কোটা সংস্কার আন্দোলন: ৮ দিনে নিহত অন্তত ১৫০, আহত কয়েক হাজার

কোটা সংস্কার আন্দোলন
পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আবু সাঈদ। ছবি: সংগৃহীত

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ এবং কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভরতদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, বুলেট নিক্ষেপে গত ১৬ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১৫০ জন নিহত হয়েছেন।

হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ নিহতের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টার সবগুলো হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফলে নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।

নিহতদের মধ্যে ১৬ জুলাই ছয়জন, ১৭ জুলাই একজন, ১৮ জুলাই ২৯ জন, ১৯ জুলাই ৬৬ জন, ২০ জুলাই ২৫ জন, ২১ জুলাই ১৪ জন, ২২ জুলাই ছয়জন এবং ২৩ জুলাই তিনজন মারা যান।

১৬ জুলাই

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এই হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও গাজীপুরে বিজিবি মোতায়েন করে সরকার।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় ১৬ জুলাই সারা দেশে অন্তত ছয়জন নিহত হন। এ ছাড়া, আহত হন কয়েকশ মানুষ।

এ দিন চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে দুই শিক্ষার্থীসহ মোট তিনজন নিহত হন। রাজধানীতে ঢাকা কলেজ ও সাইন্সল্যাব এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে নিহত হন দুইজন। এ ছাড়া, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এই হামলা 'সরকারি মদদে' হয়েছে বলে অভিযোগ করেন।

১৭ জুলাই নিহতদের গায়েবানা জানাজা পড়ার কর্মসূচি ঘোষণা দেন আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।

রাতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এক প্রজ্ঞাপনে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখতে এবং হল খালি করতে নির্দেশনা দেয়।

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও একই নির্দেশনা আসে সারা দেশের সব স্কুল ও কলেজের জন্য। স্থগিত করা হয় এইচএসসি পরীক্ষাও।

১৭ জুলাই

এদিন সকাল থেকেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির নির্দেশনা বাস্তবায়নে সিন্ডিকেট সভা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার ও হল খালি করার নির্দেশ দেয়।

১৬ জুলাই হামলায় আহত একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় এদিন মারা যান।

১৮ জুলাই

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ডাকা 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় পুলিশ এবং আগ্নেয়াস্ত্র, রড, লাঠি, বাঁশ নিয়ে ছাত্রলীগ হামলা করলে ১৮ জুলাই সারা দেশে অন্তত ২৯ জন নিহত হন এবং আহত হন অন্তত তিন হাজার।

নিহতদের মধ্যে ২৩ জনই ঢাকার। এ ছাড়া, চট্টগ্রামে দুইজন, নরসিংদীতে দুইজন, মাদারীপুরে একজন ও সিলেটে একজন নিহত হন।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া ও আজিমপুরে নিহত হন ১০ জন, যাদের মধ্যে আছেন ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদি হাসান (২৮)। এ ছাড়া, উত্তরা এলাকায় নয়জন, বাড্ডা এলাকায় দুইজন এবং ধানমন্ডি ও সাভারে একজন করে নিহত হন।

এদিন দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দেয় সরকার। কিন্তু আন্দোলনকারীদের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, 'শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়।'

রেল ও সড়কসহ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারা দেশ থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এ দিন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস ভবন এবং অন্তত তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারীদের দমনে শটগান, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে পুলিশ। সার্বিক পরিস্থিতিতে ঢাকা ছিল যেন এক রণক্ষেত্র।

যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা, রামপুরা, ধানমন্ডি, মিরপুর, সাইন্সল্যাব মোড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় ছাত্রলীগ ও পুলিশের।

আমাদের জেলা সংবাদদাতারা জানান, দেশের অন্তত ১৯টি জেলায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

১৯ জুলাই

আন্দোলনকারীদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বুলেট, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপে অন্তত ৬৬ জন নিহত হন ১৯ জুলাই।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এদিনও সাধারণ মানুষ আন্দোলনে যোগ দেন।

ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, এদিন অন্তত ৩১ জন ঢামেক হাসপাতালে মারা গেছেন অথবা তাদের মৃত অবস্থায় আনা হয়।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে অন্তত ১০ জনের মরদেহ নেওয়া হয়েছে। উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অন্তত পাঁচজন।

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে চারজনের, বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে তিনজনের, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজনের মরদেহ নেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া, রামপুরার বেটার লাইফ হাপসপাতালে পাঁচজনের ও বনশ্রীর অ্যাডভান্স হাসপাতালে পাঁচজনের মরদেহ নেওয়া হয়। তাদের মরদেহ ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

ঢাকার বাইরে রংপুরে চারজন, নরসিংদীতে তিনজন এবং সাভার, সিলেট, বগুড়া ও ময়মনসিংহে একজন করে নিহত হয়েছেন।

এ দিন ঢাকার রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, মৌচাক, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, প্রগতি সরণি, কাজীপাড়া ও মিরপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংর্ঘষ হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার থেকে মিরপুর ১০, মিরপুর ৬, মোহাম্মদপুর, রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি এলাকায় আন্দোলকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ছুড়েছে র‌্যাব।

কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন, মিরপুরে বিআরটিএ অফিস, বনশ্রী পিবিআই অফিসসহ অনেক সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর চালিয়েছে আন্দোলনকারীরা।

ভাঙচুরের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা জড়িত নয় দাবি করে এর অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, 'কোটা সংস্কারের দাবি সবার। যে কেউ এই দাবিতে সমর্থন জানাতে পারেন। কিন্তু আমাদের এই আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে কাউকে রাজনৈতিক ফায়াদা হাসিল করতে দেওয়া হবে না।'

আওয়ামী লীগ পার্টি অফিসের সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, 'অনেক সহ্য করেছি। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।'

পরদিন থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।

২০ জুলাই

কারফিউয়ের প্রথম দিনে সারা দেশে অন্তত ২১ জন নিহত হন। তাদের প্রায় সবাই বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

কারফিউ ঘোষণার পরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন।

এদিন নিহতদের মধ্যে নয়জন ঢাকায়, চারজন সাভারে, চারজন নারায়ণগঞ্জে এবং চারজন ময়মনসিংহে মারা গেছেন।

ঢাকায় নিহত নয়জনের মধ্যে আটজনকেই যাত্রাবাড়ী, রায়েরবাগ, আজিমপুর ও মিরপুর থেকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। অপরজনকে নেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে।

এ ছাড়া, ঢাকা মেডিকেলে দুইজন পুরিশ সদস্যের মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ ও ঢামেক মর্গ সূত্র জানায়, শুক্রবারের সংঘর্ষে গণপিটুনিতে তারা নিহত হয়েছেন।

ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও দুইজন এদিন মারা যান। মোহাম্মদপুর এলাকায় শুক্রবারের সংঘর্ষে তারা মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

২১ জুলাই

সারা দেশে কারফিউ জারির দ্বিতীয় দিনে সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল করে সাত শতাংশ করার আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধারভিত্তিতে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ আদেশ দেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ কোটা বরাদ্দ থাকবে।

এই সংক্ষিপ্ত রায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি এবং সরকার চাইলে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কোটা সংস্কার করতে পারবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিন দেশের তিন জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ আনা হয়েছে সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড, দনিয়া এলাকা থেকে। বাকি দুজন নিহত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে।

এ ছাড়া, সংঘর্ষে আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আরও ছয়জন এ দিন মারা যান। তারা ঢামেক, সাভার এনাম মেডিকেল ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিসে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

নিহতদের প্রায় সবাই বুলেটবিদ্ধ ছিলেন।

২২ জুলাই

সংঘর্ষে আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থান এ দিন আরও ছয়জন মারা যান।

তাদের মধ্যে চারজন ঢামেক হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের সবাই গুলি বা ছররা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বলে হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

এ ছাড়া, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায় বলে জানিয়েছেন শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদ আলী।

তিনি জানান, এই দুইজন উত্তরা ও গুলশানে সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন।

২৩ জুলাই

আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আরও তিনজন আজ মারা গেছেন। তাদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র বড়ুয়া ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অজ্ঞাত ২২ বছর বয়সী তরুণ। সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন শুভ শীল (২৪)। গত শনিবার সাভারে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

এ ছাড়া, গত রোববার মারা যাওয়া একজনের তথ্য আজ নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তার নাম ফারুক (২৪)। সাভারে শনিবারের সংঘর্ষে তিনিও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

5h ago