একটি থেকে শতাধিক গরুর খামার

আমিরুল ইসলামের গরুর খামারের একাংশ। ছবি: স্টার

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লখিকুন্দা ইউনিয়নের বুরামপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান আমিরুল ইসলাম। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করে কৃষক পরিবারে সমৃদ্ধি বয়ে আনার। কিন্তু ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আকস্মিক বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।

বাবার জমি থাকলেও চাষাবাদ করে সফল হতে পারেননি। এক পর্যায়ে নিজেদের গবাদি পশুগুলোও বিক্রি করে দিতে হয়। চরের জমিতে সবজি আবাদ করে আশানুরূপ লাভ করতে পারছিলেন না। কিন্তু পিছিয়ে আসার সুযোগও ছিল না আমিরুলের।

১৯৯৪ সালে ১৪ হাজার টাকা দিয়ে এক আত্মীয়ের কাছ থেকে একটি শংকর জাতের গরু কেনেন আমিরুল। ফেলে দেওয়া সবজি দিয়েই গরুর খাদ্যের যোগান দিতে পারায় অতিরিক্ত খরচ করতে হয়নি তাকে। গরুটি ৩টি বাছুর জন্ম দেয়। এর মধ্যে ২টি ছিল গাভী। একইভাবে খাদ্যের জন্য অতিরিক্ত খরচ না করেই বাড়িতে গরু পালন করতে থাকেন তিনি।

এভাবে প্রায় ১০ বছরের মধ্যে কয়েক ডজন গরুর মালিক হন আমিরুল। লাভজনক হওয়ায় তিনি খামারের দিকে মনোযোগ বাড়াতে থাকেন। গবাদি পশুর ওপর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তার খামার। বর্তমানে তার খামারে শতাধিক গবাদি পশু আছে। এর মধ্যে ৬৫-৭০টি গরু থেকে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ লিটার দুধ সংগ্রহ করছেন তিনি।

তার আবাদকৃত প্রায় ৩০-৩৫ বিঘা সবজির খেতে এখন শুধু গরুর জন্য ঘাস চাষ করা হয়। পদ্মার চরের দুর্গম গ্রামে খামারি আমিরুলের বিশাল গরুর খামার থেকে দুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হওয়ায় মিল্কভিটা ঈশ্বরদী অঞ্চলে একটি চিলিং সেন্টার গড়ে তুলেছে।

এদিকে আমিরুলের এ সফলতা দেখে তার নিজের গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামে এখন আরও প্রায় শতাধিক গবাদি পশুর খামার গড়ে উঠেছে। আমিরুলের মতো এত বড় পরিসরে না হলেও, এসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদন হচ্ছে।

পদ্মার তীরবর্তী দুর্গম চরাঞ্চল লখিকুন্দা ইউনিয়ন এখন জেলার অন্যতম দুগ্ধ সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে।

গবাদি পশু পালনে এমন নিরলস পরিশ্রম ও সাধনার ফলে একটি এলাকার জনজীবনের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন করায় এ বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক প্রদান অনুষ্ঠানে আমিরুলকে পশুপালনে সফলতার জন্য স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।

আমিরুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিকল্পিতভাবে গবাদি পশু পালন করতে পারলে সেটি অনেক লাভজনক হতে পারে।'

বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকের স্বর্ণপদক গ্রহণ করছেন আমিরুল ইসলাম। ছবি: স্টার

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আমিরুল বলেন, 'প্রথমে একটি গরু থেকে যখন ৩টি বাছুরের জন্ম হয়, তখন ২টি গাভী রেখে বাকি এঁড়ে বাছুর বিক্রি করে দেই। এভাবে প্রতিবছর নতুন বাছুরের জন্ম হওয়ার পর বেশিরভাগ এঁড়ে বাছুর মাংসের জন্য বিক্রি করি, আর কিছু পালন করি।'

আর এভাবেই একটি গরু থেকেই প্রতি বছর বাড়তে বাড়তে এখন তার খামারে রয়েছে প্রায় ১১০টি গবাদি পশু।

আমিরুল জানান, কয়েক মাস আগেও তার খামারে প্রায় ১৫০টি গরু ছিল। সম্প্রতি ৪০টি গরু বিক্রি করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, প্রতিবছর তার খামার থেকে ৪০-৫০টি গরু ও বাছুর বিক্রি করা হয়, যা থেকে প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা আয় হয়। এ ছাড়া, প্রতিদিন ২০-২৫ হাজার টাকার দুধ বিক্রি করা হচ্ছে।

আমিরুল বলেন, 'গো-খাদ্যের দাম বাড়ায় এবং গবাদি পশুর পালনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় গবাদি পশুপালনে আগের মতো লাভবান হতে না পারলেও, প্রতি বছর খামার থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে ২০-২৫ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।'

স্থানীয়রা জানান, কঠোর নিষ্ঠা, পরিশ্রম, একাগ্রতা আর বাণিজ্যিক দিক পর্যালোচনা করে গবাদি পশু পালন করায় প্রায় ৩ দশকের মধ্যে আমিরুল সফল খামারি হতে পেরেছেন এবং এলাকাকে গবাদি পশু সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।

নিজের খামারে আমিরুল ইসলাম। ছবি: স্টার

জানতে চাইলে পাবনা জেলা প্রানিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আল মামুন হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডেইরি খামারি আমিরুল সারাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে খামার পরিচালনা করে সফল হওয়ার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পাশাপাশি তিনি একটি এলাকাকে গবাদি পশু সমৃদ্ধ করে তুলতে পেরেছেন। তার এমন অর্জনে প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে তাকে দেশের "ডেইরি আইকন" পদকে ভূষিত করে। এ বছর তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি স্বর্ণপদক (ডেইরি) অর্জন করেন।'

আমিরুল বলেন, 'একসময় চর এলাকায় গরু পালন করতে গেলে অনেকেই হাসাহাসি করেছে। কিন্তু একাগ্রতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে খামার করে আমি সফল হয়েছি, মানুষকে সফল হতে সহায়তা করেছি। গবাদি পশু পালন করে নিজেকে গর্বিত মনে করি।'

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

গবাদি পশু পালন করে সফল খামারি আমিরুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় শুধু দুধ ও মাংসের জন্য খামার পরিচালনা করা হলেও পরিকল্পিত উপায়ে খামারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে একটি গরুর খামার থেকে আরও অনেক দূর যাওয়া সম্ভব।'

তিনি জানান, বর্তমানে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, দুধের দাম কম, পশুপালন খরচ বেশিসহ বিভিন্ন কারণে খামার করতে অনেকেই অনাগ্রহী হয়ে পড়ছেন। তবে নিয়মিত দুধ ও মাংস উৎপাদনের পাশাপাশি তিনি খামার থেকে বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করে নিজের পরিবারের জ্বালানি খরচ যোগান দিচ্ছেন এবং গবাদি পশুর পয়ঃবর্জ্য থেকে জৈব সার উৎপাদন করে নিজের জমিতে ব্যবহার করছেন।

খামারের গরুর যত্ন নিচ্ছেন একজন কর্মী । ছবি: স্টার

তিনি জানান, ব্যক্তিপর্যায়ে স্বল্প পরিসরে এ কাজ করলেও, তার খামারের বিপুল পরিমাণ পয়ঃবর্জ্য ফেলে দিতে হচ্ছে।

সরকারি সহায়তা পেলে তার নিজের খামারের এবং আশেপাশের খামারের বিপুল পরিমাণ বর্জ্য দিয়ে তিনি বড় পরিসরে বায়োগ্যাস প্লান্ট ও একটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা তিনি জানান।

পাশাপাশি জৈব সার উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে তা বাজারজাত করার পরিকল্পনাও আছে তার।

এভাবে পরিকল্পিতভাবে বায়োগ্যাস প্লান্ট, বিদ্যুৎ প্লান্ট এবং জৈব সার উৎপাদন করে পুরো এলাকায় তা বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করতে পারলে এসব খামারকে আরও অনেক লাভজনক করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তিনি।

তবে এজন্য সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

S Alam threatens int'l legal action against govt over asset freezing: FT

Alam says his family's bank accounts were frozen, they were subjected to travel bans, and they lost control of their companies, all while facing investigations for alleged money laundering without formal notification.

45m ago