ভ্যাটের বাড়তি বোঝায় আতঙ্কিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা

অলংকরণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা রাজস্ব বোর্ডের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও লেনদেন করের সীমার আকস্মিক পরিবর্তনের নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, এটি ক্রেতাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। শেষ পর্যন্ত পণ্য বিক্রি কমবে।

গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা তিন কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ লাখ টাকা ও লেনদেন কর ৩০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনে।

বিস্কুট, মোবাইল ফোন ব্যবহার, ইন্টারনেট বিল, তৈরি পোশাক, সেলাই ও রেস্তোরাঁয় খাবারসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে রাজস্ব বোর্ড।

এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি সরকারের এই উদ্যোগ রাজস্ব আদায় বাড়াবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণের কর-রাজস্ব সংক্রান্ত শর্ত পূরণ হবে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। কারণ প্রায় দুই বছর ধরে নয় শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে।

এসএমএসি অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্নেহাশীষ বড়ুয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টার্নওভার ট্যাক্স এনলিস্টমেন্ট ও ভ্যাট নিবন্ধনের মানদণ্ড নিম্নমুখী করায় বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসা ভ্যাটের আওতায় আসবে।'

তিনি মনে করেন, নতুন নিয়মে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাসিক লেনদেন আড়াই লাখ টাকা হলে তা টার্নওভার ট্যাক্স এনলিস্টমেন্টের আওতায় পড়বে। তখন বিক্রির ওপর চার শতাংশ কর দিতে হবে।

একইভাবে যে প্রতিষ্ঠানের মাসিক লেনদেন চার লাখ ১৭ হাজার টাকা হবে, সেই প্রতিষ্ঠানকে বিক্রির ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।

তার মতে, 'এর প্রভাব হবে ব্যাপক। অনানুষ্ঠানিক লেনদেন বাড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কর দেওয়া ব্যবসায়ীরা।'

এই কর বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, 'যদি সব লেনদেনের হিসাব রাখা যেত ও সরকার ভ্যাট আইন-২০১২ ঠিক করতো তাহলে তা কার্যকর হতো। বকেয়া আয়করও আমরা সহজেই আদায় করতে পারতাম।'

'যতদিন না পর্যন্ত দেশে নিজস্ব ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস সিস্টেম গড়ে তোলা যাবে, ব্যবসায় সচেতনতা না বাড়বে, কার্যকর পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত না হবে এবং ভ্যাট আইন-২০১২ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন না হবে, ততদিন পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ের এই সীমা কমিয়ে সরকার প্রত্যাশিত সুফল পাবে না।'

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনা মহামারির পর থেকেই ব্যবসায়ীরা বিক্রি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। ক্রেতারা দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাটের বোঝার পাশাপাশি বাড়তি দামের চাপে আছেন।'

তিনি আরও বলেন, 'গত কয়েক বছরে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের এই সিদ্ধান্ত দিনমজুর থেকে শুরু করে মধ্যমআয়ের মানুষ সবার ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করবে।'

অনেকের পক্ষে ভ্যাটের বাড়তি বোঝা বহন করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে মনে করেন তিনি। 

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়। এর আগের মাসে ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, অক্টোবর ও নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি ছিল।

জহিরুল হক ভূঁইয়া জানান, তাদের উদ্বেগ জানাতে তারা অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করছেন।

রাজস্ব বোর্ডের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কর ব্যবস্থার অটোমেশনই চূড়ান্ত সমাধান।'

তবে তার মতে, করের জন্য লেনদেনের সীমা কমানোয় ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রভাব পড়বে না।

তিনি আরও বলেন, '২০১৯ সালে আমরা এক আদেশে লেনদেন নির্বিশেষে রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, অন্যান্য দোকানসহ বেশিরভাগ পরিষেবাকে ভ্যাটের আওতায় এনেছি। তাই, লেনদেনের সীমা কমানোয় কোনো বাস্তব প্রভাব নেই।'

যেসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি কিন্তু তিন কোটি টাকার নিচে, সেসব প্রতিষ্ঠান বর্তমানে চার শতাংশ লেনদেন কর দিচ্ছে। তাদের ভ্যাট নিবন্ধনের পর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে বলে তিনি জানান।

তার ভাষ্য, 'ভ্যাট নিবন্ধনের সীমা সংশোধন করে আমরা হয়তো এ খাতে বাড়তি ভ্যাট পেতে পারি। তবে এর পরিমাণ হবে সামান্য।'

তিনি আরও বলেন, 'এসব প্রতিষ্ঠান লেনদেন করের আওতায় এলে সরকারের কোষাগারে কর বাবদ ১৭ লাখ টাকা জমা হতো।'

ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সদ্য সাবেক সভাপতি ও সিরাজ জুয়েলার্সের মালিক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে।'

তিনি আরও বলেন, 'গত দুই-তিন বছরে ক্রেতাদের প্রকৃত আয় বাড়েনি। সার্বিক পরিস্থিতিতে মুনাফার পরিমাণও কমেছে।'

'সামনের দিনগুলোয় আমাদের আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে,' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ভ্যাটের সীমা আগের পর্যায়ে রেখে সরকার ভ্যাটের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো।'

'অতীতে আমরা কখনো সরকারকে বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দেখিনি। সুতরাং, এটি একদিকে বেশ বিরক্তিকর অন্যদিকে অত্যন্ত হতাশাজনক।'

বাংলাদেশ ভোজ্যতেল পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভ্যাট বাড়লে পণ্যের দাম বাড়াবে, ক্রেতাদের খরচ আরও বাড়বে।'

'ইতোমধ্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে।'

'যদি এই নন-কমপ্লায়েন্ট ব্যবসায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়, তাহলে করের বোঝা আরও সমানভাবে বণ্টন করা সম্ভব হবে। ক্রেতাদের ওপর চাপ কমবে।'

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসায়ীরা এমনিতেই বড় সংকটে আছেন।'

তার মতে, চলতি অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনা করা উচিত। আর্থিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য করার জন্য নিম্নমুখী সমন্বয় করা উচিত।

তিনি মনে করেন, সরকার আমলাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দেওয়া অব্যাহত রাখলেও সাধারণ মানুষের অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

'সরকারি খরচ কমানো জরুরি। সরকারকে অবশ্যই ক্রেতার স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য আরও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি প্রণয়নে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা দরকার।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী নেতা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই সংকটে আছে। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়লে সংকট বাড়বে।'

'ব্যবসায়ীরা হয় কর ফাঁকি দেবেন নতুবা পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দেবেন। দাম বাড়ানো হলে ক্রেতাদের চাহিদা আরও কমবে।'

'হঠাৎ করে ভ্যাটের হার বাড়ানো হতাশাজনক। ধীরে ধীরে বাড়ালে তা গ্রহণযোগ্য হতো।'

'আইএমএফের সুপারিশ মেনে সরকার অর্থবছরের মাঝামাঝি কর আরোপ করে জনগণের ওপর বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়েছে,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Hasina regime silenced media

Chief Adviser's Press Secretary Shafiqul Alam yesterday said steps must be taken to ensure that no one can directly interfere with the media in the future like it was done during the ousted Sheikh Hasina government.

7h ago