সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সুখ-দুঃখের বাস্তবতা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন না বর্তমানে এমন মানুষের সংখ্যা কমই। নিয়মিত ব্যবহার না করলেও একটি অ্যাকাউন্ট আজকাল প্রায় সবাই খুলে রাখেন।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ব্যবহারযোগ্যতার কারণে পড়াশোনা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজেকর্মে এখন প্রায় সবাই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। তাই ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম খুলে বসলেই চোখে পড়ে অন্যের জীবনের সফলতার কথা, হেসে-খেলে সময় কাটানো হাসি মুখের অজস্র ছবি।
কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে পোস্ট দিচ্ছেন, কেউ বা দামি রেস্টুরেন্টে খাবারের ছবি দিয়ে চেক ইন দিচ্ছেন। আবার কেউ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ট্যুরের ছবি দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যতটা না ব্যর্থতার চিত্র দেখা যায় তার চেয়ে বেশে সফলতার। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে থাকা সব মানুষই কি সুখী?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যক্তির দরপনের মত কাজ করে যেখানে আপনি যেমন মুখ করে দাঁড়াবেন, তারই প্রতিফলন দেখবেন উল্টো পাশে। বেশিরভাগ সময়ই আমরা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা, হাসিমুখের গল্পটাই জানাতে ভালোবাসি। তার মানে এই নয় যে হাসি মুখের আড়ালে কোনো বিষাদের ছোঁয়া থাকে না, সফলতার পেছনে কোনো ব্যর্থতার গল্প নেই, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে লেশমাত্র অভিযোগ নেই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্তমানে যতটা না যোগাযোগের মাধ্যম তার চেয়ে বেশি অন্যের জীবন নিয়ে চর্চা ও মাথা ঘামানোর মাধ্যম। যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অন্যের সফলতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে সৃষ্ট হতাশা। ফেসবুকে আপলোড করা বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী কিংবা আত্মীয়ের রঙ্গিন জীবনের ছবি অন্যকে ঈর্ষাকাতর করে তোলে। সেই ঈর্ষাকাতরতা থেকে জন্ম নেয় জীবনের প্রতি হতাশা।
শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজের দেহাবয়ব থেকে শুরু করে ব্যক্তির আদর্শ ও বিশ্বাসের ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং কম বয়স্ক ব্যক্তিদের উপরই ফেসবুক ইনস্টাগ্রামের প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর ২০১৭ সালে রয়্যাল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ একটি জরিপ চালায়। যেখানে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম কিশোর-কিশোরীদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনমন্যতা এবং হতাশা সৃষ্টি করে।
প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের দেহাবয়ব নিয়ে অসন্তোষ জন্ম নিয়েছে। ১৪ থেকে ১৫ বছরের অর্ধেকই বলছে, ফেসবুক তাদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টি করেছে। এদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ আবার বলছে, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং, অনলাইনে কুপ্রস্তাব বা মানহানিকর আচরণের প্রবণতা বেড়ে গেছে অনেক বেশি। ২০১৬ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১ হাজার ৯৫ জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে এক গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, যারা গবেষণাকালীন সময়ে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ রেখেছিল, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার কম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ মাহাবুবুল আলম ২০১৩ সাল থেকে নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করছেন। গত কয়েক মাস যাবত তিনি ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ফেসবুক ব্যবহার না করার কারণে চারপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে ধারণা থাকে না। যার ফলে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকি এবং নিজের কাজে সময় দেওয়ার সুযোগ পাই। প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমেই পেয়ে থাকি। আগে ফেসবুকে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বিষয় জেনে নিজের মধ্যে কেমন জানি অশান্তি লাগতো। এখন অনেক ভালো আছি।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যক্তিজীবনের দর্পণই শুধু নয় বরং এটি সমাজেরও দর্পণ। বিখ্যাত দার্শনিক ও মিডিয়া তাত্ত্বিক মার্শাল ম্যাকলুহান সর্বপ্রথম 'গ্লোবাল ভিলেজ' ধারণাটি প্রবর্তন করেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন, মিডিয়ার কল্যাণে পুরো বিশ্বের খবর সবার হাতের মুঠোয় চলে আসবে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটুক না কেন তা আর কারো অজানা থাকবে না। তিনি যে যথার্থই বলেছিলেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
আন্তর্জাতিক থেকে জাতীয় কিংবা আঞ্চলিক সব সংবাদই মিডিয়ায় প্রচারিত হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো জনপ্রিয় সংবাদ নিয়ে বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের নিজস্ব মতামত থাকে। যে ঘটনা নিয়ে মতামত বাদানুবাদ যত বেশি হবে, সেটি তত বেশি জনপ্রিয় হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই চর্চাটি বর্তমানে এতো বেড়ে গেছে যে, কোনো একটি ঘটনা ঘটলে মনে হয়, এটি ছাড়া পুরো দেশে আর কিছু ঘটেনি, অদূর ভবিষ্যতে ঘটবে এমন সম্ভাবনাও কম।
আপনি ওই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আপনি তখন নিজেকে ঘটনাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে ভাবতে শুরু করবেন। যেন আপনি মতামত না দিলে বিশাল কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। কিংবা ওই ঘটনার সঙ্গে পরিচিত না থাকলে আপনি 'ট্রেন্ড' থেকে সরে যাবেন বা সময়ের স্রোতে তাল মেলাতে পারবেন না।
'হাইপার নরমাইলাইজেশন' নামে ২০১৬ সালে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যাডাম কার্টিস একটি বিবিসি ডকুমেন্টারি বানান। যাতে দেখানো হয়, সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ধনকুবের এবং প্রযুক্তিগত ইউটোপিয়ানরা ১৯৭০ সাল থেকে বাস্তব বিশ্বকে বাদ দিয়ে টেকনোলজিক্যাল কর্পোরেশন দ্বারা পরিচালিত একটি 'নকল বিশ্ব' তৈরি করেছে যা রাজনীতিবিদদের দ্বারা স্থিতিশীল রাখা হয়। বর্তমান আমরা এমন একটি নকল বিশ্বে বিশ্বাস ও বসবাস করছি যে, নিজেকে ছাড়া সবাইকেই সুখী বলে মনে হয়। মনে হয়, রবিঠাকুরের সেই 'সোনার হরিণ' কেবল আপনি পাননি আর সবার হাতে হাতে রয়েছে। কিন্তু এটি একটি ভ্রম ছাড়া কিছুই না।
Comments