যে কারণে ছেলেকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন মা

নিজ বাড়িতে সোনালী চাকমা। ছবি: স্টার

ছেলে বড় হচ্ছে। স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে। তবুও পাঠাতে পারছিনা। কোনো মা চাইবে না তার ছেলেকে অন্য কারো কাছে দিতে। আমি প্রায় সময় অসুস্থ আর অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ছেলেকে দেখার কেউ নেই। ইদানীং ওষুধ কিনতে পারছি না। অসুস্থতাও বাড়ছে।

কথাগুলো বলছিলেন খাগড়াছড়ির সোনালী চাকমা। সম্প্রতি তিনি তার ছেলেকে বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান।

সোনালী চাকমা বলেন, 'গ্রামবাসীরা কয়বার ধার দিবে আমাকে? জিনিসপত্রের দাম বেশি। আধা কেজি চাল ধার পাওয়াও অনেক কষ্ট। আমি নাহয় দু-এক দিন না খেয়ে থাকলাম, কিন্তু ছেলে তো পারবে না। সে যখন ও মা, ও মা, ডেকে ওটা দাও, এটা দাও বলে তখন একজন অভাবী মায়ের কাছে কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা বুঝানো যাবে না।'

'আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে কারো ঘরে দত্তক থাকুক। আর তারা যদি খুশি হয়ে আমার ওষুধপত্র কিনে দেয়। তাই ছেলেকে বাজারে তুলেছিলাম। স্থানীয় বাঙালিরা পরে আমাকে ইউপি চেয়ারম্যান বাসায় নিয়ে যায়,' ভাঙা ভাঙা বাংলা আর চাকমা ভাষায় কথাগুলো বলেছিলেন এই মা।

সোনালী চাকমা ও তার ছেলে। ছবি: স্টার

সরেজমিনে দেখা যায়, খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে প্রধান রাস্তা থেকে ২০ মিনিট হাঁটলেই পাকুজ্জ্যছড়ি গ্রাম। সেখানেই থাকেন সোনালী চাকমা। বাঁশের বেড়া আর টিনে সেড দিয়ে বানানো একটি একটি ঘর। হতাশায় দাবা মুখে দিয়ে বসে আছেন সোনালী। ছেলে রামকৃষ্ণ চাকমা গাড়ি দিয়ে খেলা করছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের জন্য হয়তো তার অসুস্থতা আরও বেড়েছে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।

গত ১১ তারিখে স্থানীয় ভাইবোনছড়া বাজারে তার ৬ বছরের ছেলে রামকৃষ্ণ চাকমাকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতে চান সোনালী।

খবর পেয়ে কমলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুনীল চাকমা সোনালী ও তার ছেলেকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। পরেরদিন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা এবং ৫ নম্বর ভাইবোনছড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান সুজন চাকমা সেখানে যান। ৬ মাসের জন্য তাদের খোরাকির ব্যবস্থা করে দেন। গতকাল বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক তাদেরকে নিজ কার্যালয়ে নিয়ে যান।

স্থানীয় যুবক কল্যাণময় চাকমা বলেন, 'অভাব কোন পর্যায়ে গেলে একজন মা ছেলেকে বিক্রি করতে চান তারই উদাহরণ সোনালী চাকমা। অভাবের কারণে তিনি ছেলেকে ভরণপোষণ দিতে আর স্কুলে পাঠাতে পারছেন না। এতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

স্থানীয় সমিরণ চাকমা (৪৫) বলেন, সোনালী চাকমা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং ছেলেকে নিয়ে একাই থাকেন। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই সোনালীর। অভাব থেকে মূলত তার মানসিক যন্ত্রণা বাড়ে। সে কারণে ছেলেকে বিক্রি করতে বা দত্তক খোঁজতে বাজারে নিয়ে যান।'

'পার্বত্য অঞ্চলে অনেক সোনালী আছে। আমরা উন্নয়ন কথা শুনি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজ এখনো অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। এখানে তেমন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেইনি', তিনি যোগ করেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, সোনালী চাকমার ছেলে সরকারি শিশু সদনে সরকারি পরিবেশে বেড়ে উঠবে। সোনালীকে প্রধানমন্ত্রী গৃহহীনদেরকে যে ঘর দিচ্ছেন সেখান থেকে ২ কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর তুলে দেওয়া হবে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।

জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তার নামে এক লাখ টাকার সঞ্চয় পত্র দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে তার স্থায়ী আর্থিক সমস্যা সমাধান চেষ্টা করছি। চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসন তার পাশে থাকবে এবং ছেলে রামকৃষ্ণকে নিরাপদ জীবন দেওয়ার চেষ্টা করা হবে, যোগ করেন জেলা প্রশাসক।

Comments

The Daily Star  | English

Trump, Musk feud explodes with threats of cutting contracts, backing impeachment

The hostilities began when Trump criticized Tesla CEO Musk in the Oval Office.

2h ago