নেপালে যত উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা

আজ রোববার ৭২ আরোহী নিয়ে নেপালে একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ছবি: কাঠমান্ডু পোস্ট, অরুণ তামু

নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭২ আরোহী নিয়ে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় আজ রোববার পর্যন্ত ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ আছেন ৪ জন। বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ১৯৯২ সালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৬৭ জন নিহত হওয়ার পর গত ৩০ বছরে এটিই নেপালের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা। 

দুর্গম পর্বত, বৈরি আবহাওয়া, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে নেপালে প্রায়শই দুর্ঘটনার শিকার হয় উড়োজাহাজ।

নেপালের উড়োজাহাজ খাতের বর্তমান পরিস্থিতি

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪৯ সালে নেপালের মাটিতে প্রথম উড়োজাহাজ অবতরণ করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপালের উড়োজাহাজ শিল্প অনেক এগিয়েছে, বিশেষত দেশটির বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় মানুষ ও পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে এবং একইসঙ্গে, বিদেশি পর্বতারোহী ও ট্রেকারদের আনা-নেওয়ার দিক দিয়ে। তবে সার্বিকভাবে, এই শিল্পের নিরাপত্তা রেকর্ড ভালো নয়।

পর্বতের মাঝে নেপালের বিমানবন্দর ছাড়ছে একটি উড়োজাহাজ। ছবি: সংগৃহীত

এর পেছনে কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণকে দায়ী করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিরাপত্তা ঘাটতির কারণে নেপালি উড়োজাহাজের ইউরোপে ফ্লাইট পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এভারেস্টসহ পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ১৪ পর্বতের ৮টি নেপালে। দেশটির আবহাওয়া হটাৎ করেই বদলে যায় এবং বেশিরভাগ এয়ারস্ট্রিপ দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরগুলোতে অবতরণ করতে অত্যন্ত চৌকস ও অভিজ্ঞ বৈমানিকদেরও বেগ পেতে হয়।

১৯৪৯ সাল থেকে শুরু করে অসংখ্য দুর্ঘটনায় শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈমানিকের দোষেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছিল বলে তদন্তে জানা গেছে।

নেপালের যত উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা

নেপালের উড়োজাহাজ খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ১৯৯২ সালে পিআইএর ফ্লাইটে ১৬৭ জন নিহত হন। এরপর আরও বেশ কিছু ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে নেপালে।

২০২২ সালে তারা এয়ারের ফ্লাইট ১৯৭

গত বছরের মে মাসে নেপালে তারা এয়ারের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ২২ আরোহীর সবাই নিহত হন। উড়োজাহাজটিতে ১৩ জন নেপালি, ৪ জন ভারতীয়, ২ জন জার্মান এবং ৩ জন ক্রু ছিলেন। পোখারা থেকে পার্বত্য শহর জমসমে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় উড়োজাহাজটি।

২০১৮ সালে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট ২১১

ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ৭৬ আসন বিশিষ্ট বোম্বার্ডিয়ার কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি ২০১৮ সালের ১২ মার্চ ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু যাওয়ার পথে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। ফলে উড়োজাহাজের ৭১ যাত্রীর ৫১ জনই প্রাণ হারান। পরবর্তীতে কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে 'বৈমানিকের ভুল এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে বোধের অভাবকে' দায়ী করেন।

২০১৬ সালে তারা এয়ারের ফ্লাইট ১৯৩

২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোখারা থেকে জমসম যাওয়ার পথে তারা এয়ারের ফ্লাইট ১৯৩ নিখোঁজ হয়। উড্ডয়নের ৮ মিনিটের মাথায় উড়োজাহাজটির সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। পরবর্তীতে ডানা গ্রামের কাছাকাছি জায়গায় এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ফ্লাইটে থাকা ২৩ যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

২০১২ সালে সিতা এয়ারের ফ্লাইট ৬০১

সিতা এয়ারের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট কাঠমান্ডুতে জরুরি অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হলে ১৯ যাত্রী প্রাণ হারান। উড়োজাহাজটি কাঠমান্ডু থেকে তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে, উড্ডয়নের অল্প কিছুক্ষণ পরেই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয় এবং উড়োজাহাজটি জরুরি অবতরণের চেষ্টার সময় বিধ্বস্ত হয়।

২০১২ সালে বিদ্ধস্ত অগ্নি এয়ারের উড়োজাহাজটি। ছবি: সংগৃহীত

২০১২ সালে অগ্নি এয়ারের ফ্লাইট

অগ্নি এয়ারের জার্মানিতে নির্মিত দর্নিয়ার ২২৮ উড়োজাহাজটি ২১ জন যাত্রী নিয়ে পোখারা থেকে জমসমের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি জমসম বিমানবন্দরের কাছে বিধ্বস্ত হয় এবং ২ জন বৈমানিকসহ ১৫ জন প্রাণ হারান।

২০১১ সালে বুদ্ধা এয়ারের ফ্লাইট ১০৩

২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বুদ্ধা এয়ারের মার্কিন বিচক্রাফট ১৯০০ডি উড়োজাহাজটি ললিতপুরের কাছে বিধ্বস্ত হয়। ১০ জন ভারতীয় নাগরিকসহ ২২ জন যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যাচ্ছে তারা এয়ারের একটি উড়োজাহাজ। ছবি: সংগৃহীত

২০১০ সালে তারা এয়ারের ফ্লাইট

২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারা এয়ারের ডিএইচসি-৬ টুইন অটার উড়োজাহাজ লামিডান্ডা থেকে কাঠমান্ডু যাত্রা শুরুর অল্প কিছুক্ষণ পরেই বিধ্বস্ত হয়। ৩ ক্রুসহ ২২ আরোহীর সবাই প্রাণ হারান।

২০১০ সালের অগ্নি এয়ারের ফ্লাইট ১০১

২০২১ সালেই আরও একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনায় কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাওয়ার পথে ২২ মিনিট ওড়ার পর অগ্নি এয়ারের ফ্লাইট ১০১ বিধ্বস্ত হয়। এতে ফ্লাইটে থাকা ১৪ জনই নিহত হন।

২০০৮ সালে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের বহনকারী হেলিকপ্টার

মাওবাদী সামরিক শিবিরে অভিযান শেষে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি পূর্ব নেপালের রামচ্ছাপ অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। এতে ১০ যাত্রীর সবাই নিহত হন।

২০০৬ সালে শ্রী এয়ারের ফ্লাইট

পূর্ব নেপালের তাপলেইউং অঞ্চলে শ্রী এয়ারের একটি ফ্লাইট বিধ্বস্ত হয়। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংক্রান্ত অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়া ২৪ যাত্রীর সবাই এ দুর্ঘটনায় মারা যান।

২০০৬ সালে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট

জুমলা বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়ে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের ৯ যাত্রী নিহত হন।

২০০০ সালে নেপালের রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট

২০০০ সালে দাদেলধুরা এলাকায় একটি টুইন ওটার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ২৫ জন যাত্রী নিহত হন। উড়োজাহাজটি নেপালের রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ সংস্থা রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের বহরের অংশ ছিল।

১৯৯২ সালে নেপালে বিদ্ধস্ত পিআইএ’র এয়ারবাস এ৩০০। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯২ সালে পিআইএর এয়ারবাস এ৩০০

১৯৯২ সালে নেপালের এ যাবৎ সবচেয়ে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের জাতীয় সংস্থা পিআইএ'র এয়ারবাস এ৩০০ উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৬৭ জন নিহত হন। উড়োজাহাজটি ললিতপুরের ভাট্টেডান্ডায় বিধ্বস্ত হয়।

১৯৯২ সালে থাই এয়ারওয়েজের এয়ারবাস এ৩১০

একই বছর থাই এয়ারওয়েজের এয়ারবাস এ৩১০ ঘিয়াংফেদিতে বিধ্বস্ত হয়ে কমপক্ষে ১১৩ জন আরোহী নিহত হন।

পোখরা-জমসম রুটটি খুবই বিপদসংকুল, কারণ এই রুটে অন্নপূর্ণা ও ধাউলাগিরি পর্বতের মাঝে পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাতটি অবস্থিত এবং এই পথে মেঘ ও প্রবল বাতাসের উৎপাতও মোকাবিলা করতে হয় বৈমানিকদের।

নেপালের বেশিরভাগ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে বর্ষা মৌসুমে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈমানিকরা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাহাড় দেখতে না পাওয়ার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে। বৈরি আবহাওয়ার ও ভূ-বৈচিত্র্যের কারণে উদ্ধার কার্যক্রমও বিঘ্নিত হয়।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

6h ago