে একে অন্যের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। এসব হামলা যুদ্ধ থামানোর আশা জাগায়নি; বরং পথ দেখিয়েছে একটি 'বড় যুদ্ধের'।

আজ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও এর ইউরোপীয় মিত্ররা রুশ হামলা ঠেকাতে ইউক্রেনে আরও ভারি অস্ত্র, কামান, যুদ্ধযান ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।

গতকাল মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্তায় বলা হয়েছে, প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের এসব যুদ্ধ সরঞ্জামের মধ্যে আছে ৫৯ ব্র্যাডলি যুদ্ধযান ও ৯০ স্ট্রাইকার আরমার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টোনি ব্লিনকেন বলেছেন, 'রাশিয়ার নৃশংস যুদ্ধের হাত থেকে ইউক্রেনকে বাঁচাতেই এই নতুন নিরাপত্তা সহযোগিতা প্যাকেজ।' এর মাধ্যমে ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা প্রায় সাড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের ৯ দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও তাদের প্রতিনিধিরা যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, কিয়েভে ৬০০ ব্রিমস্টোন ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হবে। ডেনমার্ক ও সুইডেন সেখানে দ্রুত বহনযোগ্য অত্যাধুনিক কামান পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'রুশ বাহিনীকে ইউক্রেন থেকে বিতাড়িত করতে কিয়েভকে অস্ত্রসজ্জিত করা জরুরি।'

এসবই আসন্ন বসন্তে ইউক্রেনকে ঘিরে সেই 'বড় যুদ্ধের' প্রস্তুতি বলে মনে করছেন পশ্চিমের সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এসব সামরিক সরঞ্জাম ইউক্রেনকে আরও আগেই দেওয়া উচিত ছিল।

গত ১৭ জানুয়ারি দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক মতামতের শিরোনাম ছিল, 'ভারি ট্যাংক ও মার্কিন চাপ ইউক্রেনের সাফল্যের চাবিকাঠি'। এতে ইউক্রেনে মিত্র দেশগুলোর সামরিক সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।

রাশিয়ার প্রস্তুতি

'বড় যুদ্ধের' প্রস্তুতি নিচ্ছে রাশিয়াও। ওয়াশিংটন পোস্টের সেই মতামতে আরও বলা হয়, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ইউক্রেনে বড় আকারের হামলার জন্য প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিপুল সংখ্যক সেনা প্রস্তুত করছেন।

এতে আরও বলা হয়, সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা—প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের বর্তমান সরকারকে উৎখাত ও কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ পুতিনের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা দেবে তা বলাই বাহুল্য।

ইউরোপে বড় যুদ্ধ
অত্যাধুনিক ‘লিওপার্ড ২’ ট্যাংক ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য জার্মানিকে চাপ দিচ্ছে মিত্ররা। ছবি: এএফপি ফাইল ফটো

গত ১৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, '২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে "বড় পরিবর্তন" আনছে রাশিয়া'।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় সামরিক বাহিনীর কাঠামোয় বড় পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে মস্কো।

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সেনাবাহিনীর প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি এর যুদ্ধের ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করা হবে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শইগু বলেছেন, 'রুশ ফেডারেশনে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করা হবে।'

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, পশ্চিমের দেশগুলো ইউক্রেনে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে যে 'ছায়াযুদ্ধ' চালিয়ে যাচ্ছে তা মোকাবিলায় রুশ সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন জরুরি।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইউক্রেনীয় বাহিনীর হামলার মুখে রুশ বাহিনী ক্রমাগত 'পিছ পা' হওয়ায় এ নিয়ে রাশিয়ায় সেনাদের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চিফ অব দ্য মিলিটারি জেনারেল স্টাফ বা দেশটির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে ইউক্রেন যুদ্ধ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু তাতেও যুদ্ধক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য পায়নি রুশ বাহিনী। এক্ষেত্রে ভাড়াটে যোদ্ধাদের সহযোগিতাও নিচ্ছে তারা। ওয়াগনার গ্রুপের এই যোদ্ধারা পূর্ব ইউক্রেনের রুশ ভাষাভাষী, লবণ খনিসমৃদ্ধ এবং ছোট অথচ কৌশলগত শহর সোলেদার দখলের ঘোষণা দিয়েছে। ইউক্রেন বাহিনী বলছে, সেখানে এখনো যুদ্ধ চলমান।

ভাড়াটে যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে রুশ বাহিনী নতুন উদ্যমে বোমা ফেলছে সোলেদারের কাছাকাছি অপর রুশপ্রধান শহর বাখমুতে। ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধারা বাখমুতের কাছে ক্লিশচিভকা গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করলেও ইউক্রেন তা অস্বীকার করেছে।

গত ১৭ জানুয়ারি রুশ সংবাদমাধ্যম তাস জানায়, চেচেন বিশেষ বাহিনীর যোদ্ধারা পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক প্রদেশের মারিইনকা শহরের কাছে পৌঁছে গেছে। তারা শহরটি অবরোধ করে রেখেছে। চেচেন নেতা রমজান কাদিরভের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে বহু ইউক্রেনীয় সেনাকে বন্দি করা হয়েছে।

রমজান বলেন, 'এই সাফল্য আমাদের যোদ্ধাদের হাত দিয়ে এসেছে। এই শহরের কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম।'

পশ্চিমের সমরবিদদের ধারণা, আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পড়ার আগেই রুশ হামলা আরও তীব্র হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে গত ১৭ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো শীর্ষ মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ইউক্রেনের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা। প্রতিবেশী ইউক্রেনে পরাশক্তি রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযানের' প্রায় ১১ মাস পর এমন বৈঠক হলো। বৈঠকটি হয়েছে ন্যাটোভুক্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ পোল্যান্ডে।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়ে আরও বলা হয়, মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান ও আর্মি জেনারেল মার্ক মিলের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেছেন ইউক্রেনের চিফ মিলিটারি কর্মকর্তা জেনারেল ভালেরি জালুঝনি।

জার্মানির রামস্টেইনে আজকের বৈঠক নিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, 'চরম ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এর মানে যুদ্ধ নতুন আকার ধারণ করছে।'

এসব দেখে মনে হচ্ছে—ইউক্রেনকে ঘিরে বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago