১১৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে পদ্মা অয়েলের ট্যাঙ্ক সিলগালা
১১৭ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে পদ্মা অয়েল কোম্পানির ৬১ লাখ লিটারের একটি ফার্নেস অয়েলের ট্যাঙ্ক ২ মাস ধরে সিলগালা করে রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ।
অন্তত ছয় দফায় ফাঁকি দেওয়া এই রাজস্ব পরিশোধে তাগাদাপত্র দেওয়ার পরও অর্থ পরিশোধ না করায় গত ২৮ জুন চট্টগ্রাম গুপ্তখালে সংস্থাটির প্রধান স্থাপনার ৭৯ নম্বর ট্যাঙ্কটি সিলগালা করে কাস্টম।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ৩টি জাহাজে করে আমদানি করা ১৯টি চালানে মেয়াদোত্তীর্ণ এসআরও সুবিধা নিয়ে ১০১.৮৩ কোটি এবং নথি জালিয়াতি করে আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে ১৪.৯১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। এসব অনিয়ম ২০২১ সালের জুনে ধরা পড়লেও অর্থ পরিশোধে অনীহা দেখায় পদ্মা অয়েল কোম্পানি। পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মধ্যে একাধিক বৈঠকে এসব অর্থ পরিশোধে সম্মত হয় পদ্ম অয়েল। কিন্তু, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত অর্থ পরিশোধে চট্টগ্রাম কাস্টমস ৬ দফা চিঠি দিলেও তা পরিশোধ করেনি সংস্থাটি।
সর্বশেষ গত ২৬ জুন পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের এডিশনাল কমিশনার আবু নুর রাশেদ আহম্মেদ বলেন, 'ফাঁকি দেওয়া অর্থ পরিশোধ না করা হলে কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯ এর ২০২ ধারা ও মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২ এর ৯৫ ধারা অনুযায়ী পদ্মা অয়েলের নামে খোলা সকল ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করা হবে।'
তবে দেশে চলমান জ্বালানি তেল সংকট ও বিশ্ব বাজারে তেল আমদানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ না করে ফার্নেস অয়েলের একটি ট্যাঙ্ক সিলগালা করা হয় বলে জানান এই কাস্টমস কর্মকর্তারা।
পদ্মা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবু সালেহ ইকবাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কাস্টমসের দাবি করা অর্থ পরিশোধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে, তার আগেই যাতে ট্যাঙ্কে থাকা তেল আমরা ব্যবহার করতে পারি সে বিষয়ে বিপিসির মাধ্যমে চেষ্টা চালাচ্ছি। আশা করছি খুব শিগগির বিষয়টির সমাধান হবে।'
তবে, সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও কেন রাজস্ব ফাঁকি দিতে হলো জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গত ৫ জুলাই কাস্টমস কমিশনার বরাবর এক চিঠিতে সংস্থাটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ৩টি জাহাজে করে আমদানি করা এসব ফার্নেস অয়েল খালাস করতে গিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি ঘাটতি থাকায় এ ধরণের সমস্যা তৈরি হয়েছে। কাস্টমসের দাবি করা অর্থ পরিশোধে বিপিসি ও পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আন্তরিক আছে। খুব শিগগির এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, 'পদ্মা অয়েলের ৭৯ নম্বর ট্যাঙ্কারটি সিল করার কারণে সেখান থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ ও সরবরাহ বন্ধ আছে। ফলে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও দেশি-বিদেশি জাহাজে অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে এবং দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দিতে পারে।'
চট্টগ্রাম কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার রোকসানা খাতুন বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে সংস্থাটির ট্যাঙ্কটি সিল করা হয়েছে। ফাঁকি দেওয়া অর্থ পরিশোধ করার সাপেক্ষে সিল মুক্ত করা হবে।'
কাস্টমসের মামলার নথি বিশ্লেষণ করে দেখা দেছে, এমটি লাকাটামিয়া, এমটি কিংফিশার এবং এমটি এলাইচ-১ জাহাজে কর প্রায় ৪৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। এসব চালান মেয়াদোত্তীর্ণ ২০১১ সালের একটি এসআরও (এসআরও নং-২০-আইন/২০১১/২৩২৭/শুল্ক) সুবিধায় এসব পণ্য খালাস করা হয় ২০২১ সালের শুরুতে। যদিও এই এসআরও ২০২০ সালের জুনে বাতিল করা হয়। এসআরও সুবিধা বাতিল করার পর আমদানি করা পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ না থাকায় ফাঁকি দেওয়া ১০১.৮৩ কোটি টাকা দাবি করে কাস্টমস।
তাছাড়া, এ ৩টি জাহাজে আসা ১৯টি চালানের প্রকৃত মূল্য কম দেখিয়ে ১৪.৯১ কোটি টাকা কম শুল্ক পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানটি।
কাস্টমসের আমদানি নথির তথ্য মতে, ২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়ার পিটি বুমি সিয়াক পুসাকো কোম্পানি থেকে ৩ হাজার ৫০৪ টনের একটি ফার্নেস অয়েলের চালান আমদানি করে পদ্মা অয়েল কোম্পানি। এলসি (জনতা ব্যাংক- ৯৩২১০১১৩৭২) মূল্য অনুযায়ী, প্রতি টন ফার্নেস অয়েল ৫৫৪ ডলার হলেও কাস্টমসে শুল্কায়ন কর হয় ৪১৯.৪৮ ডলার করে। এতে কাস্টমস শুধু এ চালানেই রাজস্ব কম পেয়েছে ১.৩৭ কোটি টাকা।
একইভাবে অপর ১৮টি চালানেও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে শুল্কায়ন করায় আরও ১৩.৫৪ কোটি টাকার কম রাজস্ব পায় কাস্টমস। এসব চালানে গড়ে প্রতি টন ৪৮৮ ডলার থেকে ৫৫৬ ডলারে আমদানি করলেও কাস্টম নথিতে দেখানো হয় গড়ে প্রতি টন ২৬৫ ডলার থেকে ৪২৩ ডলার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'দেশে জ্বালানি তেলের সংকট হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কাস্টমস। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সব ধরণের আমদানি ও ব্যাংক লেনদেন বন্ধ কথা থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় তা না করে শুধু একটি ট্যাঙ্কটি সিল রাখা হয়।'
তিনি বলেন, 'প্রতিষ্ঠানটি মেয়াদোত্তীর্ণ এসআরও সুবিধা নিতে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। যা পরবর্তীতে পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিটে ধরা পরে। এ ধরণের অপরাধ বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান করলে ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব ছাড়াও অন্তত ২৩৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হতো। এতো বড় অপরাধের পরও তারা শুধু ফাঁকি দেওয়া অর্থ পরিশোধ করা নিয়েই গড়িমসি করছে।'
Comments