বৃহৎ কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় তামাক উৎপাদন বাড়ছে

বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে হেক্টর প্রতি তামাক উৎপাদন প্রায় ২১ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য গুরুতর উদ্বেগ হওয়া সত্ত্বেও তামাকজাত পণ্য থেকে অধিক মুনাফার জন্য বৃহৎ তামাক কোম্পানিগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় তামাক উৎপাদন বাড়ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে দেশে তামাক পাতার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি রেকর্ড করা হয় দুই দশমিক শূন্য চার টন, ২০২২-২৩ সালে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক ৪৬ টনে। অর্থাৎ হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে ২০ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

তামাক উৎপাদন হারের এই বৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বার্ষিক উৎপাদন বেড়েছে এক থেকে ১৪ শতাংশ। এর মধ্যে কোনো বছরই উৎপাদন কমার কোনো রেকর্ড নেই।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এর আগে তামাক উৎপাদন ২০০৯-১০ সালের একর প্রতি ৫৪ হাজার টন থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৮২ হাজার টনে উন্নীত হয়। সে হিসাবে উৎপাদন বেড়েছিল প্রায় ৫২ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও কৃষকরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন এত বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে, তামাক কোম্পানিগুলো উচ্চ ফলনশীল জাত নিয়ে আসছে এবং তামাক উৎপাদনে উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'তামাক গাছে প্রচুর সার ব্যবহার করতে হয়। কারণ এগুলো অন্যান্য প্রধান খাদ্য ও অর্থকরী ফসলের তুলনায় বেশি নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম শোষণ করে। এই রাসায়নিকগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই পরিবেশ ও কৃষকের স্বাস্থ্যের জন্য এতটাই ক্ষতিকারক যে, কিছু দেশে এগুলো নিষিদ্ধ করেছে।'

২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত জাতি হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার জন্য আইন সংশোধন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

তামাক কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার ঝুঁকিসহ স্বাস্থ্যের ওপর কী কী ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হয়। কিন্তু এটি পরিবেশে কী পরিমাণ ক্ষতি করে, সে বিষয়ে সাধারণত আলোচনা হয় না।

একটি তামাকজাত পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছানোর আগেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে মাটি, পানি ও বাতাসের ওপর।

দেশ-বিদেশের অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষ মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়, জমির কাছাকাছি থাকা পানি দূষিত করে, বাতাস দূষিত করে এবং বনকে এমনভাবে ধ্বংস করে, যার প্রভাব অন্যান্য ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রেও পড়ে।

তামাক কার্বন নিঃসরণ এবং বন উজাড়ের একটি প্রধান কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতিটি সিগারেট থেকে প্রায় ১৪ গ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। এ ছাড়া, ৩০০টি সিগারেট উৎপাদনের জন্য প্রায় একটি গাছ প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ বন উজাড় করা হয়, তার ৩০ শতাংশেরও বেশি হয় তামাক চাষ করার জন্য। পাথ কানাডার সমীক্ষা অনুযায়ী, এই হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। ৪৫ শতাংশ নিয়ে প্রথম অবস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া এবং ৪০ শতাংশ নিয়ে দ্বিতীয় উরুগুয়ে।

মাটিদূষণ

বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুসারে, তামাক বাংলাদেশের একটি প্রধান অর্থকরী ফসল এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত হিসাবে তামাক উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বাদশে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশে ২৬ হাজার ৪৭৫ হেক্টর বা ৬৫ হাজার ৪২১ একর জমিতে মোট ৬৫ হাজার ২২৭ টন তামাক চাষ হয়েছে। এই জমির পরিমাণ দেশের মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় এক শতাংশ।

২০২২ সালে বাজার গবেষণা সংস্থা ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশি তামাকের বাজারের মূল্য প্রায় ৪২০ বিলিয়ন টাকা বা সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বলে অনুমান করেছে।

অনানুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া এনবিআরের তথ্য থেকে জানা যায়, দেশের শীর্ষ কর প্রদানকারী খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম এই তামাক শিল্প। গত অর্থবছরে শুধু দেশের ভেতরে প্রায় ৮০০ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি থেকে ৩২ হাজার ৫০২ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করেছে সরকার। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় আট শতাংশ বেশি।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তামাক পাতা রপ্তানি করে আরও রাজস্ব আয় করে।

এর জন্য চড়া মূল্যও দিতে হচ্ছে।

সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ করা জেলার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়া। জেলাটিতে পরিচালিত এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, কৃষকরা উচ্চ ফলনের জন্য বড় তামাক কোম্পানির দেওয়া রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অত্যধিক মাত্রায় প্রয়োগ করার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায় এবং এসব খেতের কাছাকাছি থাকা পানি বিষাক্ত হয়ে যায়।

তামাক গাছের অবশিষ্টাংশের মধ্যে নিকোটিন থাকে। এর পাশাপাশি খেতে প্রয়োগ করা সার ও কীটনাশকের প্রভাব মাটি ও পানিতে পড়ে। যার ফলে মাটি ও পানির প্রাকৃতিক গঠন ও গুণমাণের পরিবর্তন হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনটি ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ান জার্নাল অব সোসাইটি অ্যান্ড স্পেসে প্রকাশিত হয়। তামাক চাষ করা হয় এবং তামাক চাষ করা হয় না—উভয় ধরনের জমির উপরের মাটি (০-১৫ সেমি) পরীক্ষার ফলাফল তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এসব জামির আশপাশের জলাধার থেকে পানিও পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়।

তামাকখেতে কীটনাশক অ্যালডিকার্বের উপস্থিতির অর্থ হচ্ছে ওই মাটি বিষাক্ত। যে মাত্রায় ১,৩ডিক্লোরোপ্রোপিন পাওয়া গেছে, তা তামাকের জমির মাটির বৈশিষ্ট্য নষ্ট করতে পারে।

যখন মাটির পিএইচ লেভেল কমে যায়, তখন মাটি আরও অম্লীয় হয়ে যায় এবং উর্বরতা কমে যায়। এর অর্থ হলো, পরবর্তীতে এই মাটিতে যেকোনো ফসল ফলাতে হলে আরও বেশি সার দিতে হবে।

গবেষণার প্রতিবেদন দেখে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মির্জা হাসানুজ্জামান বলেন, 'এই গবেষণায় পাওয়া গেছে যে পিএইচ৫ এর মাত্রার কারণে অনেক গাছ মরে যেতে পারে। যদিও কিছু ফসল ও গাছ এরপরও বেঁচে যেতে পারে।'

অতিমাত্রায় ফসফরাস ও পটাসিয়াম বিষাক্ত উপাদান, যা ফসফেট ও পটাশ সার থেকে আসে। এগুলো মাটির পিএইচ লেভেল কমাতে ও পরিবর্তন করতে পারে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এই কারণে গবেষণা এলাকার কৃষকদের প্রতি বছর আরও বেশি করে সার প্রয়োগ করতে হয়।'

অধ্যাপক আলমগীর বলেন, মাটিতে পটাশিয়ামের ঘনত্ব বেশি হলে ম্যাগনেশিয়াম মিশতে দেয় না। এটি একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। এমন হলে ওই মাটিতে জন্ম নেওয়া উদ্ভিদে ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতি হতে পারে।

অধ্যাপক হাসানুজ্জামান জানান, অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করলে মাটিতে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায়।

টাঙ্গাইলে করা একটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে, যে জমিতে তামাক চাষ হয় না সেখানকার মাটিতে পিএইচ মান ও ম্যাগনেশিয়াম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কিন্তু তামাক চাষ করা হয় এমন জমিতে এগুলোর পরিমাণ অনেক কম পাওয়া গেছে। একইভাবে, তামাকের জমিতে জৈব পদার্থ, নাইট্রেট, পটাসিয়াম, সালফার ও জিঙ্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থাকে, যা তামাক চাষ না করা জমিতে কম পাওয়া গেছে।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত গবেষণাটি পরিচালনা করেন আসমাউল হোসনা সুমা এবং তার দল। নমুনাগুলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়।

মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলমগীর বলেন, 'তামাক চাষের সময় জৈব পদার্থ এবং অন্যান্য নাইট্রেট, পটাসিয়াম, সালফার ও জিঙ্ক সার দেওয়ার কারণে তামাক চাষের জমিতে জৈব পদার্থ, নাইট্রেট, পটাশিয়াম, সালফার ও জিঙ্কের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি হতে পারে।'

বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার তৈন খাল নদীর পাশে তামাকখেত। ছবি: মংসিং হাই মারমা/স্টার

পানিদূষণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, একটি সিগারেটের জন্য তার জীবনচক্রে অর্থাৎ চাষ, উৎপাদন, পরিবহন ও ভোক্তার ব্যবহার পর্যন্ত প্রায় তিন দশমিক সাত লিটার পানি প্রয়োজন হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, টমেটো বা আলুসহ অনেক ফসলের তুলনায় তামাকের জন্য আট গুণ বেশি পানি প্রয়োজন। প্রতি কিলোগ্রাম তামাকের জন্য যে পরিমাণ পানি প্রয়োজন হয়, তা দিয়ে একজন মানুষের এক বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।

যখন নিকোটিন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকে পরিপূর্ণ এত পরিমাণ পানি বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে খেতের কাছাকাছি থাকা জলাশয়ে চলে যায়, তখন এর প্রভাবে কিছু জলজ প্রাণীর জীবনধারা ব্যাহত হতে পারে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং এমনকি প্রাণহানিও হতে পারে।

২০১৫ সালে কুষ্টিয়ায় পরিচালনা করা সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, কীটনাশক থেকে ১,৩ ডিক্লোরোপ্রোপিন ও অ্যালডিকার্ব সালফক্সাইড এবং অ্যালডিকার্ব সালফোনিকের মতো বিষাক্ত উপাদানসহ বিভিন্ন বিপজ্জনক অবশিষ্টাংশ পানির সঙ্গে মিশে পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে।

পরীক্ষা করা পানিতে ক্লোরপাইরিফস নামের আরেকটি কীটনাশক গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া গেছে, যা এই পানিকে মানবস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক করে তুলেছে।

গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাটিতে নাইট্রেট, ফসফরাস ও দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রধানত রাসায়নিক সার থেকে আসে। পরিবেশ অধিদপ্তর নির্ধারিত নাইট্রেটের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ পিপিএম এবং ফসফরাসের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ পিপিএম। কুষ্টিয়ায় পরীক্ষা করা পানি এই মাত্রা অতিক্রম করেছে।

অধ্যাপক হাসানুজ্জামান বলেন, 'পানিতে পিএইচ লেভেল কম হলে গাছ ও মাছসহ সব জলজ প্রাণী মরে যেতে পারে।'

তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন লেভেল তিন দশমিক শূন্য এক বা এর কম হলে অনেক প্রজাতির মাছ মারা যাবে এবং অন্যান্য অনেক প্রজাতির মাছ বড় হবে না। এমনকি তাদের জিনগত পরিবর্তন হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে যাবে।

তামাক খেতের কাছে পানিতে উচ্চমাত্রার ফসফরাসের উপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক আলমগীর বলেন, 'অত্যধিক ফসফরাস শেওলার অতিরিক্ত বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে। এর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাবে, ক্ষতিকারক শেওলার জন্ম হতে পারে, জলজ জীব ও উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় সূর্যালোক প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা নদী গবেষণা গবেষণাগারের সমন্বয়ক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ইনটেগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে হালদা নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে গবেষণা করছেন।

গত বছর তামাকসহ অন্যান্য চাষিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিজের গবেষণায় দেখতে পান, হালদা নদীর ধারে তামাক চাষের ফলে হালদার বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ জলজ জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তিনি বলেন, 'পরিবেশ ঠিক না থাকলে মা মাছ ডিম দেয় না। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই হালদায় কোনো মা মাছ ডিম দেয়নি। আমরা কোনো ল্যাব পরীক্ষা করিনি। কিন্তু দেশ-বিদেশের বিদ্যমান গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আমরা মনে করছি যে মূলত নদীর ধারে তামাক চাষ এর একটি বড় কারণ।'

পিছুটান

তামাক চাষের ফলে মাটি ও পানির কী পরিণতি হয় সেটা কৃষক জানেন।

দ্য ডেইলি স্টার এই প্রতিবেদনের জন্য বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সাতজন তামাক চাষির সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের সবাই বলেছেন, তামাক চাষ জমি ও তাদের স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু তারপরও তারা তামাক চাষে আকৃষ্ট হওয়ার কারণ হচ্ছে, অন্যান্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভ হয়। পাশাপাশি তামাক কোম্পানিগুলো তাদের নগদ অর্থসহ সার্বিক সহায়তা দেয়।

প্রায় ৪০ বছর বয়সী উশে মং প্রায় ১১ বছর ধরে তামাক চাষ করেন। গত বছর তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বান্দরবানের জামছড়ি এলাকায় প্রায় ৮০ ডেসিমেল জমির কিছু অংশে শিম ও বাকি অংশে তামাক চাষ করেন।

উশে মং বলেন, 'মৌসুম শেষে আমি তামাক থেকে প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা লাভ করেছি। কিন্তু শিম বিক্রি করে এর পেছনে হওয়া খরচও তুলতে পারিনি।'

এই মৌসুমে উশে মং প্রায় দুই একর জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তার প্রত্যাশা, গত বছরের চেয়ে এ বছর লাভ বেশি হবে তার।

বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাক চাষিরা অন্যান্য চাষিদের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি আয় করেন। ধানের তুলনায় তামাক থেকে আয় প্রায় ১৮ দশমিক ছয় শতাংশ বেশি। প্রধান অর্থকরী ফসল পাটের তুলনায় এই আয় প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি।

বেশিরভাগ তামাক চাষি তামাক শিল্পে 'চুক্তিবদ্ধ কৃষক' হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ তারা যে তামাক কোম্পানিতে নিবন্ধিত, তাদের জন্যই তামাক চাষ করেন। কোম্পানি তাদের ফিল্ড এজেন্টদের মাধ্যমে সুদমুক্ত ঋণ, বিনামূল্যে বীজ, সার ও কীটনাশক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়।

ব্রিটিশ আমেরিকান কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধু তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কৃষকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫২ হাজার, যা ২০১৮ সালে ৩০ হাজারে নেমে আসে।

এ বিষয়ে অন্যান্য কোম্পানির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়নি।

কোম্পানির ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'চুক্তির ভিত্তিতে আমাদের চাষ পদ্ধতির সাফল্য একটি প্রমাণিত মডেলে পরিণত হয়েছে। কোম্পানি ধারাবাহিকভাবে কৃষির সর্বোত্তম অনুশীলনে উচ্চ মান স্থাপন করে থাকে, যা বিভিন্নভাবে কমিউনিটিকে উপকৃত করে।'

তামাকের বাজার

তামাক চাষের সিংহভাগ সুবিধা পায় বৃহৎ কোম্পানিগুলো।

ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের অনুমান অনুযায়ী, বাংলাদেশি তামাকের বাজারের মূল্য প্রায় ৪২০ বিলিয়ন টাকা (সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার)।

বাংলাদেশের তামাক বাজারের প্রায় ৮৫ শতাংশ দখলে রাখা বিএটির ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরো বিশ্বে আনুমানিক যে পরিমাণ সিগারেট উৎপাদন হয়, তার মাত্র দুই দশমিক তিন শতাংশ উৎপাদন করে বাংলাদেশ।

২০২৩ সালে, বিএটির কর-পরবর্তী মুনাফা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৮৮ কোটি টাকায়, যা ২০১৯ সালের ৯২৫ কোটি টাকার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

বাথ ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রকল্প টোব্যাকো ট্যাকটিকসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের তামাক বাজারের নয় শতাংশে দখল রয়েছে বিএটির নিকটতম প্রতিযোগী জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনালের (জেটিআই)।

ছোট দেশীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে আবুল খায়ের টোব্যাকো কোম্পানি, আলফা টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি এবং নাসির টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

বাংলাদেশ সরকার ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর প্রায় ১০ শতাংশ বা মোট ছয় কোটি শেয়ারের মধ্যে প্রায় ৫৭ লাখ শেয়ারের মালিক। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানে সরকারের মোট বিনিয়োগ প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা তামাক কোম্পানির কোনো ধরনের প্রচারমূলক কৌশলকে উৎসাহিত করি না। তবুও, কিছু বড় তামাক কোম্পানি কৃষকদের তামাক চাষে প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন প্রণোদনা ও বোনাস দেয়। আমরা স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উভয় কারণেই তামাক চাষ কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।'

Comments

The Daily Star  | English
Income inequality in Bangladesh

Growth obsession deepened rich-poor divide

Income inequality in Bangladesh has seen a steep rise over the past 12 years till 2022, according to official data, as economists blame a singular focus on growth rather than sorting out income disparities.

16h ago