কার্গো জাহাজে ৭ খুন

ভাগ্নেকে ১৫ দিন আগে জাহাজে নিলেন মামা, দুজনেই বাড়ি ফিরলেন লাশ হয়ে

এমভি আল বাখেরা জাহাজে নিহতদের মধ্যে কিবরিয়া ও সবুজ ছিলেন মামা-ভাগ্নে। ছবি: স্টার

গত প্রায় ৪০ বছর ধরে কার্গো জাহাজে কাজ করছিলেন গোলাম কিবরিয়া (৬৫)। ভাগ্নে সবুজ শেখকে (২৫) জাহাজের হাল ধরানোর উপযুক্ত করে তুলতে চেয়েছিলেন। মাত্র ১৫ দিন আগে সবুজকে চট্টগ্রামে নিজের কাছে ডেকে নেন।

এমভি আল বাখেরা জাহাজে মামা কিবরিয়ার সঙ্গে সবুজও যাচ্ছিলেন সার নিয়ে। গত রোববার রাতে মেঘনায় আরও ৫ জনের সঙ্গে তাদের দুজনকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

আজ মঙ্গলবার রাতে কিবরিয়া ও সবুজের মরদেহ একসঙ্গে নেওয়া হয় তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের জোয়াইড় গ্রামে।

ওই গ্রামে গোলাম কিবরিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এক শোকার্ত পরিবেশ। এক পরিবারের দুজন নিহতের ঘটনায় হতবিহ্বল পুরো পরিবার ও এলাকাবাসী। দাফনের জন্য স্থানীয় কবরস্থানে পাশাপাশি দুটি কবর প্রস্তুত করা হয়েছে। 

গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমভি আল-বাখেরা জাহাজের মাস্টার। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড়। 

তাদের প্রতিবেশী মো. আবুল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বয়স বেড়ে যাওয়ায় জাহাজের কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন কিবরিয়া। এজন্য ভাগ্নে সবুজকে জাহাজে নিয়ে যান। তার ইচ্ছা ছিল সবুজকে কাজ শিখিয়ে জাহাজের হাল ধরানোর উপযুক্ত করে নিজে কাজ ছেড়ে দেবেন।'

কিবরিয়ার পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ৯ ডিসেম্বর সবুজকে খবর দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যান মামা।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. নুরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গোলাম কিবরিয়ার একমাত্র বোন রাজিয়া বেগম। তার ছেলে সবুজ শেখ অনেকটা ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করত। মামার প্রস্তাবে খুশি হয়ে জাহাজে চলে যায় সবুজ।'

তিনি আরও বলেন, 'গত প্রায় ৪০ বছর ধরে জাহাজে কাজ করছিলেন গোলাম কিবরিয়া। দুই-তিন মাস পরপর তিনি বাড়িতে আসতেন। দুই-তিন দিন থাকতেন।'

সবুজের মা রাজিয়া বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'কোনো কাজ করত না আমার ছেলেটা। ভাই বললেন, "তোর ছেলেকে আমার কাছে দে, কাজ শিখিয়ে জাহাজের হাল ধরিয়ে দেবো।"। এ আশায় ১৫ দিন আগে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে মামার সঙ্গে কাজে যোগ দিলো ছেলেটা। কিন্তু দুজনের যে এমন পরিণতি হবে তা তো স্বপ্নেও ভাবিনি।'

কিবরিয়া ও রাজিয়ার মা আছিয়া বেগম বলেন, 'দুইদিন আগেও ছোয়ালের সাথে কথা হয়েছে। আমার ছোয়ালের তো কোনো শত্রু ছিল না। আমার নাতি রুবায়েতের বয়স মাত্র ১২, ওরে কে দেখবে।'

উল্লেখ্য, বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জাহাজ আল বাখেরার আট কর্মী সার নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। রোববার রাতে জাহাজটি চাঁদপুরের ঈশানবালা এলাকায় মেঘনা নদীতে থাকার সময় শ্রমিকরা জাহাজের বিভিন্ন কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতের কোনো এক সময়ে দুর্বৃত্তরা ওই শ্রমিকদের কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। পরে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে এ খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাহাজ থেকে পাঁচ শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করে, পাশাপাশি আরও তিনজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। পরে আহতদের মধ্যে দুজনকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

কিবরিয়া ও সবুজ ছাড়াও জাহাজের ইঞ্জিনচালক নড়াইলের সালাউদ্দিন মোল্লা, মাগুরার মাজেদুল, সজিবুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম মুন্সি ও রানার পরিচয় পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত শেষে  আজ সবার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এ ঘটনায় আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাহাজের অন্যতম মালিক মো. মাহবুব মোরশেদ বাদী হয়ে হাইমচর থানায় মামলা করেছেন। চাঁদপুরের নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, মামলায় খুন ও ডাকাতির অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৮-১০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

জাহাজে ৭ জনকে হত্যার ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য সরকারকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে নৌ-যান শ্রমিকরা। বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুনুর রশিদ জানান, ৭২ ঘণ্টায় অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না হলে ২৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে সারা দেশের নৌপথ বন্ধ রাখা হবে।


 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh is on the right track: foreign adviser

Says interim govt earned overwhelming global support in the past six months as he discusses ties his govt’s ties with major local and global powers

39m ago