সিএনএনের প্রতিবেদন

মূল্যস্ফীতির বাংলাদেশে খাবারের জন্য ‘ফুড চ্যালেঞ্জ’

এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ
কনটেন্ট ক্রিয়েটর ওমর সানি সম্রাটের তৈরি গেম এসএস ফুড চ্যালেঞ্জ। ছবি: সংগৃহীত

তখনও সূর্যের আলো পুরোপুরি ফোটেনি উত্তর-পশ্চিমের জেলা পাবনার ছাপরা গ্রামে। এর আগেই গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুর রউফ তৈরি হয়ে গেছেন। গন্তব্য পাশের ছয় মাইল দূরের বনওয়ারীনগর গ্রাম।

বনওয়ারীনগরে আরও শত শত মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে খেলার জন্য পৌঁছান রউফ। তবে তীর ছুড়ে বেলুন ফাটানো কিংবা বোতলে রিং পড়ানোর খেলা বাদ দিয়ে তিনি একটি হলুদ রংয়ের বলকে প্লাস্টিকের একটা লাঠি দিয়ে বারবার ঠেলে দিচ্ছিলেন।

তবে যত নিখুঁতভাবেই চেষ্টাই করুন না কেন, কিছুতেই আব্দুর রউফ তার সীমানা ঠিক রেখে হাড়ি দিয়ে বানানো গোলপোস্টের ভেতর দিয়ে ওই বল নিতে পারছিলেন না। তবে এতেও কোনো দুঃখ হলো না তার, বরং কৃষক আব্দুর রউফ সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে ২৫০ মিলিলিটারের একটি তেলের বোতল জেতেন।

ওই দিনের মতো খেলা শেষ হতেই আব্দুর রউফ চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলে ওঠেন, 'আবারও খেলতে আসব।'

সিএনএনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কনটেন্ট ক্রিয়েটর ওমর সানি সম্রাটের তৈরি গেম এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের কথা। যেখানে হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রতিযোগীদের মধ্যে আবদুর রউফ একজন।

তিন সন্তান, বাবা-মা ও দুই ভাইসহ নয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হলেন ওমর সানি।

সম্রাটের এই খেলার আয়োজন ১৯৮০ সালের আইকনিক শো 'তাকেশি'স ক্যাসল' এর কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে জয়ের জন্য খেলোয়াড়দের একাধিক শারীরিক বাধা অতিক্রম করতে হতো।

তবে বনওয়ারীনগরে খ্যাতি, গৌরব বা নগদ অর্থের জন্য কেউ খেলতে আসেন না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যখন জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে, তখন তারা চাল, ডাল, তেল, চিনি ও মসুর ডালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের জন্যই খেলেন।

সিএনএনকে সম্রাট বলেন, এখানে নিয়ম হলো—যিনি প্রথমে আসবেন তিনিই প্রথমে খেলবেন। আর এ জন্য কোনো ধরনের নিবন্ধনের দরকার নেই। আর এসব খেলায় যারাই অংশ নেবে, তারা সবাই বিজয়ী।

দুই বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার পর খেলার এই ধারণাটি নিয়ে আসেন ওমর সানি। বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী দামের ধারা থাকবে ঊর্ধ্বমুখী।

নানা ধরনের রঙিন উপকরণ দিয়ে খেলা আর খেলায় কোনো হার না থাকায় সম্রাটের এই উদ্যোগ ইতোমধ্যেই ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

এসএস ফুড চ্যালেঞ্জের সমন্বিত অনলাইন ভিউ এখন দেড় বিলিয়নেরও বেশি। ইউটিউব এবং ফেসবুকে প্রায় চার মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার এবং টিকটকে প্রায় দুই লাখ ফলোয়ার আছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এত ফলোয়ার থাকায় সম্রাট প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার ডলার আয় করেন কেবল অনলাইন ক্লিক এবং অন্যান্য ডিজিটাল মনিটাইজেশন থেকে।

সম্রাটের সঙ্গে কাজ করেন আরও ২৫ জন। মাসে পুরস্কার কেনাসহ অন্যান্য খরচ ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলারের মধ্যে হয়ে যায়। এই কাজে এখন পর্যন্ত কোনো স্পনসর নেননি তিনি।

তবে এই উদ্যোগ রাতারাতি সাফল্য পায়নি। ৩২ বছর বয়সি সম্রাট ২০১৭ সালে 'র‍্যান্ডম ভিডিও' বানানো শুরু করেছিলেন।

২০২১ সাল নাগাদ তিনি গ্রামের বাচ্চাদের জন্য গেমস শুরু করেন। যেখানে বিভিন্ন ধরনের গৃহস্থালী পণ্য পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। তিনি বলেন, গ্রামের মানুষ আইডিয়াটা পছন্দ করলেও পুরস্কার খুব একটা পছন্দ করেনি।

তবে এক বছর পর যখন খাদ্যের দাম বাড়তে থাকে এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মূল্য হ্রাস পায় তখন তিনি এই ফর্মুলায় হোঁচট খান। ২০২২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ২০ শতাংশ কমে যায়, যা বাংলাদেশে আমদানিকে আরও ব্যয়বহুল করে তোলে।

`ভোজ্য তেল এমনকি পেঁয়াজের দামও হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে আমরা এই খাদ্যদ্রব্যগুলোকেই পুরস্কার হিসাবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই,' বলেন সম্রাট।

তিনি বলেন, এই ঘটনা গ্রামবাসীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তারা খেলার জন্য আরও বেশি অনুপ্রাণিত হন। যারাই অংশ নেন কিছু না কিছু তারা জেতেন। সঙ্গে থাকে মজার কিছু স্মৃতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ পৌঁছেছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ইনভেস্টমেন্টসের রুচির দেশাই বলেন, মহামারি-সম্পর্কিত সরবরাহ চেইন সমস্যার পাশাপাশি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রভাবের কারণে সেই বছর উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

`এটি মূলত টার্নিং পয়েন্ট ছিল, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান বাজারের জন্য,' তিনি বলেন।

`এ ছাড়া ওই বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে তেল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভর্তুকি কমাতে হয়েছিল ঢাকাকে', বলেন দেশাই।

তবে সামনের পথে বাংলাদেশের জন্য আশার আলো দেখছেন বিশ্লেষকরা। ২০২৪ সালে জিনিসপত্রের দাম কমার পূর্বাভাস দিয়েছেন তারা।

আর এতে করে চার সন্তানের মা গৃহবধূ আসমা খাতুনের মতো মানুষের মনেও স্বস্তি এসেছে। সম্প্রতি খেলার দিনে আলু, পেঁয়াজ, চিনি ও ডাল জিতে নিয়ে গ্রামে ফিরেছেন আসমা। তার এসব খাদ্যপণ্য আগামী দিনগুলোতে তার পরিবারের জন্য স্বস্তির কারণ।

আর অন্যদিকে এই খেলা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে এখন ভিড় সামলানোই সম্রাটের মূল চিন্তা।

Comments