ইডেন কলেজ পরিস্থিতি এবং নারী নেত্রী-সংগঠনের নীরবতা

Eden college

ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে সিট-বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ছাত্রীদেরকে 'চাপ দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো'র। যদিও ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অতি ক্ষুদ্র সংখ্যক এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু, ইডেন কলেজে অধ্যয়নরত সব শিক্ষার্থীকেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্যে যা অত্যন্ত অসম্মানজনক। সুষ্ঠু তদন্তে দোষী চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে মনে হয় না।

ইডেন মহিলা কলেজ পরিস্থিতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেমের সঙ্গে।

ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এখন আলোচনায়, সেগুলো দীর্ঘদিনের বলে মন্তব্য করে সুলতানা কামাল বলেন, 'সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এখন অভিযোগের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে এবং সামগ্রিক রাজনীতিতে যে নৈরাজ্য, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বিষয়টি শুধু ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেতাদের বিষয় নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি চলছে।'

তিনি বলেন, 'নৈতিকতার বিষয়টি আমাদের কাছে এতই ঝাপসা হয়ে গেছে যে, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেটা আমাদের ছেলে-মেয়েদের এখন আর শেখানো হয় না। আগে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের একটা শক্তিশালী নৈতিক মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া। কিন্তু, এখন আর সেটা নেই। বিশেষ করে এখন এসব ছেলে-মেয়েদের যেভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয় ক্ষমতার ঘুঁটি হিসেবে। এমন একটা মানসিকতা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে, টাকা-ক্ষমতার ব্যবহারই সব, কোনো ধরনের জবাবদিহিতার কোনো বিষয় নেই।'

'আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিও কিন্তু কোনো দায়িত্ব নিচ্ছে না। কিন্তু, তাদের নামেই তো জায়গায় জায়গায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিকৃত একটা পথ তাদেরকে দেখানো হয়েছে যে, ক্ষমতা থাকলে এ ধরনের কাজ করা যায় এবং এর জন্য কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হবে না। এখন ছেলে-মেয়েরা এটাই বিশ্বাস করছে এবং ফলে এ ধরনের কাজ করছে। যে কারণে জাতি হিসেবে আমরা বিরাট ক্ষতির শিকার হচ্ছি', যোগ করেন তিনি।

অন্য অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ করলেও ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের এ বিষয়টিতে দেশের নারী নেত্রীদের তেমনভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এটা কেন? জানতে চাইলে সুলতানা কামাল বলেন, 'অন্যদের হয়ে আমি কথা বলতে পারব না। কিন্তু, আমার মনে হয়, এটা নিয়ে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। আমাদের নতুন প্রজন্ম, সন্তানদের স্বার্থেই আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। কারণ, এভাবে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ব্যবহার হতে দিতে পারি না। এখানে অভিভাবক হিসেবে, এ প্রজন্মের আগের প্রজন্ম হিসেবে আমাদের একটা শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যারাই ছেলে-মেয়েদের দিয়ে এ ধরনের কাজ করিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে, সেখানে অবশ্যই আমাদের শক্তভাবে প্রতিবাদ করা উচিত।'

খুশী কবির বলেন, 'আমাদের ইতিহাসে দেখে এসেছি যে, ছাত্ররাজনীতি নৈতিকতার রাজনীতি। আমাদের যত বড় বড় অর্জন, ইতিহাসের যে মাইলফলক, সবগুলো ছাত্ররাজনীতি থেকেই শুরু হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ছাত্রনেতারা বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভিন্ন ভিন্ন দল ছিল। কিন্তু, মূলত একটি আদর্শিক জায়গা থেকেই এই ছাত্ররাজনীতি করা হতো। কিন্তু, যখন শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতির মধ্যে ঢুকে গেল সুবিধার জন্য, তখনই নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা গেল। সেটার ছাপ সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ছে। আবার বড় বড় রাজনৈতিক দলও নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত করতে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে। তখন আদর্শ-নৈতিকতা ম্লান হয়ে যায়। এটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।'

ইডেনকে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ইডেন কলেজের মতো একটি প্রতিষ্ঠান, যেটা নারীদের কলেজ, সেখানে যারা একই দল করে, আমরা ধরতে পারি যে রাজনৈতিকভাবে তারা একই চেতনার। যদি তাদেরই নিজেদের মধ্যে এ ধরনের অবস্থা চলে আসে এবং কেউ যদি অনৈতিক কাজে ক্ষমতা ব্যবহার করে, সেটা তো গুরুত্ব অপরাধ। যারা ভুক্তভোগী, এসব কাজ তো তাদের জীবনকে প্রায় শেষ করে দেওয়ার মতো। ছাত্র নেতারা যদি এগুলো করে, তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। যেহেতু ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াতেই গড়ে উঠছে, যতই বলা হোক যে তারা স্বাধীন, দলের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই, কিন্তু, অবশ্যই দলের সঙ্গে তাদের সংযোগ আছে। ছাত্ররাজনীতি থেকে গিয়েই তো তারা দলে অবস্থান পায়। ছাত্র সংগঠনের এসব কাজের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের রাজনৈতিক দলের নৈতিকতার অবক্ষয় কতটুকু। আমাদের ছাত্র নেতারাই যদি এ পর্যায়ে থাকে, তারাই যদি ভবিষ্যতে দেশ চালায়, তাহলে দেশ কোথায় যাবে? বিষয়টি খুবই ভাবিয়ে তোলে। এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।'

নারী নেত্রীদের ভূমিকা বিষয়ে খুশী কবির বলেন, 'এ ঘটনায় নারী নেত্রীরা নীরব কি না, আমি জানি না। এ ঘটনা যখন ঘটেছে, আমি তখন দেশে ছিলাম না। মঙ্গলবার এসেছি। যেহেতু আমি দেশের বাইরে ছিলাম, তাই নারী সংগঠনগুলো এ ঘটনায় বক্তব্য দিচ্ছে কি না, সেটা বলতে পারছি না। কিন্তু, নারী সংগঠনগুলোও এ বিষয় নিয়ে চিন্তিত এবং আমি বিশ্বাস করি না যে সব নারী সংগঠন আপস করেছে। হয়তো মনে করা হচ্ছে অনেকে আপস করে চলছেন। কিন্তু, এটা আপস করার বিষয় না। এ ঘটনার বিরুদ্ধে অবশ্যই আমাদের বক্তব্য রাখতে হবে।'

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'যে অভিযোগগুলো উঠেছে, বিশেষ করে ছাত্রীদেরকে "চাপ দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো"র অভিযোগ, এগুলো বানিয়ে বলার বিষয় না। এ অভিযোগ তুলতে যথেষ্ট পরিমাণ সাহস সঞ্চার করতে হয়েছে। এখন আমাদের চর্চা হলো যে সত্য বললে, তাকে মেরে দাও। কিন্তু, সেই চর্চাটা না করে এই অসম্ভব গুরুতর অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে, প্রয়োজনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত করা উচিত। ছাত্রীদেরকে "চাপ দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো"র অভিযোগটা আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়েছে। যে সত্যটা অত্যন্ত ভয়ংকর।'

নারী নেত্রীদের ভূমিকা বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের নারী নেত্রীদের মধ্যেই তো দলীয় রাজনীতি ঢুকেছে। সেটার কারণেই এটা হচ্ছে। এখন সেই দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্যের কারণেই এমনটা হচ্ছে কি না, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়।'

ইডেন কলেজ ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ জনসম্মুখে এসেছে, সেগুলো পরিষ্কার হওয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, 'এগুলোর জন্য তদন্ত কমিটি করা উচিত। পত্রিকায় দেখলাম যে কলেজ কর্তৃপক্ষ একটা তদন্ত কমিটি করেছে। কিন্তু, আমার মনে হয় শুধু এটা না, কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের চেয়ে উচ্চতর যারা আছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকা উচিত, প্রয়োজনে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয় থেকে কারো থাকা উচিত। এ অভিযোগটা তো নারী সমাজের জন্য অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সেই অভিযোগটা তলিয়ে দেখা উচিত।'

ইডেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ নিয়ে দেশের নারী নেত্রীদের তেমনভাবে কথা বলতে দেখা না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, 'আমরা আসলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতে চাই না। সংগঠনের মধ্যে কী হচ্ছে, সেটা নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। কিন্তু, যে বিষয়টি এখন সামনে এসেছে, সেটা নিয়ে আমরা কনসার্ন। আমি অন্য এক পত্রিকাকে বলেছি, আপনাদেরও বলছি। কিন্তু, সব সময়ই এরকম বলে ফেলাটা একটু কঠিন হয়ে যায়। প্রশাসনিক বিষয় বলছি না। অনৈতিক কথাটা যে আসলো, সেটা তো নারীর জন্য যথেষ্ট অপমানজনক। সে জিনিসটাকে যদি কর্তৃপক্ষ নিজেরা তদন্ত করে পরিচ্ছন্ন অবস্থানে যেতে পারে, সেটাই ভালো। এটাও একটা বিষয় যে এরকম একটা বিষয়কে নিয়ে নাড়াচাড়া করে নারী সমাজকে আরও অসম্মানের মধ্যে ফেলে দেওয়াটা ঠিক মনে করি না।'

'আরেকটা বিষয় খুবই প্রকাশ্য যে, নারীর প্রতি আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, ইডেনের ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে আসলো। প্রত্যেকটা জায়গায় ছাত্রলীগ এ ধরনের দুষ্কৃতি করছে, নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করছে। সেগুলো কিন্তু পত্রিকায় আসে না। এটা যেহেতু নারীদের একটা জায়গা, এটা নিয়ে শুধু পত্রিকা না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবাই খুবই তৎপর হয়ে গেছে। এখানেও কিন্তু পুরো ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচ্ছন্ন প্রকাশ হচ্ছে', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

1h ago