ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলা: যেভাবে দেখছেন শিক্ষক ও সাবেক ছাত্রনেতারা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্ত্বর এলাকায় গত বৃহস্পতিবার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। ছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস উত্তপ্ত। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট চত্বরের ভেতরে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এতে ছাত্রদলের অন্তত ৪৭ নেতা-কর্মী আহত হন।

এর আগে গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের মিছিলে বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। সবমিলিয়ে ৩ দিনের সংঘাতে ২ সংগঠনের অন্তত ১৩০ জন নেতা-কর্মী আহত হন।

এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক চর্চা ও সুষ্ঠু ধারার রাজনীতির পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) প্রথম সহ-সভাপতি (ভিপি) মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সাবেক ভিপি ও বর্তমান সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের সঙ্গে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, এ কে এম এনামুল হক শামীম ও খায়রুল কবির খোকন (বাম থেকে)

এদের মধ্যে এনামুল হক শামীম বাদে বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়টিকে দেশে 'গণতন্ত্রহীনতা', 'মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ' ও ক্ষমতাসীন দলের 'দখলদারিত্বের' রাজনীতির ফলাফল হিসেবেই দেখেছেন। তাদের ভাষ্য, দেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার যে অভাব রয়েছে, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছে। এ ছাড়া এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ও দেখছেন তারা। প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়েও।

এ ব্যাপারে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের পর্যবেক্ষণ হলো, 'গোটা দেশে যে নৈরাজ্য, গণতন্ত্রহীনতা ও দখলদারিত্ব চলছে তারই প্রতিফলন এই ঘটনা। লুটপাট, দখলদারিত্বের কমপিটিশনের পরিণতিই হচ্ছে এই হানাহানি।'

সেলিম বলেন, 'এর সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা হলো কিছু ছাত্র নামধারী মাস্তান ও তাদের দ্বারা বাধ্য হয়ে ক্যাডারভুক্ত হওয়া মুষ্টিমেয় ছাত্রদের একটা বিপজ্জনক অংশ।'

সাবেক এই ছাত্রনেতার মতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও সরকার 'নাক গলানো' বন্ধ করলে এর একটি সমাধান সম্ভব। তিনি বলেন, 'তখন সাধারণ শিক্ষার্থীরাই এর সমাধান করে ফেলবে, ময়লা-আবর্জনা দূর করে ফেলবে।'

এ বিষয়ে অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানের ভাষ্য, 'আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চা- তার মধ্যে রাজনীতিটাই পুরোমাত্রায় অনুপস্থিত। এখানে পেশীশক্তি ও দুর্বৃত্তায়ন গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন কিংবা যারা ক্ষমতায় আসতে চায় এই দুয়ের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। যার ফলে এ ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মীদের আমরা সশস্ত্র অবস্থায় দেখতে পাই।

'আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও পেশীশক্তি নির্ভরতা এবং স্বাভাবিক রাজনীতির যে অনুপস্থিতি, সেটারই একটা প্রকাশ আমরা এর (ছাত্রদলের ওপর হামলা, সংঘর্ষ) ভেতর দিয়ে দেখছি।'

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই শিক্ষক। বলেন, 'পেশীশক্তি ও দুর্বৃত্তায়ন আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এর বাইরে না। যেখানে শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা উচিত বই-কলম, সেখানে আমরা দেখছি হকিস্টিক, স্ট্যাম্প, লোহার রডসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। উন্মুক্তভাবেই এগুলোর প্রদর্শন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, আমাদের যে প্রক্টরিয়াল টিম, যারা প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন, তারা উটপাখির মতো মুখ গুঁজে আছেন।'

তানজীমউদ্দিন খান আরও বলেন, 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা পার্টি অফিসে পরিণত করেছি। যে কারণে শিক্ষকরা আর শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। এই যে পেশীশক্তি নির্ভর রাজনীতি, যে কর্মতৎপরতা, শিক্ষকরাও সেটার অংশ হয়ে গেছেন। এটা আরও বড় একটা বিপদ। জাতীয় রাজনীতির দলগুলো, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সংগঠন যেভাবে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে, সেটাকে আমরা শিক্ষকরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি। এটা খুবই দুঃখজনক।'

এতে করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি তৈরি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  

অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, 'এখানে যে ছেলে-মেয়েগুলো আসে, তারা অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসে। ওদের হাতে লাঠিসোটা, আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাদের মাস্তান বানানো, দুর্বৃত্ত বানানোর যে প্রক্রিয়ায় কেবল রাজনৈতিক দলগুলোই না, আমরা শিক্ষরাও উৎসাহিত করছি।'

তার ভাষ্য, 'আমাদের ছেলে-মেয়েকে আমরা কিন্তু এখন আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি না। মধ্যবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা আসছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। তাদের মূলত পদাতিক বাহিনীর সৈন্যে পরিণত করেছি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয় যাদের জন্য একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।'

এদিকে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহাবস্থানের প্রশ্নে বর্তমান সরকারের উপমন্ত্রী ও জাকসুর সাবেক ভিপি এনামুল হক শামীম বলেন, 'আমি যখন ৮৯ সালে ডাকসুর ভিপি হলাম, তখনো আমাদের হলে থাকা দুষ্কর ছিল। যেদিন নির্বাচন হয়, তার আগের রাতেও আমি হল প্রভোস্টের রুমে ঘুমিয়েছি।

'গত ১৩ বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটনা (হামলা-সংঘর্ষ) যে ঘটে নাই, তা বলব না, কিন্তু আমাদের সময়ে এরশাদ ভ্যাকেশন, খালেদা জিয়া ভ্যাকেশন টার্মগুলো চালু ছিল। হল বন্ধ হয়ে যেত মারামারি, গোলাগুলি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে। সে তুলনায় কিন্তু এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্মুথলি চলছে।'

ছাত্রদলের ওপর হামলার প্রসঙ্গে শামীমের বক্তব্য হলো, 'আমি যেটা দেখলাম—বাহির থেকে গিয়ে, অছাত্রদের নিয়ে একটা কিছু করার প্ল্যান। সহাবস্থানের ক্ষেত্রে তো কোনো প্রশ্ন নেই। ডাকসু ইলেকশন হয়েছে তো। সহাবস্থান না থাকলে আমাদের সরকারের আমলেই নুরু কীভাবে ভিপি হলো?

'আমার মনে হয় ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের মধ্যেই রাখা ভালো। যারা ভার্সিটিতে থাকবে তারাই ছাত্র রাজনীতি করবে। এখন মহল্লার, পাড়ার মাস্তানদের দিয়ে কমিটি করে তাদের যদি ইউনিভার্সিটির মধ্যে ঢোকাতে যায়, তাহলে তো একটা ঝামেলা হতেই পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছেলেরা ছাত্রদলের নেতা হবে, ক্যাম্পাসে থাকবে তাতে কোনো সমস্যা নাই। ছাত্র রাজনীতির গুণগত মান ঠিক রেখে নিয়মিত ছাত্রদের কাছে নেতৃত্ব দিলে এই ঝামেলাগুলো হয় না। গত ১৩ বছরে তা হয় নাই।'

তার মতে, 'যেহেতু সামনে নির্বাচন, সেহেতু এটা (ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের উপস্থিতি) দেশকে অস্থিতিশীল করার একটি ষড়যন্ত্র।'

একই প্রসঙ্গে ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনের ভাষ্য হলো, 'তারা (আওয়ামী লীগ) এখন রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে যদি কেউ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখবে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে। সেখানে ছাত্রলীগ যেভাবে সশস্ত্র অবস্থায় দুই দুইবার ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছে, তাতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সহাবস্থানের জায়গাটি আর থাকেনি।'

বিএনপির সাবেক এই ছাত্রনেতা বলেন, 'আমরা এটাকে গণতান্ত্রিক দেশ বলি। সংবিধান আমাকে মিছিল, মিটিং সমাবেশ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে। আমি আমার কথা বলতে পারব না, ক্যাম্পাসে যেতে পারব না, মত প্রকাশ করতে পারব না—এটা তো ফ্যাসিজম।

'তার মানে তারা (আওয়ামী লীগ) জনবিচ্ছিন্ন। বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে তারা এখন সশস্ত্র পথ বেছে নিয়েছে।'

এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ওপর হামলার বিষয়টিকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখেন না খোকন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, 'কেন্দ্রীয় পলিসির অংশ হিসেবেই এটা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।'  

Comments

The Daily Star  | English

Cyber protection ordinance: Draft fails to shake off ghosts of the past

The newly approved draft Cyber Protection Ordinance retains many of the clauses of its predecessors that drew flak from across the world for stifling freedom of expression.

11h ago