নদ-নদীতে ভারী ধাতুর দূষণ বেড়েছে, সবচেয়ে দূষিত বুড়িগঙ্গা

বুড়িগঙ্গা নদী | স্টার ফাইল ছবি

নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত দুই দশকে বাংলাদেশের নদীগুলোতে ভারী ধাতুর কারণে দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এসব দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষতিপূরণের জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

চলতি বছরের ১২ জুলাই 'এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ'-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০টি ভারী ধাতুর (এএস, পিবি, সিডি, সিআর, এফই, এমএন, সিইউ, সিও, এনআই, জেডএন) দূষণের প্রবণতা পরীক্ষা করে দেশের জলপথের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ একটি একাডেমিক জার্নাল। এটি জার্মানিভিত্তিক স্প্রিংগার নেচারের শাখা স্প্রিংগার প্রকাশ করে।

দেবাশীষ পণ্ডিত ও মোহাম্মদ মাহফুজুল হকসহ একদল বিশেষজ্ঞ প্রিজমা ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করে পদ্ধতিগতভাবে ৫৫টি নথি পর্যালোচনা করেন।

গবেষণার ফলাফল দেখা যায়, ২০০১-২০১০ সালে যে পরিমাণ দূষণ হয়েছিল, সেই তুলনায় গত দশকের (২০১১-২০২০) দূষণের মাত্রা অনেক খারাপ ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হলো—ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল

গবেষণায় প্রধানত তিনটি বিভাগের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেগুলো—ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম। এসব এলাকার নদীগুলোর বেশিরভাগে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা (ইউএসইপিএ) এবং বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

আর্সেনিক (এএস), সীসা (পিবি), ক্যাডমিয়াম (সিডি), ক্রোমিয়াম (সিআর), লোহা (এফই) ও ম্যাঙ্গানিজের (এমএন) গড় ঘনত্ব তিনটি ঋতুতেই গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে যায়। আর গ্রীষ্মের মাসগুলোতে সর্বাধিক দূষণ হয়।

ট্যানারি, টেক্সটাইল ও ইলেক্ট্রোপ্লেটিং কারখানাসহ শিল্প কারখানার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা।

এসব শিল্প কারখানা ভারী ধাতুসম্পন্ন অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে দেয়। এটি পরিবেশগত মারাত্মক সংকট তৈরি করে, যা বছরের পর বছর ধরে খারাপ হয়ে চলেছে।

দূষণের প্রধান উৎস

গবেষণায় ভারী ধাতু দূষণের একাধিক উৎস চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাকৃতিক আবহাওয়া সম্পর্কিত প্রক্রিয়াগুলোর পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কৃষি থেকে সার ও কীটনাশক, খনন, ইলেকট্রোপ্লেটিং, বস্ত্রশিল্প, কয়লা খনি ও শিল্প বর্জ্য যেমন ব্যাটারি ও রং নদীর পানির দূষণের গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

এসব দূষক বাস্তুতন্ত্রে জমা হয়, যা জলজ জীববৈচিত্র্য, মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলে।

প্রয়োজন জরুরি পদক্ষেপ

গবেষণাটি দূষণরোধে শক্তিশালী আইন এবং আরও কার্যকর প্রয়োগের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।

দূষণরোধের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে—পানিসম্পদ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে শিল্প সংশ্লিষ্টদের ও জনগণকে শিক্ষিত করতে অব্যাহত পর্যবেক্ষণ, ব্যাপক গবেষণা ও সচেতনতামূলক প্রচার।

বিশেষজ্ঞরা নদী অববাহিকা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত পদ্ধতির আহ্বান জানিয়েছেন, যা টেকসই সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করে। দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের নদীগুলো অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

গবেষণার অন্যতম গবেষক মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ড বলেন, 'আমাদের নদীগুলোতে বিশেষ করে ঢাকার মতো অঞ্চলে উচ্চমাত্রার বিষাক্ত ভারী ধাতু জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।'

এই গবেষণা মানব প্রভাবের কারণে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত ঝুঁকির একটি স্পষ্ট স্মারক হিসেবে কাজ করে, যেখানে মানব কার্যক্রম গ্রহের জলবায়ু ও বাস্তুতন্ত্রে প্রধান প্রভাবক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে নদীগুলোর সুরক্ষা কেবল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয় নয়, বরং দেশের দীর্ঘমেয়াদি পানি সুরক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার বিষয়ও।

Comments

The Daily Star  | English

Made with US cotton? Pay less at US customs

Bangladesh is likely to benefit from reduced US tariffs on garment exports under a new clause that incentivises the use of American materials, potentially enhancing the country’s competitiveness in the US market.

8h ago