‘বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা হবে ভোক্তা বিরোধী, বেআইনি, প্রতারণা’
যেকোনো দিন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা ভোক্তা অধিকার বিরোধী ও বেআইনি হবে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম।
বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির ঘোষণার বিষয়ে গত ২ অক্টোবর বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেছেন, 'এটি ২-১ দিনের মধ্যেও হতে পারে। ২-১ দিনটা ৪-৫ দিনও হতে পারে।'
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর আবেদনের গণশুনানি হয়েছিল গত ১৮ মে। সে সময় বিদ্যুতের দাম প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি। তবে, এই প্রস্তাব ও সুপারিশ তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়ে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম মনে করেন, ওই গণশুনানির ভিত্তিতে এখন বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত রাখা বিইআরসির জন্য বাধ্যতামূলক।
গতকাল মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আইনগত অধিকার বা কর্তৃত্ব বিইআরসির। আইন মেনেই তাদের দাম বাড়াতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় তারা গণশুনানি করেছে এবং প্রচার করেছে যে ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে দাম বৃদ্ধি করবে। কিন্তু ৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি তো দূরে থাক, আরও ১৮ শতাংশ লোডশেডিং হচ্ছে। অর্থাৎ, উৎপাদন কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এটা তো দিবালোকের মতো সত্য।'
তিনি আরও বলেন, 'সুতরাং, যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণশুনানি হয়েছে, সেই গণশুনানির ভিত্তিতে বিইআরসি আর দাম বৃদ্ধি করতে পারে না। এর জন্য যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। শীত চলে আসছে। এখন এমনিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করতে হবে। যেসময় উৎপাদন বাড়ানোর কথা ছিল, তখনই কমিয়ে ফেলা হয়েছে।'
'যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দেবেন, সেই পরিমাণ বিদ্যুতের দাম পাবেন' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'লোডশেডিং হয়েছে, বিদ্যুৎ দেননি। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ দেননি, তার দাম ধরে দাম নিলে সেটা এক ধরনের প্রতারণা হয়ে যায়। এটা প্রতিযোগিতা আইনও অনুমোদন দেয় না, বিইআরসি আইনও অনুমোদন দেয় না।'
'বিদ্যুৎ ও তেল সাশ্রয়ের জন্য লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। মোট ২৫ শতাংশ লোডশেডিং হচ্ছে, অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের দাম কত হতে পারে সেই বিষয়ে আবারও গণশুনানি করতে হবে। সেক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি তো দূরের কথা, আরও কমতেও পারে', বলে মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'তারপরও বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করলে সেটা হবে ভোক্তার অধিকার খর্ব করা, ভোক্তা অধিকার বিরোধী এবং ভোক্তা অধিকার ও বিইআরসি আইনের পরিপন্থি।'
দামবৃদ্ধির জন্য ৭ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদা ধরে রাজস্ব চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, 'সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না, উল্টো আরও প্রায় ১৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। কাজেই রাজস্ব চাহিদাও কমে গেছে। বিইআরসি আইনের ৩৪ ধারা অনুযায়ী তাদেরকে ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সুতরাং, সার্বিকভাবে এখন বিইআরসির ৯০ দিনের যে বাধ্যবাধকতা আছে সেই অনুযায়ী, তাদেরকে ঘোষণা দিতে হবে যে বিদ্যুতের দাম অপরিবর্তিত থাকছে। এটা এখন আর তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না, এটা এখন বাধ্যতামূলক।'
হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে গত ৬ আগস্ট মধ্যরাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেয় সরকার। এরপর থেকে দেশের সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়লে তা দেশের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অধ্যাপক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, 'জ্বালানি খাতে নেতিবাচক কিছু হলে তার পরিণতি ভালো হয় না। এভাবেই যদি সরকার সবকিছুর দাম বাড়াতে থাকে, তাহলে মানুষ আরও দরিদ্র হতে থাকবে। তা হলে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বাড়বে। সে আলোচনা বাদ দিয়ে সরকারের হিসাবটাই করি। মানুষের ব্যবসা কমে যাচ্ছে। ব্যবসা কমে গেলে নানা খাত থেকে সরকার যে কর পাচ্ছে, সেটা কমবে। সরকারের আয় কমলে বাজেট অর্ধেক হয়ে যাবে। বাজেট অর্ধেক হয়ে গেলে প্রবৃদ্ধি শেষ হয়ে যাবে। প্রবৃদ্ধি শেষ হয়ে গেলে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে যে যাত্রা, তার তরী তীরে এসে ডুবে যাবে। সবকিছু হারিয়ে যাবে দিগন্ত রেখায়।'
এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছানোর আগেই সরকারকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে মনে করেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, 'সরকার সব জায়গা থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করে যাচ্ছে। এর জন্য যে পরিমাণ গ্যাস গ্রাহকদের দেবে বলে দাম বেশি নিয়েছে, সেটাও দেয়নি। সরকার গ্যাস না এনে রাজস্ব কমিয়ে ফেলেছে। যা দাম নিয়েছে, সেই পরিমাণ এলএনজি না আনায় রাজস্ব উদ্বৃত্ত ছিল। তারপরও আমরা দাম দিয়ে গেছি। তেলের দাম কমে যাওয়ায় সরকারের তেলেও অনেক লাভ হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় সরকার মুনাফা যৌক্তিক করেনি, অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। যেটাকে আমরা লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বলছি, সেগুলো সমন্বয় করেনি। এসব ব্যয় ও মুনাফা যদি যৌক্তিক করা হতো তাহলে তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসের সরবরাহ ব্যয় কমতো এবং সরকারের ভর্তুকি কমতো। এখন সরকার জোর করে ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা করছে। সেটা আর করতে হতো না, এমনিতেই ভর্তুকি কমে যেত। এতে করে মানুষ সহনীয় দামে তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ কিনতে পারতো।'
'কিন্তু এসব না করে সরকার এটাকে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে বিবেচনা করছে। এটাকে রাজস্ব আহরণের খাত হিসেবে বিবেচনা করছে। এই খাত থেকে সরকার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। এর জন্য যে প্রক্রিয়া, তাতে প্রাতিষ্ঠানিক লুণ্ঠনের একটি পদ্ধতি তৈরি হয়ে গেছে। এই পদ্ধতি থেকে বের হতে হলে সরকারের নীতিতে আমূল সংস্কার আনতে হবে। এই খাতকে বাণিজ্যিক নয়, জনমুখী করতে হবে। সেটা করতে চাইলে এই খাত চালাতে হবে পেশাদারদের দিয়ে, বোর্ড থেকে বা প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে আমলাদের সরাতে হবে। এমন আরও অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাব আমরা সরকারকে দিয়েছি।'
Comments