বিকটদর্শন প্রাণী চুপাকাবরা রহস্য

রহস্যময় রক্তচোষা চুপাকাবরার নাম এসেছে ছাগল থেকে। ছবি: জেমি কিরিনোস/ এসপিএল
রহস্যময় রক্তচোষা চুপাকাবরার নাম এসেছে ছাগল থেকে। ছবি: জেমি কিরিনোস/ এসপিএল

১৯৯৫ সালের মার্চ। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের শহর পুয়ের্তো রিকোতে ছড়িয়ে পড়েছে এক রহস্যময় রক্তচোষা প্রাণীর গুজব। রাতারাতি ১ কৃষকের ৮টি ভেড়া মারা গেছে।
প্রতিটি ভেড়ার দেহ রক্তশূন্য, গলায় কামড়ের দাগ। যেনো কোনো ভ্যাম্পায়ার গলা কামড়ে রক্ত শুষে নিয়ে গেছে পশুগুলোর। 

এরপর আশেপাশে অল্পসময়ের ব্যবধানেই মারা পড়তে লাগলো বিভিন্ন গবাদিপশু। পুয়ের্তো রিকো ছাড়িয়ে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকা, মেক্সিকোতেও পাওয়া যেতে থাকলো গবাদিপশুর এমন নৃশংস মৃত্যুর খবর।

সেই সঙ্গে জানা গেলো এক লোমহীন, শীর্ণ ও হিংস্র পরাণির কথা। কানোভানাস নিবাসী মেডেলিন তলেন্তিনো দাবি করেন, ঘরের জানালা দিয়ে তিনি বিকটদর্শন জ্বলন্ত চোখের এমন প্রাণী দেখেছেন। প্রাণীটির ঘাড়ের দিক থেকে লেজ পর্যন্ত সারি সারি হয়ে আছে পাঁজরের হাড়ের মত হাড়। এছাড়াও, দুপেয়ে সেই জন্তুর আছে মাঝারি আকৃতির বাঁকানো লেজও।

সে সময় পুয়ের্তো রিকোর কমেডিয়ান-অভিনেতা সিলভেরিও পেরেজ এই রহস্যময় সত্ত্বার নাম দেন 'চুপাকাবরা'। স্প্যানিশ ভাষায় চুপা অর্থ চোষা , কাবরা অর্থ ছাগল/ভেড়া। অর্থাৎ, এই রহস্যময় জন্তু ছাগল ও এ ধরণের গবাদি পশুদের রক্ত চুষে খায়।

এই বিকটদর্শন দুপেয়ে জন্তু নিয়ে জল্পনা-কল্পনা অবশ্য সেবারই প্রথম নয়।

১৯৭৫ সালের দিকেও মোকা শহরে গবাদিপশুর এমন রহস্যময় মৃত্যু হচ্ছিলো । মৃত প্রতিটি পশুরই কাঁধ বরাবর ও গলার কাছে এমন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। সে সময়ই এরকম কোনো ঘাতক পশুর অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে কথা উঠেছিলো। তবে তখন এর কোন সুনির্দিষ্ট নাম দেয়া হয়নি।

এর পেছনে কোন শয়তান উপাসনা চক্র কাজ করছিলো বলে স্থানীয়রা সন্দেহ করেন। কালো জাদু ও শয়তান উপাসনার উপকরণ হিসেবে এই নিরীহ পশুদের বেছে নেয়া হচ্ছে বলে তারা ধারণা করেন।

তবে ১৯৯৫ এ মেডেলিনের নিজ চোখে চুপাকাবরা দেখার দাবির পর আবারো আলোচনায় আসে রহস্যময় এই প্রাণী। তবে তখনও পর্যন্ত এই পরাণির কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিলো না।

এদিকে একই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় এভাবে পশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকায় অনেকে এটিকে কোনো মহাজাগতিক শক্তি বা ভিনগ্রহের পরাণির কাজ বলেও মনে করতে থাকেন।

তবে কিছুদিন পর এমন মৃত্যুর ঘটনা কমতে থাকায় চুপাকাবরার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়।

২০০৪ সালের দিকে আবারো আলোচনায় আসে চুপাকাবরার নাম।

চুপাকাবরার কুকুরসদৃশ আকৃতি। ছবি: শাটারস্টক ডট কম
চুপাকাবরার কুকুরসদৃশ আকৃতি। ছবি: শাটারস্টক ডট কম

এবারও একই কায়দায় গবাদি পশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে। তবে এবার তাদের সঙ্গে চুপাকাবরার লাশও পাওয়া যায়। তবে এই রক্তচোষা প্রাণী দুপেয়ে নয়, বরং কুকুরের মত দেখতে চারপেয়ে জীব। আকারে সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ ফুট।

আগের চুপাকাবরা ছিলো মাঝারি আকৃতির একটি ভালুকের সমান, এবার সে তুলনায় অনেক ছোট ও চারপেয়ে হওয়ায় এলিয়েন বা অলৌকিক কোন কিছু হবার সম্ভাবনা আর রইলো না।

গবেষক বেঞ্জামিন রেডফোর্ড এ নিয়ে কয়েক বছরব্যাপী গবেষণা  চালান। এছাড়া মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ব্যারি ও'কনর ও এ নিয়ে গবেষণা করেন।

রেডফোর্ড জানান যে, চুপাকাবরা আসলে সুনির্দিষ্ট কোন প্রাণী নয়। কিংবা নতুন আবিষ্কৃত কোন প্রাণীও নয়। এটি মূলত কুকুরজাতীয় বা ক্যানাইডি বর্গের বিভিন্ন প্রাণী। যার ভেতর কুকুর, শেয়াল, কাইয়োটি, র‍্যাকুনসহ বিভিন্ন প্রাণী আছে। এসব প্রাণী সার্কোপটিক স্ক্যাবি নামের এক পরজীবী দ্বারা 'সার্কোপটিক মাঞ্জ' রোগে আক্রান্ত হয়। এতে করে গায়ে ঘা হয় এবং লোম পড়ে যায়। ফলে এই রোগে আক্রান্ত প্রাণীদের দেখতে বিকটদর্শন লাগে। কুকুরজাতীয় এসব প্রাণী কখনোই রক্ত খেয়ে বাঁচেনা। তবে বেশি অসুস্থ হলে শিকার ধরতে না পেরে গবাদিপশুর খোঁয়াড় বা খামারে হামলা চালিয়ে থাকে। কখনো কখনো বেশি অসুস্থ হলে রক্ত খাওয়ার পর মারাও যেতে পারে। চুপাকাবরার ক্ষেত্রে সেটাই ঘটছিলো।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ব্যারি ও' কনরের মতে, সার্কোপটিক স্ক্যাবি নামের এই পরজীবী আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণী। এটি একসময় শুধু মানুষকে আক্রমণ করতো। পরে কুকুরজাতীয় প্রাণী ও বানরকেও আক্রমণ করতে থাকে। গবাদিপশুর গায়ে যেমন পরজীবীজনিত 'আঁটুলি' রোগ হয়, এই স্ক্যাবিজনিত মাঞ্জ রোগও এমন।

চুপাকাবরার রহস্যটি তাই শেষপর্যন্ত একটি রোগের প্রকাশ হিসেবেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

'ওজার্ক হাউলার' এর মতো আরো কিছু শহুরে কিংবদন্তির সঙ্গে এ ঘটনার মিল থাকায় সেসব রহস্যেরও মীমাংসা হয়।

কোনো অলৌকিক কিছু নয়, কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নয়; চুপাকাবরারা ছিলো আমাদেরই আশেপাশে থাকা কিছু অসুস্থ, কখনো কখনো মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে থাকা প্রাণী; যারা আরো অনেক গবাদি পশুর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

 

Comments

The Daily Star  | English

Jubo Dal leader dies in custody after 'jt forces picked him up'

The body of Touhidul Islam, 42, bore marks of trauma and injuries from his waist to the knees, family members said, alleging that he was tortured to death

1h ago