বৃহত্তর রংপুরে জমে উঠেছে খেজুরের গুড়ের বাণিজ্য

খেজুরের গুড়
লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাটিবাড়ী গ্রামে খেজুরের গুড় উৎপাদন। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

শীত মৌসুমে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে একসময় গাছিরা খেজুরগাছ থেকে রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি নিজেরাই করতেন। রসের একটি অংশ নিতেন গাছি, একটি অংশ পেতেন গাছের মালিক। কিছু কিছু বিক্রি হতো। এই সনাতন ব্যবস্থা থেকে খেজুর গুড় উৎপাদন অনেকটা বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে আগেই।

এখন মৌসুম এলে খেজুরগাছ রীতিমতো ইজারা দেওয়া হয়। কোনো কোনো এলাকায় খেজুরগাছ বাণিজ্যিকভাবে লাগানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় রস নামানো ও গুড় তৈরির কাজটি কোথাও কোথাও মজুরিভিত্তিক পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

এবারও শীতের শুরুতে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধায় খেজুরের গুড়ের বাণিজ্য জমে উঠেছে। এসব এলাকায় গুড় তৈরির অস্থায়ী কারখানাগুলোতে প্রতি কেজি গুড় বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা দরে।

খেজুরের গুড় প্রস্তুতকারীরা জানান, প্রতিকেজি গুড় তৈরি করতে ৮-৯ কেজি খেজুরের রস লাগে। গুড় তৈরির প্রতিটি অস্থায়ী কারখানার অধীনে ১০০-৩০০টি খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতিটি গাছ থেকে ৩-৭ কেজি রস পাওয়া যায়।

প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। অধিক শীত ও কুয়াশা থাকলে গাছ থেকে বেশি রস পাওয়া যায়। এসব অস্থায়ী কারখানার প্রতিটিতে প্রতিদিন গড়ে ৪০-২০০ কেজি খেজুর গুড় উৎপাদন হচ্ছে। স্থানীয় ক্রেতারা কারখানা থেকেই এই গুড় কিনে নিচ্ছেন।

খেজুরের গুড়
লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাটিবাড়ী গ্রামে রসের জন্য খেজুর গাছ কাটছেন গাছি। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

রংপুর শহরের কামালকাছনা এলাকার গুড়ের আড়তদার সুপেন চন্দ্র সাহার কাছ থেকে জানান যায়, বৃহত্তর রংপুরের ৫ জেলা- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর ও নীলফামারীতে প্রায় ১০০টি পয়েন্টে খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে। শীত মৌসুমে গুড় তৈরির অস্থায়ী কারখানাগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১৫ মেট্রিক টন খেজুরের গুড় উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত বেশিরভাগ গুড় স্থানীয়রাই সরাসরি কারখানা থেকে কিনে নিচ্ছেন।

সুপেন চন্দ্র সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তবে অবিক্রিত গুড় কারখানার মালিকরা আমাদের কাছে ১৪০-১৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। আমরা সেগুলো ৫-৭ টাকা মুনাফায় খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি।'

রংপুর কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার খেজুর গাছ আছে। এসব খেজুর গাছ বাড়ির পাশে অথবা রাস্তার ধারে লাগানো।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাটিবাড়ী গ্রামের খেজুরের গুড় উৎপাদনকারী শওকত হোসেন জানান, তিনি স্থানীয় ৭ জন কৃষকের কাছ থেকে ১০৩টি খেজুর গাছ ইজারা নিয়েছেন। ৪ মাস এসব খেজুর গাছ থেকে তিনি রস সংগ্রহ করবেন।

প্রতিটি গাছের জন্য কৃষককে ৩০০ টাকা ও ২ কেজি করে গুড় দিতে হবে। তার অস্থায়ী কারখানায় প্রতিদিন ৪০-৪৫ কেজি গুড় উৎপাদন হচ্ছে। তবে কোনো পাইকারের কাছে তিনি গুড় বিক্রি করেন না।

শওকত হোসেন বলেন, 'স্থানীয় লোকজনের উপস্থিতিতে আমরা খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করি। আমাদের তৈরি খেজুর গুড় শতভাগ খাঁটি।'

খেজুরের গুড়
লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাটিবাড়ী গ্রামে খেজুর গুড় প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে গুড় কিনেন স্থানীয়রা। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার

একই এলাকার গুড় প্রস্তুতকারী দুলাল হোসেনের ভাষ্য, গুড় তৈরি করতে হলে খেজুর রস প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা আগুনে জ্বাল দিতে হয়। অনেক সময় গুড় পরিষ্কার করতে সোডা ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু স্থানীয় ক্রেতারা লাল রঙের গুড়ই পছন্দ করছেন। সেজন্য তারা সোডার ব্যবহার করছেন না।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা গ্রামে খেজুর গুড় প্রস্তুতকারী নুর আলম জানান, গুড় তৈরির কারখানার অধীনে ২৫০টি খেজুর গাছ আছে। তিনি প্রতিদিন গড়ে ১১০ কেজি গুড় তৈরি করছেন। স্থানীয় লোকজন তার কাছে 'খাঁটি' খেজুর গুড় কিনে আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও পাঠাচ্ছেন।

নুর আলম বলেন, 'আমাদের কাছ থেকে খাঁটি খেজুর পেতে অনেক ক্রেতা অগ্রিম টাকাও দেন। এ বছর খেজুর গুড়ের ব্যবসা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পাইকারের কাছে গুড় বিক্রির দরকারই হচ্ছে না।'

এই গ্রামের কৃষক নারায়ণ চন্দ্র বর্মণের কাছ থেকে জানা যায়, তার ১৪টি খেজুরগাছের সবগুলোই তিনি চুক্তিতে দিয়েছেন।

লালমনিরহাট শহরের আদর্শপাড়া এলাকার কলেজশিক্ষক দীনেশ চন্দ্র জানান, ইতোমধ্যে তিনি ৭ কেজি খেজুরের গুড় কিনেছেন গুড় তৈরির অস্থায়ী কারখানা থেকে। তিনি বলেন, 'বাজার থেকে কেনা গুড়ে ভেজাল থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই দাম খানিকটা বেশি হলেও কারখানা থেকেই কিনেছি।'

লালমনিরহাটের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম বলছেন, শীতে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে প্রায় ৩০ কোটি টাকার খেজুর গুড়ের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। কয়েকবছর আগেও রস বিক্রেতারা কৃষকের কাছ থেকে খেজুর গাছ চুক্তিতে নিয়ে কেবল রস বিক্রি করতেন। এখন পরিস্থিতি পালটেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

5h ago