বন্যার স্রোতে সব হারিয়ে দিশেহারা তারা

ভেসে যাওয়া ভিটের সামনে বিলকিস আক্তার। ছবি: স্টার

ভিটের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে ছিলেন বিলকিস। চোখে-মুখে রাজ্যের অন্ধকার। ভিটে আর কোথায়, সেখানে এখন বিশাল এক খাদ। কয়েক ফুট দূরে পড়ে আছে ভাঙা কয়েকটি টিনের টুকরো, তার ঘরের অবশিষ্টাংশ।

বন্যার পানি কিছুটা নামলে বিলকিস ও তার স্বামী পানির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন কেবল কয়েকটি টিনের টুকরোই।

সেদিকে তাকাতেই বিলকিসের চোখ ভরে ওঠে। বহু চেষ্টা করেও চোখের পানি লুকাতে পারলেন না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, 'কিছু বাহির করতে পারি নাই। খালি কটা হাড়ি-পাতিল বাহির করছি। ঘরে খাট, আলমারি, তোশক, দরজা, জানালা যা আছিল, সব ভাসাইয়া লইয়া গেছে স্রোতে।'

ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রামে মুহুরি নদীর পাড় ঘেঁষেই বিলকিস আক্তারের ভিটে। সম্পদ আর মাথা গোঁজার ঠাঁই বলতে তাদের ছিল কেবল ভিটে আর ঘরটাই। গত ২০ আগস্ট বন্যার তীব্র স্রোতে ভেসে গেছে মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকুও।

পাশ দিয়ে বয়ে চলা মুহুরি নদীতে এখনো বেশ স্রোত। একবার ভিটের দিকে আরেকবার উত্তাল নদীর দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বিলকিস।

বন্যায় পানির স্রোতে ভেসে গেছে ঘর। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রাম থেকে তোলা ছবি। ছবি: স্টার

বন্যার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বিলকিস বলেন, 'আগের কয়েকদিন ধরি বৃষ্টি চইলছিলো। মঙ্গলবার দিন (২০ আগস্ট) বেয়ান বেলা থেকে ঘরে পানি ঢুকে। দুপুরে পানি হাঁটুর সমান হই যায়। পানি থাকায় খাটের উপর বসে আমরা কোনমতে ভাত খাওয়া শেষ করি। নদী পাশে হওয়ায় আগেও এরকম পানি উঠছিলো, কিন্তু নামি যাইতো।'

তিনি বলেন, 'মনে কইরছিলাম এবারও পানি নামি যাইবো। বিকেল বেলা পানি আর স্রোত বাড়ায় আমরা তাড়াতাড়ি ফুফু শাশুড়ির বাড়িতে গিয়ে উঠি। সন্ধ্যার সময় পানির স্রোতের ধাক্কায় পুরো ঘর ভাসাই নিয়ে যায়। বুধবার বেয়ান বেলা ফুফু শাশুড়ির ঘরেও পানি ঢুকে। তখন আমরা সাঁতার কাটি প্রাইমারি স্কুলে যাই উঠি। ছয় দিন পর পানি নাইমলে বাড়িতে আসি।'

বিলকিসের স্বামী পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। অটোরিকশার মালিককে দৈনিক জমার টাকা দেওয়ার পর বাকি টাকায় কোনো রকমে দিন চলে যায় তাদের।

বন্যায় নিজেদের ঘরটা ভেসে যাওয়ার পর পাশেই আরেকজনের সেচের জন্য নদী থেকে পানি তোলার মোটরঘরে আপাতত থাকছেন তারা।

বিলকিস বলেন, 'আমরা দিনরুজি করি, দিন খাই। বহু কষ্টে ঘরটা তুইলছিলাম। সেই ঘরই এমনে চলি গেল। কি করমু জানি না। কোথায় থাকমু। নদীর পারে এত বছর ধরি আছি, কোনো সময় নদী ভাঙেও নাই। আর এবার বন্যায় আমগো সব শেষ!'

বিলকিসের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে দূর থেকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসেন তার শাশুড়ি সাহারা খাতুন।

সাহারা খাতুনের চার ছেলে। পাশাপাশি দুটি ঘরের একটিতে স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন বিলকিস। বাকি তিন ছেলেকে নিয়ে অন্য ঘরটিতে থাকতেন সাহারা।

বন্যায় এই ঘরটি ভেসে না গেলেও অবস্থা চরম শোচনীয়। স্রোতের টানে ঘরের নিচের মাটি সরে গেছে। অনেকটা শূন্যের উপরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরটি। নিচে একটা চৌকি দিয়ে কোনো রকমে ঘরটা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু যেকোনো সময় এই ঘরও ভেঙে পড়তে পারে।

সাহারা খাতুন বলেন, 'ঘর সুদ্ধা যা আছিল সব গেছে। আমগো ঘরেও আর কিয়া আছে। বাতাস মাইরলেই যেকোনো সময় ভাঙি হইড়বো। অন যামু কন্ডে জানি না।'

বন্যায় সাহারা খাতুনের ঘর কোনোভাবে টিকে থাকলেও আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। বিলকিসের স্বামী ও তার অপর তিন ছেলে সাত বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধানের আবাদ করেছিলেন। বন্যায় পুরো খেত ভেসে গেছে।

সাহারা বলেন, 'যে জায়গায় খেত কইচছিলো বেক অনো হানির তলে। হানি হাইমবো কত্তে কনে কইবো! বেক হচি গেছে।'

ঘর নেই, টাকা নেই, রোজগারের উপায়ও নেই। আগামী দিনগুলো নিয়ে তাই দিশেহারা পরিবারগুলো।

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago