বাংলার প্রাচীন ভাস্কর্যের সাক্ষ্য সরাইলের বিরল বিষ্ণু মূর্তি
ঈশা খাঁর জন্মস্থান হিসেবে খ্যাত সরাইলে নথিভুক্ত নয় এমন এক বিরল বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার বিভিন্ন প্রত্নস্থল ঘুরে দেখার সময় প্রস্তর নির্মিত মূর্তিটির সন্ধান পাওয়া যায়। মূর্তিটি বর্তমানে উপজেলা সদরে 'আনন্দময়ী কালী বাড়ি' নামে পরিচিত একটি প্রাচীন মন্দিরে পূজিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরাইলের বিখ্যাত জমিদার দেওয়ানরা আনন্দময়ী কালী বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরাইলের দেওয়ানরা ঈশা খাঁনের বংশধর বলে জনশ্রুতি আছে।
আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত ও পূজিত মূর্তিটিতে বিষ্ণুর উপরে ছত্র, এর নিচে দু'পাশে বিদ্যাধর। বিষ্ণুর উপরের অংশে দু'পাশে দশাবতার এবং পায়ের দু'পাশে রয়েছে দুজন সহদেবী। মূর্তিটির পট্টঠেসের/পৃষ্ঠপটের (Back slab) শীর্ষদিক গোলাকার। মূর্তিতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, পট্টঠেসের শীর্ষদিক গোলাকার বিশিষ্ট দশাবতার বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান পাওয়ার ঘটনা এটি প্রথম।
গবেষকদের মতে, আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিটি বাংলার মূর্তিকলা চর্চার প্রাথমিক যুগের তথা সপ্তম থেকে দশম শতকের নিদর্শন। আনন্দময়ী কালী বড়িতে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটি ছাড়াও সরাইলের কালীকচ্ছ ইউনিয়নে রক্ষাকালী ও বাসুদেব মন্দিরে আরও একটি প্রাচীন বিষ্ণু মূর্তি পূজিত হচ্ছে, যা প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার 'বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। মূর্তি-তত্ত্ববিদদের অভিমত, কালীকচ্ছ ইউনিয়নে পূজিত বিষ্ণু মূর্তিটি বাংলার মূর্তিকলা চর্চার শেষ পর্ব তথা একাদশ-দ্বাদশ শতকের নিদর্শন।
মূর্তিতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দশাবতারসহ বিষ্ণুমূর্তি পূর্ববঙ্গের মূর্তিকলার নিজস্ব রীতি। মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গেই দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তির সন্ধান বেশি মেলে। জার্মান মূর্তিতত্ত্ববিদ ড. জের্ড জে. আর. মেভিসেন-এর (Gerd J.R. Mevissen) লেখা 'কর্পাস অব দ্য বিষ্ণু ইমেজেস উইথ দশাবতারস প্রিডোমিনেন্টলি ফ্রম বেঙ্গল' (Corpus of Vsnu Images with dasavatåras predominantly from Bengal) শীর্ষক প্রবন্ধ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে তখন পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া ৭৭টি দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তির উল্লেখ করেছেন। ড. মেভিসেন-এর উল্লেখ করা তালিকার ৭৭টি মূর্তির মধ্যে ৬৩টি পাওয়া গেছে দক্ষিণ ও পূর্ব বঙ্গে। পশ্চিম বঙ্গে পাওয়া গেছে ৫টি এবং উত্তর বঙ্গে ৩টি। এছাড়া আংশিক অবতার রয়েছেন এমন মূর্তি ৪টি এবং স্থাপত্যের অংশ ছিল এমন ২টি মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়।
দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিতে সাধারণত বিষ্ণুর কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত দুই পাশে পাঁচ জন করে দশ জন অবতারের মূর্তি থাকে। তবে দশাবতারের বিন্যাসে ভিন্নতা দেখা যায়। কোনোটিতে দশাবতারের ক্রম ঘড়ির মতো। ক্রম ঘড়ির মতো হলেও কিছু মূর্তিতে দু'পাশে দু'টি অবতার সারির অবস্থান সমান্তরাল। আবার কিছু মূর্তিতে দশাবতার রূপ নিয়েছে আর্চের মতো। কোনোটিতে দু'পাশে নিচ থেকে ক্রমশ উপরে দশাবতারের সারি। আবার কোনোটিতে ডান থেকে বাম হয়ে উপরে উঠেছে অবতারের ক্রম। উল্লিখিত প্রবন্ধে ড. জের্ড জে. আর. মেভিসেন দশাবতারের বিন্যাসের ভিত্তিতে মূর্তিগুলোকে ছয়টি মোডে ভাগ করেছেন। সরাইল আনন্দময়ী কালী মন্দিরে রক্ষিত দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিটি ড. জের্ড জে. আর. মেভিসেন-এর তৃতীয় মোডের অনুরূপ। এতে মৎস্য থেকে কল্কি নারায়ণ পর্যন্ত দশ জন অবতারের মিনিয়েচার মূর্তি বিন্যস্ত রয়েছে ডান থেকে বাম হয়ে ক্রমশ ঊর্ধ্ব দিকে। তবে ড. জের্ড জে. আর. মেভিসেন প্রণীত দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তির তালিকায় সরাইল আনন্দময়ী কালী মন্দিরে রক্ষিত দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিটির উল্লেখ নেই।
ভারতীয় মূর্তি তত্ত্বের বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত ড. জের্ড জে. আর মেভিসেনকে ইমেলে সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিটির আলোকচিত্র পাঠিয়ে এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তিনি ইমেইলে মতামত দেন। ইমেইলে তিনি এ সম্পর্কে বলেন, 'thank you very much for making me aware of this visnu image with avataras and sending me the 3 photographs. this image is indeed previously unrecorded.'
ড. জের্ড জে. আর মেভিসেন আরও উল্লেখ করেন, 'I assume that you know my article on the topic published in 2010. since then i am keeping an update of the same, in which i have now inserted a record of your new finding at the end of "Mode 3". ... i am planning to publish an update of my 2010 article since by now i have come across quite a number of images that have not been included there, of which your sarail visnu is the newest addition.'
ড. জের্ড জে. আর মেভিসেন আরও বলেন, in any case, this image is an important addition to the previously known visnu images with avataras from bengal, since it adds the brahmanbaria district to the regions of provenance of such images. the only image from brahmanbaria known so far is the unpublished one listed in my article of 2010 on p.195 as "V*8", said to be in the bangladesh national museum.'
সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়ি চত্বরে বর্তমানে কালী মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, শনি মন্দির ইত্যাদি মন্দির ভবন এবং নাট মন্দির, পূজারীদের আবাসিক ভবন ও অফিস ভবন রয়েছে। এর মধ্যে কালী মন্দিরটি আনন্দময়ী কালী বাড়ির চত্বরের কেন্দ্রীয় মন্দির। বর্তমানে বিষ্ণু মূর্তিটি পূজিত হচ্ছে কালী মন্দিরে। বিষ্ণু মূর্তিটি মন্দিরের পাকা দেয়ালের সঙ্গে সিমেন্ট দিয়ে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ জানায়, কালী মন্দির থেকে পাথরের তৈরি কালী মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছিল। এরপর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বিষ্ণু মূর্তি দেয়ালে সংযুক্ত করে স্থাপন করা হয়েছে। কালী মূর্তির পশ্চিম পাশে স্থাপন করা রয়েছে বিষ্ণু মূর্তিটি। সরাইল আনন্দময়ী কালী মন্দিরে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটির উচ্চতা ২ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১ ফুট ২ ইঞ্চি। এর মধ্যে পা থেকে মাথার চূড়া পর্যন্ত বিষ্ণু মূর্তির উচ্চতা ১ ফুট সাড়ে ১০ ইঞ্চি।
পট্টঠেসে মূর্তির মাথার উপরে সিংহমুখ ও ছাতার উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে বাংলায় প্রাপ্ত মূর্তিগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা কীর্তিমুখ ও ছত্রমুখ। বাংলায় প্রাপ্ত অধিকাংশ পাথরের মূর্তিই কীর্তিমুখ। অন্যদিকে আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটি ছত্রমুখ। গবেষকদের মতে, ছত্রমুখ রীতি বাংলার নিজস্ব শিল্পরীতির নিদর্শন। ছত্রমুখ মূর্তিতে অলঙ্কারের বাহুল্য থাকে না। ছত্রমুখ রীতির মূর্তি সাধারণত দশম শতক এবং এর পূর্ববর্তী সময়ের নিদর্শন। ছত্রমুখ মূর্তি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, 'ছত্রমুখমূর্তিগুলোই হল বাংলাদেশের আসল শিল্পসাধনা। কীর্তিমুখ মূর্তিগুলোতে বাংলাদেশ করেছে বাইরের চেলাগিরি। বাংলাদেশের সংস্কৃত-রচনায় গৌড়ীয় যে রীতি দেখতে পাই, তাতে শব্দ ও অলংকারের গুরুভার। সেখানে বাংলাদেশ অন্য দেশকে চোখের সামনে রেখেই সকলকে বিস্মিত করে দিতে চেয়েছে।'
ক্ষিতিমোহন সেন এ সম্পর্কে বলেছিলেন, বাংলার যে শিল্প সত্যই তার নিজস্ব, তাতেও দেখি অলংকারের স্বল্পতার সঙ্গে ভাবের গভীরতা। বাংলার ছত্রমুখ মূর্তিগুলির মধ্যে তাই দেখি মানবীয়ভাবের সঙ্গে দেবভাবের গভীরতম অথচ সহজ যোগ, অলংকারের বাহুল্যে তা আচ্ছন্ন নয়।
সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটিতে ছত্রের নিচে দুপাশে রয়েছে বিদ্যাধর। এর নিচে দশাবতার। এর নিচে দুজন সহদেবী। সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়িতে সন্ধান পাওয়া বিষ্ণু মূর্তিটির কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত দুপাশে রয়েছেন পাঁচ জন করে দশ জন অবতারের মিনিয়েচার মূর্তি। মূর্তি তত্ত্ব গবেষক ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শারমিন রেজোয়ানা মূর্তিটি পর্যবেক্ষণ করে দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, বিষ্ণুর বামে নিচ থেকে মৎস্য, বরাহ, বামন, রাম ও বুদ্ধ। ডানে রয়েছেন নিচ থেকে কুর্ম, নরসিংহ, বলরাম, পরশুরাম ও কল্কি অবতার।
শারমিন রেজোয়ানা মূর্তিটি সম্পর্কে আরও বলেন, মূর্তিটির ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য পৃষ্ঠপটের শীর্ষের গোলাকার আকৃতি। সাধারণত নবম-দশম শতকের প্রতিমার পৃষ্ঠপটের শীর্ষের আকৃতি এই ধরনের হয়ে থাকে। তিনি আরও বলেন, বাংলায় প্রাপ্ত অধিকাংশ আদি মধ্য যুগীয় বিষ্ণু প্রতিমাতে সহদেবীদের পাশে সাধারণের চক্র পুরুষ এবং শঙ্খ পুরুষকে উপস্থাপন করা হয়। এখানে যে ফিচারটি লক্ষণীয় তা হলো সহদেবীদের পাশে কোনো আয়ুধ পুরষ উপস্থিত হয়নি।
মূর্তি তত্ত্ববিদ ও এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া হক সরাইলের আনন্দময়ী কালী বাড়িতে সন্ধান পাওয়া মূর্তিটি প্রসঙ্গে বলেন, মূর্তিটিতে কম অলঙ্করণ, গোলাকার শীর্ষদেশ ও ছত্রমুখ হওয়ার কারণে প্রাথমিক যুগের বলে মনে হয়। মূর্তিটি দশম শতকের নিদর্শন হতে পারে। অন্যদিকে কালীকচ্ছে মন্দিরে রক্ষিত মূর্তিটিতে অলঙ্কারের আধিক্যসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থেকে প্রতীয়মান হয়, মূর্তিটি পরবর্তী যুগের। দ্বাদশ শতকের নিদর্শন হতে পারে।
প্রবীণ মূর্তি তত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন সরাইলের বিষ্ণু মূর্তিটি প্রসঙ্গে বলেন, এ ধরনের বিষ্ণু মূর্তি আমি ইতোপূর্বে কখনো দেখেনি। মূর্তিটি খুবই বিরল। পট্টঠেসের উপরের অংশ গোলাকার বিশিষ্ট বিষ্ণু মূর্তিতে দশাবতার থাকার নিদর্শন সম্ভবত এটি প্রথম। মূর্তিটির পট্টঠেসের উপরিভাগ একেবারে গোলাকার। অষ্টম শতকের প্রথমভাগের পর বাংলার মূর্তির পট্টঠেসের শীর্ষদেশে গোলাকার রাখার বৈশিষ্ট্য আর দেখা যায় না। তখন পট্টঠেসের শীর্ষদেশে হালকা কৌণিক রাখার প্রচলন শুরু হয়। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, পট্টঠেসের শীর্ষদেশে কৌণিকের পরিমাণ তত বেড়েছে। মূর্তিটির উপরের অংশ, নিচের অংশ, গোলাকার শীর্ষদেশ, পেডেস্টাল, অলঙ্করণসহ নানা বৈশিষ্ট্য সাক্ষ্য দিচ্ছে, মূর্তিটি সপ্তম শতকের শেষভাবে নির্মিত। বাংলার মূর্তি শিল্প বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের নিদর্শন এটি।
তিনি আরও বলেন, সপ্তম শতাব্দীতে সারনাথ ভারতের অন্যতম প্রধান মূর্তি শিল্প চর্চা কেন্দ্র ছিল। সরাইলের বিষ্ণু মূর্তিটিতে সারনাথ কেন্দ্রের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মূর্তির দেহ শীর্ণ নয়, দেহ পুরুষ্ঠ, গোলাকার। পুরুষ্ঠ ও গোলাকার দেহ বিশিষ্ট মূর্তি দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে দেখা যায়, সপ্তম শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত। এরপর দেহ ক্রমশ শীর্ণকায় হয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে মূর্তিকলার যে নিজস্ব রীতি গড়ে উঠেছিল, সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়িতে রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তিটি তার সূচনা পর্বের নিদর্শন।
সরাইল উপজেলা সদরে প্রধান সড়কের পাশে প্রধান দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে বিকেলবাজার শাহী মসজিদ ও আনন্দময়ী কালী মন্দির। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত উল্লিখিত সড়কটির পূর্ব পাশে আনন্দময়ী কালী মন্দির এবং পশ্চিম পাশে মসজিদ। মসজিদ থেকে প্রায় ৫০ মিটার উত্তরে মন্দিরের অবস্থান। সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়িটির অবস্থানস্থলের নাম কাচারিপাড়া। মন্দির সংলগ্ন উত্তর দিক থেকে শুরু হয়েছে সরাইলের বিখ্যাত দেওয়ানবাড়ি যা বিস্তৃত সরাইল প্রাতঃ বাজার মসজিদ পর্যন্ত। সরাইল আনন্দময়ী কালী বাড়ি সরাইল উপজেলা সদরের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান মন্দির বলে পরিচিত।
সরাইল বিকেলবাজার শাহী মসজিদের শিলালিপি রয়েছে। এতে উল্লেখ রয়েছে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় মজলিশ শাহবাজের পুত্র নুর মোহাম্মদের স্ত্রী মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। শিলালিপিতে উল্লিখিত মজলিশ শাহবাজ এবং নুর মোহাম্মদ ছিলেন সরাইলের বিখ্যাত দেওয়ান বংশের জমিদার। কিন্তু আনন্দময়ী কালী মন্দিরের নির্মাণের শিলালিপি নেই। মন্দিরের প্রাচীন কাঠামোটি ২০০৪ সালে ভেঙে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। তবে জনশ্রুতি অনুযায়ী, সরাইল বিকেলবাজার শাহী মসজিদ ও আনন্দময়ী কালী বাড়ি একই সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল।
ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক এবং স্থানীয় সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ত্রিতাল সঙ্গীত নিকেতনের অধ্যক্ষ সঞ্জীব কুমার দেবনাথ এ প্রসঙ্গে জানান, আনন্দময়ী কালী বাড়ির প্রতিষ্ঠার লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে জনশ্রুতি অনুযায়ী, মন্দিরটি চারশ বছর পুরোনো। সরাইল বিকেলবাজার মসজিদ নির্মাণের সময় মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। সরাইলের দেওয়ানরা মন্দিরটি নির্মাণের সময় এবং নির্মাণ পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন।
আনন্দময়ী কালী বাড়ি পরিচালনা কমিটির সভাপতি দিলীপ চন্দ্র বণিকসহ কমিটির নেতৃবৃন্দও চারশ বছর আগে দেওয়ানদের পৃষ্ঠপোষকতায় আনন্দময়ী কালী বাড়ি প্রতিষ্ঠার জনশ্রুতি প্রচলিত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
আনন্দময়ী কালী বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দেওয়ান বংশের সন্তান ও স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেওয়ান রওশন আরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দেওয়ানরা বাড়ির পাশে তাদের নিজস্ব জায়গায় আনন্দময়ী কালী বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ জন্য তারা ভূমিদানসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন। দেওয়ান রওশন আরা আরও বলেন, আমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহসহ পূর্বপুরুষরা আনন্দময়ী কালী বাড়ি পরিচালনা কমিটির শীর্ষপদে থেকে মন্দির পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছেন। শুধু আনন্দময়ী কালী বাড়ি নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ইত্যাদি জেলার বিভিন্ন স্থানে কালভৈরব মন্দির, পাগল শঙ্কর আখড়াসহ বিভিন্ন মন্দির, আখড়া নির্মাণ করেছিলেন দেওয়ানরা। মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ আমলের প্রথম ভাগ পর্যন্ত এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু। দেওয়ানরা সবার জন্য করেছেন। তারা মসজিদ, মাজার, মন্দির, আখড়া সবই নির্মাণ করেছিলেন। তিনি আরও বলেন, দেওয়ানরা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। সরাইলের দেওয়ানরা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে শত শত বছর ধরে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে আসছেন।
সরাইলের দেওয়ানগণ ঈশা খাঁনের বংশধর বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ওয়েবস্টার রচিত কুমিল্লা জেলা গেজেটিয়ার, কৈলাস চন্দ্র সিংহের 'রাজমালা' গ্রন্থে সরাইলের দেওয়ানদের ঈশা খাঁনের বংশধর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার মতে, 'এ সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এটি সম্ভাব্য ঘটনা বলে মনে হয়। কারণ সরাইল ছিল ঈশা খাঁর একটি বিশিষ্ট ঘাঁটি এবং তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। খুব সম্ভব তার মৃত্যুর পরে জেলার অন্যান্য পরগনার মতো এ পরগনাও তার কোনো নিকট আত্মীয়ের জমিদারিতে পরিণত হয়েছিল।'
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ আছে, বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈশা খাঁন সরাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে ঈশা খাঁ সরাইলের জমিদার হন এবং এরপর ক্রমান্বয়ে জমিদারির এলাকা বিস্তৃত করেন। বাংলাপিডিয়ায় আরও উল্লেখ আছে, 'তিনি ১৫৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হিসেবে ঘোষণা দেন এবং নিজেই মসনদ-ঈ-আলা উপাধি গ্রহণ করেন। সূত্র অনুযায়ী, এ সময় তিনি তার প্রশাসনিক কেন্দ্র সরাইল থেকে সোনারগাঁও-এ স্থানান্তর করেন|
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার 'বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ' গ্রন্থে সরাইলের দেওয়ানদের নির্মিত মুঘল আমলের বিভিন্ন মসজিদ, মাজার, মন্দিরের বর্ণনা রয়েছে। 'কুমিল্লা জেলার ইতিহাস' গ্রন্থে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার লেখা 'কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরগনার কথা' এবং সরাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শেখ মুহাম্মদ আবু হামেদ-এর লেখা 'সরাইল থানার ইতিহাস সন্ধানে' শীর্ষক প্রবন্ধে রয়েছে সরাইল পরগনা ও দেওয়ান বংশের বিবরণ। উল্লিখিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধসমূহ জানা যায়, পাঠান আমল থেকে উনিশ মধ্যভাগ পর্যন্ত সরাইলের দেওয়ানরা প্রায় অর্ধ স্বাধীনভাবে সরাইল পরগনার অধিকারী ছিলেন। মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ আমলের প্রথমভাগে ৩০৪ বর্গমাইল আয়তনের সরাইল পরগনার অধীনে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সরাইলের দেওয়ান বংশের প্রথম জমিদার ছিলেন মজলিশ গাজি, দ্বিতীয় জমিদার ছিলেন মজলিশ শাহবাজ এবং তৃতীয় জমিদার ছিলেন নুর মোহাম্মদ। ব্রিটিশ আমলে সরাইলের জমিদারি দেওয়ানদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। তখন সরাইলের প্রশাসনিক গুরুত্বও কমিয়ে দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে নতুন মহকুমা করে সরাইলকে এর অধীনস্থ করা হয়।
বিষ্ণু মূর্তিটি কবে থেকে সরাইল আনন্দময়ী কালী মন্দিরে পূজিত হচ্ছে এবং কোথা থেকে মূর্তিটি সংগ্রহ করা হয়েছিল-এ বিষয়ে খোঁজ করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি সরাইল সরজমিন কালে আনন্দময়ী কালী মন্দির পরিচালনা কমিটির সভাপতি দিলীপ চন্দ্র বণিক, মন্দিরের পূজারী স্বাধীন চক্রবর্তী, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সরাইল উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঠাকুরধন বিশ্বাসসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। দিলীপ চন্দ্র বণিক, স্বাধীন চক্রবর্তী, ঠাকুরধন বিশ্বাস প্রমুখ ডেইলি স্টারকে জানান, তারা তাদের পিতাদের কাছে শুনেছেন, তাদের পিতাদের প্রজন্মও শৈশব থেকে মূর্তিটি কালী বাড়িতে দেখে আসছেন। তাদের পিতাদের প্রজন্মের কাছেও মূর্তিটি কবে থেকে কালী বাড়িতে রক্ষিত আছে-এ বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে প্রাচীন মূর্তি পাওয়ার পর আশে-পাশের মন্দিরে এনে সংরক্ষণ ও পূজা করার রেওয়াজ রয়েছে। সরাইলের বিষ্ণু মূর্তিটির ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। সরাইলের দশাবতারসহ বিষ্ণু মূর্তিটি হয়তো মন্দিরের আশে-পাশে কোনো স্থানে পাওয়া যাওয়ার পর মন্দিরে এনে সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
সরাইলের অপর বিষ্ণু মূর্তিটি রক্ষিত আছে কালীকচ্ছের নন্দীপাড়ায় রক্ষা কালী মন্দির চত্বরে নির্মাণ করা বাসুদেব মন্দিরে। সরেজমিনে মন্দির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ দাস, মন্দিরের পূজারি দুলাল চক্রবর্তী, সরাইল গবেষক ও কালিকচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা শেখ মজলিশ ফুয়াদ প্রমুখ জানান, মূর্তিটি মন্দিরের পাশে একটি প্রাচীন পুকুর থেকে উদ্ধার হওয়ার পর রক্ষাকালী মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এরপর রক্ষাকালী মন্দির চত্বরে বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করে মূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল। মূর্তিটি একবার চুরি হয়ে গিয়েছিল। উদ্ধার হওয়ার পর সিমেন্ট দিয়ে দেয়ালে সংযুক্ত করে স্থাপন করা হয়েছে।
কালীকচ্ছে মন্দিরে পূজিত বিষ্ণু মূর্তি সম্পর্কে মূর্তিতত্ত্ব গবেষক শারমিন রেজোয়ানা বলেন, প্রতিমার পৃষ্ঠপটের শীর্ষ কৌণিক, তাতে কীর্তিমুখ এবং দুই পাশের বিদ্যাধরের অলংকরণ। এর নিচে পত্রবলী, গজ-সিংহ, মকর মুখ যুক্ত সিংহাসন অলংকরণ ইঙ্গিত করে এর নির্মাণ কাল সম্ভবত একাদশ-দ্বাদশ শতক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, সরাইলে প্রাচীন মূর্তি পাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, মেঘনা তিতাস অববাহিকার এই অঞ্চলটিতে উঁচু ভূমি ছিল এবং এতে অনেক আগেই বসতি গড়ে উঠেছিল। হিন্দু-বৌদ্ধ যুগে এখানে গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বিষ্ণু মূর্তি সন্ধান পাওয়ার ঘটনা সরাইল অঞ্চলে প্রাচীনকালে বৈষ্ণব মতবাদের জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয়। অঞ্চলটির ইতিহাস পুনর্গঠনে সন্ধান পাওয়া বিষ্ণু মূর্তিসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Comments