স্বস্তির সঙ্কটে তাঁত পল্লির কারিগররা 

সূর্য তখন মাথার উপরে চোখ রাঙাচ্ছে। তাপমাত্রা অনুভব করে বোঝার উপায় নেই যে ঠিক গত রাতেই তীব্র বাতাস আর বৃষ্টি হয়েছে অঝোর ধারায়। বৈশাখের দ্বিতীয় দিনের মধ্য দুপুরে প্রাণ প্রায় যায় যায়। এক পা দু পা করে এগিয়ে চলেছি পাবনার সুজানগর গোবিন্দপুর গ্রামের তাঁত পল্লির দিকে। কথা ছিল সকাল সকাল যাবো। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠলো না। অগত্যা ভর দুপুরেই যাত্রা। আগে থেকেই তাঁত পল্লির খুব কাছেই অবস্থান করার কারণে মিনিট কয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে।

প্রসঙ্গত বলি রাখি, আমরা এখানে এসেছিলাম নপম বইমেলার বিশেষ আয়োজনে। তাদেরই প্রস্তাবে আগ্রহী হই তাঁত পল্লির সম্পর্কে জানতে জানাতে। রেজাউল শেখের নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ এই সমাজকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে।

তাঁত পল্লির প্রথমেই সাক্ষাৎ পেলাম তাঁতী আলম মোল্লার। বয়স ছাপ্পান্ন-সাতান্ন হবে। বসে আছেন কলের সামনে। খানিকটা বিষণ্ণ মনে। ভাবলাম গরমে বোধ হয় জেরবার সময়। কিন্তু কারণটা জানালেন আলম মোল্লা নিজেই। বিদ্যুৎ নেই, মেশিন বন্ধ, কি করবো? বসে আছি। কত বছর ধরে এই পেশায়- এমন প্রশ্নের উত্তরে জানলেন, প্রায় ৩০ বছর। বললেন, তাঁতের আগের সুদিন আর নেই। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমাদের আলাপের মধ্যে হাজির হলেন গোলাম সাদমানি। 

ঢাকার ইসলামপুরে ব্যবসা করেন। লুঙ্গি নিয়ে কারবার দশ বছর ধরে। এখানকার লুঙ্গি কম দরে কিনে নিয়ে ঢাকায় খুচরা এবং পাইকারি দামে বিক্রি করেন। নিজে থেকেই তাঁত পল্লির বর্তমান অবস্থা জানাচ্ছেন। নিজে তাঁতি না হলেও এখানকার তাঁতিদের ব্যবসার উন্নতি চান। কারণ এরসঙ্গে যে সাদমানির নিজেরও স্বার্থ জড়িত। মাঝারি মানের ২০০ থেকে ৩০০ টাকার লুঙ্গি কিনে ৫০-১০০ টাকা লাভ করে ছেড়ে দেন। ব্যবসা শুরুর দিকে মাসপ্রতি ১৫০০-২০০০ পিস লুঙ্গি বিক্রি করতে পারতেন, তবে এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এগুলি কি পিস হিসেবে কিনেন? প্রশ্নের জবাবে সাদমানি জানালেন থান হিসেবে। প্রতি চার পিসে এক থান। 

আলম মোল্লা বলেন, আগের দিন আর নেই। এই এলাকায় দশ বছর আগেও তাঁত মেশিন ছিল চার'শর মতো। আর এখন ঠিকে আছে পঞ্চাশটিরও কম। একসময় তার নিজের তাঁত ছিল পঁচিশটি, এখন আছে মাত্র একটি। তাও ঠিক মতো চালাতে পাড়েন না। কথায় কথায় জানালেন এখন তিনি কাজ করেন অন্যের ফ্যাক্টরিতে। এই পেশার লোক কমে যাচ্ছে। অভিজ্ঞ লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ কি জানতে চাইলে বলেন- কারণ আর কী পোষায় না, মজুরি কম। যা আছে তা দিয়ে জীবন আর চলে না। 

কাঁচামালের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, পাশেই উপজেলা থেকে লুঙ্গি তৈরির জন্য সুতা কিনে আনেন। সুতার মান খারাপ না। সরাসরি মিল থেকে সুতা কেনা যায় না, কারণ তাতে পরিমাণে বেশি কিনতে হয়, আবার সিন্ডিকেটও আছে। মধ্যসত্বভোগী বলে একটা পক্ষ ঢুকে গেছে। আর উপায় কী। হাত বদলেই দাম বাড়ে সুতার। সঙ্গত কারণেই সুলভ মূল্যে সুতা কেনা, যেন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। আর এত পুঁজিই বা তারা কোথায় পাবে?

আলাপ করতে করতেই পাশেই এগিয়ে গেলাম 'অনাবিল উইভিং ফ্যাক্টরী'র দিকে। মালিক নেই। একটা কাজে শহরে আছেন। ফ্যাক্টরী মালিক সম্পর্কে আলম মোল্লার আত্মীয়। আমাকে নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবছা আলোয় দেখা গেল অনেকগুলো মেশিনে লুঙ্গির বুনন চলছে। মোবাইল টর্চে কিছুটা দেখার চেষ্টা করলাম। চোখের সামনে লাল-নীল-বেগুণী, বাহারি রঙের সুতার বুনন যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠল। সেখানে পাওয়া গেল পঁচিশ বছর বয়সী সুমনকে। সুমন এখানে কাজ করেন। পাকা কারিগর। দুই বছর ধরে অনাবিলে আছেন। কাজ করে পোষায়? এমন প্রশ্ন রাখতেই সুমন বলে, একথানে পাই ১৪০ টাকা। পিস প্রতি ৩৫ টাকা। মাসে আট হাজার সর্বোচ্চ। এরমধ্যে বিদ্যুৎ না থাকলে, মেশিন চলে না, রোজগারও হয় না। চুক্তির কাজ। মালিকের দায় নাই। এতে চলতে পারেন? কোনো জবাব না দিয়ে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন সুমন। 

তাঁতী আলম মোল্লার সঙ্গে লেখক।

সেখান থেকে বের হওয়ার পথেই মুখোমুখি হই তোরাব আলীর সঙ্গে। বায়ান্ন বছর বয়সী তোরাব আলীও কাজ করেন অনাবিলে। অভিজ্ঞতা একই, সুমনের মত। আলাপ চলছে, ততক্ষণে একজন দুইজন করে আমাদের দল পাঁচ-ছয়জনে পরিণত হয়েছে। এরা সবাই তাঁতের সঙ্গেই জড়িত। জানতে চাইলাম তাঁতশিল্পের উন্নয়নে আপনারা কি চান? প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক তাকিয়ে রইলো প্রায় সবাই। খানিকটা বিব্রত হয়ে বললাম না, আমি এমন কেউ নই, যে সমাধান করতে পারবো, তবুও জানতে চাই। যদি বলেন..। 

সুতার সিণ্ডিকেট ভাঙ্গা দরকার, সুলভ মূল্যে সুতা কেনার ব্যবস্থা থাকতে হবে, রঙের সিণ্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে, একইসঙ্গে সুদমুক্ত ঋণ দিতে হবে। তাদের দাবি শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলাম পার্শ্ববর্তী সেলিম মোল্লার বাড়ির দিকে। 

বাড়ির সামনে অল্প ফাঁকা জায়গায় আড্ডায় মশগুল মোল্লা এবং তার নিকটজনেরা। প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই মোল্লা জানালেন, বিদ্যুৎ নাই, মেশিন বন্ধ। আমরাও তাদের আড্ডায় বসি। জানতে পারি সেলিম মোল্লার দুইটা তাঁত। তিনি আর স্ত্রী আজিরুন মিলেই মেশিন চালান। বিয়ের পর থেকেই আজিরুন স্বামীর সঙ্গে কাজ করেন, সুতায় সুতায় স্বপ্ন বুনেন। আয় ইনকাম আহামরি তেমন নয়, কোনো রকমে জীবন চলে যায়। আজিরুন আমাদের আলাপে যুক্ত হয়। স্বামীর সঙ্গে কথা জুড়ে দিয়ে বলেন, সুতার দাম বাড়ছে কিন্তু লুঙ্গির দাম বাড়ে নাই। 

আজিরুন, মোল্লা, তোরাব আলীদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। বাড়নের কালে কত কিছুর দাম বাড়ে কিন্তু তাদের শ্রমের দাম বাড়ে না, লুঙ্গির দাম বাড়ে না। তবুও তারা পেশা বদলান না। বলেন, বাপ দাদার পেশা চাইলেই ছাড়া যায় না, মায়া হয়, মায়া। 

ফেরার পথে গোলাম সাদমানি আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকেন। আমি না করলেও এগিয়ে দেন। এসব সমস্যার সমাধানে কিছু করার আবদার করেন। বলি, আমিও আপনাদেরই একজন। তাদের পক্ষ বলছি.. হে রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ আপনারা কি গোবিন্দপুরের তাঁতিদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন?

Comments

The Daily Star  | English

10-day holiday for Eid-ul-Azha

The decision was made today at a meeting of the advisory council at the Secretariat

42m ago