কর না বাড়িয়ে সরকারকে খরচ কমাতে বলল বিএনপি
শতাধিক পণ্যের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের আরোপিত কর ও ভ্যাটের সিদ্ধান্ত জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়াবে বলে জানিয়েছে বিএনপি।
একে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
আজ শনিবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এসব কথা জানান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই ১০০ টিরও বেশি পণ্যের ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে ও কিছু পণ্যের কর অব্যাহতি তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, ওষুধ এবং মোবাইল ইন্টারনেট সেবা আছে। এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, বিশেষ করে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে, চাপ বাড়াবে।
তিনি বলেন, সরকারের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির প্রথম ধাপের ৪২ হাজার কোটি টাকা এবং পরবর্তী সম্ভাব্য ঘাটতি মেটাতে এবং ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও শর্ত পূরণ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের জন্য এই ভ্যাট বাড়িয়েছে, কারণ বর্তমান রাজস্ব দিয়ে সরকার বাজেটের খরচ মেটাতে পারছে না। একইভাবে, কিছুদিন আগে সরকার সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট মোকাবিলায়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছর দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে কার্যত ধ্বংস করে ফেলেছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের অর্থনীতি কার্যত ভেঙে পড়েছে।
'এমন বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ও গতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের শাসন ব্যবস্থায় যেই থাকুক না কেন, তাকেই সেই চ্যালেঞ্জ নিতে হবে এবং যোগ্যতা ও সাহসের সাথে তা মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই চ্যালেঞ্জগুলোকে কার্যকর উপায়ে মোকাবিলা না করে এবং একটি অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের ভিত্তি তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে চলতি অর্থবছরের মাঝপথে হঠাৎ করে ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করল, যা সহজ কিন্তু জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়,' বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, 'এই সরকার তার মেয়াদের শুরুতে বলেছিল, দেশের অর্থনীতির কোনো অবস্থাতেই টাকা ছাপানো হবে না। কিন্তু, আওয়ামী লীগ সরকারের ন্যায় টাকা ছাপানোর মতো অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পদক্ষেপটি গ্রহণ করল, যা দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এবং জনগণের নাভিশ্বাসকে বাড়িয়ে দিয়েছে।'
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকারের এই নতুন করারোপের সিদ্ধান্তের ফলে বর্তমানে প্রায় ১৩ শতাংশ ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে।
বিএনপি জানায়, বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স ২০২৪ অনুসারে, বাংলাদেশের চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১৭ লাখ। বর্তমানে আরোপিত নতুন করহার এই দরিদ্র মানুষদের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি করবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব শিক্ষা ক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে পড়তে বাধ্য এবং সার্বিকভাবে হতদরিদ্রের ওপরই পড়বে বেশি।
সেইসঙ্গে বর্তমান উচ্চমূল্যের জ্বালানি খরচ আরও বাড়বে বলেও জানান তিনি।
মির্জা ফখরুল জানান, সরকার নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো ও অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এতে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে।
তিনি বলেন, অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে সরকারের মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের চরম ঘাটতি রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়েও সরকারি খরচ কমিয়ে এবং চলতি বাজেটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুনঃবিন্যাস করেও চলমান আর্থিক সমস্যার সমাধান করা যায়।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সর্বপ্রথম নজর দেওয়া উচিত খরচ কমানোর দিকে। আমরা মনে করি, সরকার তার উন্নয়ন বাজেট পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় ও আর্থিকভাবে অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিলে প্রায় ২০ শতাংশ খরচ কমানো সম্ভব এবং এতে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে সহায়ক হবে।
সরকার খরচ কমানোর মাধ্যমে বাজেটের ন্যূনতম ১ লাখ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে এবং ঘাটতি কমাতে পারে বলে মনে করে দলটি।
মির্জা ফখরুল বলেন, অপ্রয়োজনীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা প্রজেক্টের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ আপাতত বন্ধ রেখে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।
এছাড়া খরচ কমানোর পাশাপাশি সরকার এমন কিছু উৎস ও উপায় খুঁজে বের করতে পারে যা জনগণের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অর্থনৈতিক চাপ ফেলবে না।
বিএনপি জানায়, জনগণের কাছ থেকে সহজ পন্থায় পরোক্ষ কর আদায় করে রাজস্ব বৃদ্ধির এনবিআরের অযৌক্তিক পরামর্শ জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
মির্জা ফখরুল বলেন, যদিও বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় আওয়ামী সরকারের আড়াই লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা বড় চ্যালেঞ্জ, সরকার একদিকে খরচ কমিয়ে এবং অন্যদিকে আয় বাড়িয়ে, বর্তমান বাজেট ঘাটতির কিছুটা হলেও সমাধান করতে পারে।
Comments