শিক্ষকেরা কেন অবহেলিত, দায় কার
৫ আগস্টের পর ফেইসবুকে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে বিস্তর লেখালেখি চোখে পড়েছে। যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা এখন কীভাবে শ্রেণিকক্ষে পড়াবেন-শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে সততার গল্প বলবেন, কিংবা একজন কর্মে নিষ্ঠাবান শিক্ষকে যখন জনগণের কথিত ন্যায়ের মাধ্যমে অপসারণ কিংবা হেনস্তা করা হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার নৈতিক অবস্থান কতটা সুদৃঢ় থাকে-তার সদুত্তরও সুদুরপরাহত। 'নুন আনতে পান্তা ফুরানো'র-বাস্তবতার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক। তাহলে দেশ-পুনর্গঠনে শিক্ষকরা এ জাতিকে কতটা আলোর পথ দেখাবেন-এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে পুরোবিশ্বের ন্যায় বাংলাাদেশেও শিক্ষকদের সম্মানে পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব শিক্ষক দিবস'।
অকাতরে জ্ঞান বিতরণ করা শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। তাদেরকে বলা হয়ে থাকে মানুষ গড়ার কারিগর। বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করেন তারা। শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। ইউনেস্কোর উদ্যোগে ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১৪৫টি সুপারিশ গৃহীত হয়। এসব সুপারিশের মধ্যে শিক্ষকদের মৌলিক ও অব্যাহত প্রশিক্ষণ, নিয়োগ ও পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, দায়িত্ব ও অধিকার, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা অন্যতম।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় শিক্ষক দিবস। বিশ্বের ১০০টি দেশে এই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে আলোচনা সভা ও এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীদের ইএফটিতে বেতন দেয়া কার্যক্রমের উদ্বোধনের মাধ্যমে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য 'শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার'।
সংস্কারের কাজ চলছে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বদৌলতে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ প্রয়াস লক্ষণীয়। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে-নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন।
বাংলাদেশে শিক্ষার মান, শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনও অগোচরে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ সুবিধা খুবই কম। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা ও সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল এক ধাপ উন্নীত করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা ও সহকারি শিক্ষকদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীতকরণের যৌক্তিক দাবির কোনো উদ্যোগ সরকারের নিকট থেকে নেয়া হয়নি। একজন শিক্ষক বর্তমান স্কেলে যে বেতন পান তা দিয়ে তাঁর সরকারের ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব। তারা অসহায় থাকেন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে রয়েছে নানা অসন্তষ্টি, এখানে সরকারি ও বেসরকারী শিক্ষকদের সম্মানীতে বড় বৈষম্য আছে। তাই এ পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি সুদৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরি। দেশের বেসরকারী শিক্ষকসমাজ আর্থিক পরাধীনতার মধ্যে আবদ্ধ।
প্রাথমিক স্কুলের অনেক শিক্ষককে তাই নিরূপায় হয়ে অন্যকাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। অনেকের সদিচ্ছা থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে তাঁরা শিক্ষকতায় পূর্ণাঙ্গ মনোনিবেশ করতে পারেন না। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিশুদের মনোবিকাশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালয়। এসময় যদি তারা শিক্ষার সঠিক নির্দেশনা না পায় তাহলে সারাজীবন তার ঘাটতি অনিবার্য। তিলে তিলে কোমলমতি শিশুদের গড়ে তুলতে যে শিক্ষকরা ব্যাপৃত থাকেন থাকেন তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা অত্যন্ত কম। বিশে^র অন্যান্য দেশে এমন করুণ অবস্থা দৃশ্যমান নয়। শিক্ষকদের নীরব কান্না শিক্ষাবিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে দিনের পর দিন। দ্রব্যমূলের উর্ধ্বগতিতে তাঁদের দীর্ঘশ্বাসের আর্তি কেউ যেন শুনেন না।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে রয়েছে নানা অসন্তষ্টি, এখানে সরকারি ও বেসরকারী শিক্ষকদের সম্মানীতে বড় বৈষম্য আছে। তাই এ পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি সুদৃষ্টি দেয়া অতীব জরুরি। দেশের বেসরকারী শিক্ষকসমাজ আর্থিক পরাধীনতার মধ্যে আবদ্ধ। শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক, এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে ২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায়।
এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেরও সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরো করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ চাকরির শুরু থেকেও এমপিওভুক্ত হননি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির অভিজ্ঞতা হিসাব করা হয়। বছরের পর বছর বেতন না পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাই মেধাবী শিক্ষিত সমাজ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে খুব আগ্রহী হলেও শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেন।
উচ্চ মাধ্যমিকের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টা অত্যন্ত জটিল ও অমানবিক। পূর্বে সৌভাগ্যবান কলেজ শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতেন। বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। পদোন্নতির জটিল নিয়মে অনেক শিক্ষককেই প্রভাষক পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আরো সহজ করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা দরকার।
প্রতিষ্ঠানের প্রধান (অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার) থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি সবার বাড়িভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা, যা দুর্ভাগ্যজনক। সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরজীবনেও উৎসব বোনাস পান। অন্যদিকে চাকরিতে থাকাকালীনই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ বোনাস পান, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা থেকেও বঞ্চিত, যা মাত্র ৫০০ টাকা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যুগে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ( বিটিএ) নেতৃত্বে গত বছর টানা ২২ দিনের আন্দোলন উত্তাল আন্দোলন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার জাতীয়করণ সংক্রান্ত বিষয়ে দুটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাতে শিক্ষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে আশ্বাস দেয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি চোখে পড়েনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও রাষ্ট্রীয় সম্মানের মধ্যে বৈষম্য বিস্তর। উচ্চবিদ্যাতায়নের শিক্ষক হিসেবে তাঁদের ন্যায্য অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। গবেষণা কাজে নিমগ্ন থেকে তাঁরা দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্রতী থাকেন। কিন্তু তাঁদেরকেও যখন সংসারের ঘানি টানার চিন্তায় দিন পোহাতে হয় তখন মেধার প্রকৃত প্রয়োগ হয় না। দেশ বঞ্চিত হয় বড় আবিষ্কার কিংবা তদ্রুপ কোনো বৃহত্তর কাজ থেকে। অন্য পেশার সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে- পরীক্ষার ফলাফল ও যোগ্যতার নিরিখে এগিয়ে থাকলেও সুবিধাবৈষম্যের কারণে সমাজের কাছে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠতে পারেন না।
এক গবেষণায় দেখা যায়, মানসম্মত শিক্ষার ১৫ শতাংশ নির্ভর করে অনুকূল পরিবেশ এবং অবকাঠামোগত সুযোগ-সুুবিধার ওপর। কিন্তু মানসম্পন্ন শিক্ষার ৮৫ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। শিক্ষকের মানসম্মত শিক্ষা প্রসারের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শিক্ষকদের কাছ থেকে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা যায় না। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, পেশাগত অসমতা, ব্যবস্থাপনা কমিটির দৌরাত্ম্য এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা, অসদাচরণ, শ্রেণিকক্ষে না আসা, শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি সবকিছু মিলে শিক্ষকতা পেশাকে এই অসহনীয় পেশায় পরিণত করা হয়েছে।
শিক্ষার বর্তমান চালচিত্রের পেছনে নানা প্রপঞ্চ কাজ করলেও এই বেহাল দশার জন্য শিক্ষকরা কম দায়ি নন। আপন স্বার্থকে বড় করে দেখার অভিপ্রায়ে লিপ্ত শিক্ষকের কেউ কেউ ভুলে যান নিজের অবস্থান। দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি, পদোন্নতির অপকৌশল, অর্থ-আত্মসাৎ, ঘুস, দুর্নীতি প্রভৃতি অন্যায় কাজে তাঁরা যুক্ত হয়ে পড়েন।
শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা বিতরণ নয়, একজন শিক্ষার্থীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার আচার-আচরণের গুণগত পরিবর্তন সাধন, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তি স্থাপন করে দেয়াও শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শিক্ষক হলো সমাজ গঠনের মূল কারিগর। শিক্ষক নবীন প্রজন্মকে জ্ঞান বিতরণ করেন, স্বপ্ন দেখান, তাদের মধ্যে বিশ্বাসের বীজ বপন করেন। যার ফলে নবীন প্রজন্ম সুশিক্ষিত, দক্ষ, যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। আমরা যদি সভ্যতার দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই প্রতিটি সভ্যতা গড়ার পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছেন শিক্ষকগণ।
শিক্ষার বর্তমান চালচিত্রের পেছনে নানা প্রপঞ্চ কাজ করলেও এই বেহাল দশার জন্য শিক্ষকরা কম দায়ি নন। আপন স্বার্থকে বড় করে দেখার অভিপ্রায়ে লিপ্ত শিক্ষকের কেউ কেউ ভুলে যান নিজের অবস্থান। দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি, পদোন্নতির অপকৌশল, অর্থ-আত্মসাৎ, ঘুস, দুর্নীতি প্রভৃতি অন্যায় কাজে তাঁরা যুক্ত হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষককে দায়ি করেন যৌন নিপীড়ন কিংবা পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম বা বেশি দেয়ার হীন কাজের অভিযোগ তুলে। অনেক শিক্ষক কোনো একটি পদে আসীন হওয়ার জন্য দলীয় শিক্ষার্থীর নেতাদের দ্বারস্থ হন-সরকারের আমলাদের নিকট ধরনা দেন রাষ্ট্রীয় কোনো কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার আশায়। অনেকে শিক্ষক হয়েছেন দলীয় পরিচয়ে বা ঘুস দিয়ে। তাদেরকে শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেন না শিক্ষক হিসেবে। আবার কেউ কেউ কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই লিপ্ত হয়ে পড়েন দলীয় রাজনীতিতে। তখন শিক্ষার্থীদেরকে পড়ানো নয় তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি, দলীয় স্বার্থ উদ্ধার প্রভৃতি। তাঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। সমাজে নেতিবাচকত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় তাঁদের হীনকর্মের জন্য। অথচ সমাজে ন্যায়বান ও জ্ঞানী শিক্ষকদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।
প্রকৃত শিক্ষা প্রদান ও গ্রহণের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে এ বার্তা প্রমাণিত হয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আলেকজান্ডার প্রমুখের নাম এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে স্মরণীয়। প্রজ্ঞাবান শিক্ষকের ছায়াতলে তাঁরা কেবল শিক্ষকের পুথিগত বিদ্যা অর্জন করেননি; আয়ত্ত করেছেন জীবনচলার পাথেয়। বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবান্ধব প্রতিভূ। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে খুব ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন; জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। এমনকি যোগ্য শিক্ষার্থীদেরকে বিয়ে দিতেও ওকালতি করতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করা শিক্ষার্থী যখন সচিবালয়ে বিভিন্ন পদে আসীন হয়, তখন তারা তার শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে-এসব প্রশ্ন কখনোই একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে সহায়ক হতে পারে না। অন্তবর্তকালীন সরকার দেশপুনর্গঠনের যে প্রত্যয় নিয়েছেন তাতে শিক্ষকদের দাবি-দাবি প্রতিফলিত না হলে এসব নীতি বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়বে। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে কোনো পরিকল্পনাই আলোর মুখ দেখবে না।
জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাকের এমন দৃষ্টান্ত অনুসরণীয়। তাঁর বাসায় যাতায়াত করতেন নানা-শ্রেণির মানুষ। এর অধিকাংশই শিক্ষার্থী প্রাক্তন কিংবা বিশ^বিদ্যালয়-পড়ুয়া। আর্থিক অনটনে শিক্ষার্থীদেরকে তিনি টিউশনি, থাকার ব্যবস্থা করতেন। বিশ^বিদ্যালয় পড়া শেষ করা অনেক শিক্ষার্থীকে দিতেন চাকুরি। তাদের অনেকেই তাঁর বাসায় আহার করতো। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন ছিলো যে প্রেম করেছে দুজন। কিন্তু বিয়ে করার সামর্থ্য নেই। তিনি বিয়ের বন্দোবস্ত করে বাসায় রাখতেন। বাসায়, অফিসে যেকোনো কাজে তাঁর সঙ্গে শিক্ষার্থীরা দেখা করতো নিদ্বির্ধায়। শ্রেণিকক্ষের পড়ার বাইরেও তিনি শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা শাখার নতুন নতুন তথ্য দিতেন।
শিক্ষা উন্নয়নের বেলায় শিক্ষকের ভূমিকা অনেক। শিক্ষকের মান-মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র কখনও কখনও বিরূপ আচরণ করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ন্যায্য দাবিতে জড়ো হলে পুলিশ গরম পানি ঢেলে তা ছত্রভঙ্গ করে। পুলিশের আচরণ দেখলে মনে হয় তারা কোনো বিদ্যায়তনের শিক্ষার্থী ছিলো না। অথবা মনে প্রশ্ন জাগে, এইট, এসসসি পাশ পুলিশ বিএ, এমএ পাশ শিক্ষককের সঙ্গে কীভাবে এমন আচরণ করতে পারে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করা শিক্ষার্থী যখন সচিবালয়ে বিভিন্ন পদে আসীন হয়, তখন তারা তার শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা হ্রাস করতে মরিয়া হয়ে ওঠে-এসব প্রশ্ন কখনোই একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণে সহায়ক হতে পারে না। অন্তবর্তকালীন সরকার দেশপুনর্গঠনের যে প্রত্যয় নিয়েছেন তাতে শিক্ষকদের দাবি-দাবি প্রতিফলিত না হলে এসব নীতি বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়বে। শিক্ষকদের অভুক্ত রেখে কোনো পরিকল্পনাই আলোর মুখ দেখবে না।
Comments